কবি অতুলপ্রসাদ সেন কবিতাটিতে চির সত্য কথা বলেছেন যে, আমরা বাঙালি জাতি বাংলা ভাষাতে কথা বলে যে তৃপ্তি অনুভব করি, পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষা সে তৃপ্তি বা শান্তি দিতে পারে না। বাংলার প্রকৃতি সম্ভার,নদীর কলতান, পাখি সুমধুর গান,রাখালের বাঁশি, শিশিরের শব্দ এসব কিছুই যেন, আমাদের জন্ম থেকে শুরু করে বাংলাকে ধারণ ও বহন করতে শিখিয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতিটি বর্ণ যেন বাঙালির অবেগ, অনুভূতি প্রকাশের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার।
বাংলা ভাষাতে ব্যবহৃত ১১টি স্বরবর্ণ ও ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ যেন বাঙালির যাপিত জীবনের অন্যতম অলংকার। যা ছাড়া বাঙালি নিজেকে সাজাতে পারে না। বাংলা ভাষা আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের অহংকার। বাঙালি আন্দোলন করে জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ, পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তানের এই দুটি অংশের মধ্যে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও অবস্থানগত আচরণগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালের ২১ শে মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে ঘোষণা করেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’
একই ঘোষণা তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও দেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন সহ সাধারন জনতা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেও জিন্নাহ্ সাহেব তার ঘোষনাই বলবৎ রাখেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও একই ঘোষণা দিলেন। ১৯৫২ সালে এসে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলেন। পূর্ব বাংলার মানুষ এই অন্যায্য সিদ্ধান্তকে আর মেনে নিতে পারেনি। তখনই ফুঁসে উঠলো ছাত্রসমাজ এবং সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ডাকা হয়। সংগ্রাম পরিষদ ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের কর্মসূচি দেয়। পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ভাষার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কর্মসূচি আরও গতিশীল হয়। কিন্তু সব কর্মসূচি বানচাল করার জন্য সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারার নিয়ম ভঙ্গ করে মিছিল বের করে এবং এ মিছিল অল্পসময়ের মধ্যে উত্তাল জনসমুদ্রে পরিনত হয়।মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কারন দেখিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে।পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় রফিক,সালাম, বরকত, আব্দুল জব্বার।
এছাড়া আরও অনেক ছাত্র-যুবক আহত হয়।ঢাকার রাজপথ শহীদদের রক্তে ভিজে ওঠে।ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, শ্রমিক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ দিবস হরতাল পালন করে।২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে এক কিশোরসহ শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করে ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।এত ত্যাগের বিনিময়ে আমরা বাংলাতে কথা বলার অধিকার পেয়েছি।ভাষা আন্দোলন হলো এ জাতির প্রেরণার উৎস।
ভাষা আন্দোলন মূলত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারন তো বটেই তবে এক কথায় বলা যায়, বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই ছিল।যা পরে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯- এর গণঅভ্যুত্থান,১৯৭০ সালের এর সাধারন নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের যে জয়লাভ, যা কিছু অর্জন ছিল তা একুশের চেতনারই বীজমন্ত্র। কিন্তু ভাষার জন্য বাঙালির যে আত্নদান, যে ত্যাগ আজ ৭২ বছর পেরিয়ে আমরা কি আমাদের ভাষার মর্যাদা অটুট রাখতে পারছি? নাকি আমরা আমাদের এই প্রজন্মকে বাংলা ভাষার সঠিক মূল্যায়ন শেখাতে কিংবা মর্যাদার জায়গাটাকে চিহ্নিত করতে দুর্বলতা প্রকাশ করছি। নতুন প্রজন্ম কে আমাদের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানাতে হবে এবং ভাষার গৌরবগাথা নিয়ে গল্প করতে হবে এবং এর চেতনাকে ধারণ করতে শেখাতে হবে।
