১৮ মে ২০২৪, শনিবার



ডেঙ্গু প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

জান্নাতুল যূথী || ১০ জুলাই, ২০২৩, ১১:০৭ এএম
ডেঙ্গু প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে


প্রতিবছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। এ সময়টাতে বর্ষার পানি জমে বাড়ি-ঘর-উঠোন-নালায়  এডিস মশার বংশবৃদ্ধি হয়। সেইসঙ্গে বাড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এ বছর গত কয়েক বছরের তুলনায় ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যের সংখ্যা বেড়েছে। তবু নেই তেমন কোনো সমন্বিত উদ্যেগ! ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যে ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে, তা মোটেও যথেষ্ট নয়। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত শনিবার (৮ জুলাই) সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। যা চলতি বছরে এক দিনে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকেও সর্বোচ্চ। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ৭৩। আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ বছর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ১২ হাজার ৯৫৪ জন। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৩২০ এবং মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের, যা আগের বছরের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০২২ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ২৫৮ জন, ছিল না কোনো মৃত্যু। জানুয়ারি থেকে জুনের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮৯ এবং  মৃত্যু হয় একজনের। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে ২ হাজার ৭৫০ ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৩টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আছেন ১ হাজার ৯৬৮ জন। এছাড়া চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১২ হাজার ৯৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী মারা যায় গত বছর—২৮১ জন। এর আগে ২০১৯ সালে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ২০২০ সালে ৭ জন, ২০২১ সালে ১০৫ জন মারা যান। কিন্তু এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ যে হারে বেড়েছে তা অক্টোবর পর্যন্ত কী প্রকারের মহামারীতে রূপ নেবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে! মৃত্যু,  পরিবার-পরিজনদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে বাতাস! এখনই উপর্যুপরি ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারলে এ সংখ্যা আরও দীর্ঘ হবে! 

যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে তার ৬০ শতাংশই ঢাকায়। এর কারণ নগরীর বিভিন্ন স্থানে নদী-নালার পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি। জলাবদ্ধতার কারণে সেসব স্থানে দ্রুত ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। ইতোমধ্যে ৬০ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ এখনো ডেঙ্গুমুক্ত রয়েছে। তবে যেভাবে ডেঙ্গুর জীবাণু শরীরে প্রবেশ করছে তাতে ভবিষ্যৎ শঙ্কামুক্ত নয়। ঢাকা শহরে দিন দিন রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু যেভাবে এর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে সে অনুযায়ী নেই কোনো উদ্যোগ। কোনো রকমে একটু কীটনাশক ব্যবহার যথেষ্ট নয় বলেই সাধারণের মত। 

 ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নতুবা ডেঙ্গু  মহামারীতে রূপ নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

ডেঙ্গুর চিত্র তাই প্রতি সেকেন্ডেই পাল্টাচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। হাসপাতালগুলোও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। নিরুপায় হয়ে অনেকেই মেঝেতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ চিত্র আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ধরেই। কিন্তু জুলাই-অক্টোবরের জন্য সিটি করপোরেশনগুলোর তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। যখন গণমাধ্যমে অনিয়ম, অবহেলা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ শুরু হয়, তখনই কেবল সিটি করপোরেশনের কিঞ্চিৎ টনক নড়ে৷ পরবর্তীকালে তারা কিছুটা প্রতিরোধ করার জন্য কাজে নিযুক্ত হন। তবু তা একেবারেই যথেষ্ট নয়।  

আমরা জানি, কম থাকতেই যা সহজে নির্মূল করা সম্ভব, যখন তা বৃদ্ধি পায় তা অতিমাত্রায় কষ্টদায়ক। দেশের ৬০টি জেলায় এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। কোন এলাকায় বেশি রোগী সেগুলোও হাসপাতালের নথিভুক্ত। ফলে দুই সিটি করপোরেশন সমন্বিত কার্যকরী উদ্যোগ  নিলে হয়তো এই ডেঙ্গু থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ মিলবে। নতুবা লাশের সারি যেমন দীর্ঘ হবে, তেমনই আক্রান্তের সংখ্যাও কমবে না। তাই এখনই সময়, দ্রুত ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।  

শুধু কীটনাশক ছড়িয়ে এডিস মশা নিরোধ করা সম্ভব নয়। নগরীর অলিতে-গলিতে যেভাবে ড্রেনে, রাস্তায় বৃষ্টির পানি, ড্রেনের পানি জমে থাকে তা এডিস মশার উৎপত্তি স্থল। সেগুলো ধ্বংস না করতে পারলে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়া দায়। 

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবার জটিল হচ্ছে। মানুষ একইসঙ্গে ডেঙ্গুর একাধিক ধরনেও আক্রান্ত হচ্ছে। আর কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, পরিস্থিতির ধারাবাহিক অবনতি হওয়ায় এবার ডেঙ্গুতে বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর গত দুই দশকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বছরের জুলাই মাসের শেষে বা আগস্টের শুরু থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। কিন্তু এ বছর জুলাই মাসের শুরু থেকেই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওই বছরের প্রথম সাত মাসে অর্থাৎ ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮৩৮। আর গত রোববার (৯ জুলাই) এক দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৩৬ জন। এই সংখ্যা এক দিনে হাসপাতালে ভর্তির দিক থেকে (চলতি বছরে) সর্বোচ্চ। 

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণেই  আক্রান্তের আশঙ্কা বাড়ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করতে হবে। ঘরে বা তার আশেপাশে বাতলি, ভাঙা টব বা যেকোনো জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখলে তা দ্রুত ধ্বংস করতে হবে। কারণ আমরা জানি, এডিস মশার উৎপত্তি স্থল ধ্বংস না করতে পারলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া দুষ্কর! রাতে ও দিনে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া মশার ক্রিম, লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে৷ সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ঘরের জানালা বন্ধ করে কিছুটা মশা থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। তবে এজন্য জানালায় নেটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অর্থাৎ নিজেকে আগে সচেতন হতে হবে। পরিবার-পরিজনদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যতটা সম্ভব নিরাপদ থাকার চেষ্টা করতে হবে।

তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ভয়ের কিছু নেই। যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্তের যত্নে প্রাথমিকভাবে করণীয়, তরল জাতীয় খাবার খাওয়া উচিৎ। যেমন- পরিষ্কার জল, আখের রস, ORS, ডাবের জল, লেবুর জল, গ্রীন টি, কমলালেবুর রস ইত্যাদি, দুধ জাতীয় ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিৎ, নিরামিষাশীদের জন্য শাকসবজি ও ফল খাওয়া দরকার, তেল মশলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে, সঠিক পরিমাণ প্রোটিন খাবার খেতে হবে। মাছ, মাংস, ডিম এবং সয়াবিন, চিস,পনির জাতীয় খাবার খেতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি উপকারী তরল খাবার খাওয়া। যতটা পারা যায়, তরল খাবার দিতে হবে। এছাড়া ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। 

প্লাটিলেট কমলে তা দুশ্চিন্তার। দ্রুত ব্যবস্থা নিলে ঝুঁকিমুক্ত থাকা সম্ভব। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে একেবারেই হেলাফেলা নয়। কারণ গত কয়েক বছর এমনকি চলতি বছরের রেকর্ড অত্যন্ত ভয়াবহ! ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নতুবা ডেঙ্গু  মহামারীতে রূপ নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

লেখক: গবেষক ও শিক্ষক



আরো পড়ুন