আমরা আমাদের বাংলা ভাষার চর্চা ও বিকাশ সর্বত্র দেখতে চাই। একটি শিশুর মুখের প্রথম বোল হলো মা। কী দারুন আবেগ আর ভালোবাসা এই বাংলা ডাকে। পৃথিবী এখন ক্ষুদ্র হয়ে সবার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। সময়ের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে ইংরেজির বিকল্প নেই। এখন আারবি, জাপানি, ফরাসি, চাইনিজ, জার্মান ভাষা শেখার চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা অনেক বেড়েছে এবং তৈরি হয়েছে নানা ভাষাশিক্ষা কেন্দ্র। আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী সবই শিখবো তবে বাংলাভাষাকে পাশ কাটিয়ে না। আমরা বাঙালি-বাংলা ভাষার শুদ্ধ ও সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ আমরা শিখবো। সুন্দর ও শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারা একটি শিল্প। এখনকার প্রজন্মকে দেখা যায় বাংলা-ইংরেজি নয়তো বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে বিকৃতভাবে বাংলাভাষাকে ব্যবহার করছে। আমার মনে হয় এর ফলে বাংলাভাষা নাজুক হয়ে একটা বিবর্তনের ও ধ্বংসের পথে হাঁটছে। যা এই জাতির জন্য সত্যিই লজ্জাজনক বিষয়।
এখনকার বাবা-মায়েরা গর্বিত হন যদি সন্তানেরা বাংলায় কথা বলার মাঝে যদি দু-চারটা ইংরেজি মিলিয়ে বলে কিংবা বাংলায় ই কথা বলছে কিন্তু স্বরটা নিচ্ছে ইংরেজির মতো করে। আমার সন্তান যদি অন্য আরেকটি ভাষা জানে কিংবা আয়ত্ব করে তবে সেটা অবশ্যই গর্বের বিষয় কিন্তু বাংলাকে বিকৃত কিংবা অসুস্থ করে দিয়ে নয়। আধো বাংলা আধো হিন্দী কিংবা আধো ইংরেজী দিয়ে কোনো পূর্ণতা আসবে না। এ দেশের উত্থান-পতন,বিদ্রোহ, আন্দোলনের এবং বিজয়ের মাঝেও কবি সাহিত্যিকগণ বাংলাকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা, গান, নাটক উপন্যাস।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন বাংলা ভাষার প্রকৃত গবেষক। ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির পক্ষে যুক্তি ও তথ্যনির্ভর বক্তব্য দেন, যা আন্দোলনে প্রেরণা জোগায়। একুশের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন তিনি।তিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ। মোট ১৮ টি ভাষা জানতেন।কিন্তু সব সময় তিনি মাতৃভাষাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একুশ উপলক্ষ্যে নানা অনুষ্ঠান এবং প্রতি বছর অমর একুশের বইমেলার আয়োজন করে থাকে।আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি একুশের বইমেলার নতুন নতুন মলাটসহ বইয়ের ঘ্রাণ নিতে।কবি সাহিত্যিকগণ জ্ঞানের মশাল সাজিয়ে চারদিক আলোকিত করেন।আমরা সেই আলোকছটা নিয়ে নিজেদের বিকশিত করি। যদি ও গত কয়েক বছর ধরে লেখকদের লেখার মান নিয়ে নানারকম প্রশ্ন উঠেছে। আমার এখানেও মনে হয় লেখকদের বাংলা ভাষার জ্ঞান,দক্ষতা,চর্চার অভাব এ জন্য দায়ী। তবে একটি দুটি মানহীন বইয়ের কারণে আমরা যেন পুরো মেলার সকল লেখককে অসম্মান না করি।
১৯৫২ সালের ভাষা শহিদদের সংগ্রামের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে ঘোষণা করে। দিবসটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রায় পাঁচ হাজার মাতৃভাষাকে সম্মানিত করা হলো।আমরা প্রতি বছর একুশের ভোরে খালি পায়ে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদ ভাষা সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। বাংলা ভাষার প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা।আত্নত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাভাষার মর্যাদা সর্বদা যেন আমরা রক্ষা করতে পারি।
লেখক: ব্যাংকার