'জন্মিলে
মরিতে হবে অমর কে কোথা তবে'! মৃত্যু স্বাভাবিক কিন্তু সেই মৃত্যু যদি ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত
দুর্ঘটনায় তবে কি তাকে স্বাভাবিক বলা যায়? বর্তমানে এদেশে মৃত্যুকূপের অপর নাম সড়ক
দুর্ঘটনা! বিগত কয়ক বছর ধরে প্রতিনয়ত যে হারে সড়কে প্রাণ ঝরছে তাতে করে ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও উদ্বিগ্ন হতে হয়! সত্যি
কি দেখার কেউ নেই! যদি থাকেই তবে কেন সড়কে মৃত্যু কমিয়ে আনা যাচ্ছে না! কেনইবা এতো
এতো মৃত্যু চর্তুদিকে! আর কত মৃত্যু হলে কুম্ভকর্ণদের ঘুমভঙ্গ হবে?
আমরা
জানি, একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না। হয়তো পঙ্গু নতুবা চিরতরে জীবন শেষ! সড়ক দুর্ঘটনার
শিকার যে পরিবার তারই এর মর্ম হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করতে পারেন! তারা আপন জনকে তো চিরতরে
হারিয়ে ফেলেনই পাশাপাশি কখনো পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি তথা অভিভাবকেও হারিয়ে
ফেলেন! বা কখনো তাকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হিসেবে জীবনধারণ করার যাতনা অনুভব করেন!
এর দায় কার?
গত
৯ এপ্রিল বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের স্বাক্ষরিত সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ
তথ্য! এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়েছে, গত মার্চ মাসে সারাদেশে ৬২৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এসব দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৬৮৪ জন। এবং ১৭ এপ্রিল যাত্রী কল্যাণ
সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীর পাঠানো এক প্রতিবেদন মারফত জানা যায়, গত মার্চে
৫৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জন নিহত হয়েছেন। প্রতিবেদনে জানানো হয়, এ সময়ে ১৮১টি মোটরসাইকেল
দুর্ঘটনায় ২০৩ জন নিহত ও ১৬৬ জন আহত হয়েছেন, যা মোট দুর্ঘটনার ৩২.৭৮ শতাংশ। একই সময়ে
রেলপথে ৩৮টি দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত ও ৮৬ জন আহত হয়েছেন। নৌ-পথে সাতটি দুর্ঘটনায় ১৬ জন
নিহত ও ১৭ জন আহত হয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে সর্বমোট ৫৯৭টি দুর্ঘটনায় ৬১২ জন নিহত ও
১৩৩১ জন আহত হয়েছেন। তার তথ্য মতে, প্রকাশিত এই তথ্য দেশে সংগঠিত সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত
চিত্র নয়। এটি কেবল গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য। দেশে সংগঠিত সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ
প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত গণমাধ্যমে স্থান পায় না। তাই এসব তথ্য প্রতিবেদনে তুলে
ধরা সম্ভব হয় না। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রাথমিক উৎসস্থল দেশের হাসপাতালগুলোতে দেখলে
এমন ভয়াবহ তথ্য মেলে। ফলে সড়কের কী বেহাল দশা তা অনায়সেই অনুধাবন করা যায়।
চলতি
মাসে সড়কে জমে উঠছে মৃত্যুর মহোৎসব! এমন কোন দিন নেই যে দিন সড়কে প্রাণ ঝরছে না! বিআরটিএর
ওয়েবসাইটে প্রাকশিত প্রতিবেদনে এখন পর্যন্ত চলতি মাসের প্রতিদিনের দুর্ঘটনার রিপোর্ট
প্রদান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত হিসেব মতে, গত
১ এপ্রিলে বিভিন্ন বিভাগে মোট ১২টা দুর্ঘটনা ঘটেছে এরমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ১২ এবং
৯ জন আহত হয়েছেন ; ২ এপ্রিলে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৪ টা, মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের এবং আহত হয়েছেন
৩৬ জন; ৩ এপ্রিলে দুর্ঘটনা হয়েছে ১১ টা, মৃত্যু
হয়েছে ১২ জনের আর আহত হয়েছেন ৭ জন; ৪ এপ্রিল ২০টা দুর্ঘটনা ঘটেছে এর মধ্যে ২০ জন মারা
গেছেন এবং আহত হয়েছেন ২৫ জন; ৫ এপ্রিল বিভিন্ন বিভাগে ১৪ টা দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত হয়েছেন
এবং আহত হয়েছেন ৭ জন; ৬ এপ্রিল সারাদেশে ১৭ দুর্ঘটনায় ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১৪
জন আহত; ৭ এপ্রিল সারাদেশে ১১টা দুর্ঘটনায় ৭ জনের মৃত্যু ও ৩৬ জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া
গেছে, ৮ এপ্রিলে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০ টা এরমধ্যে ১৯ জন মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ২৫ জন আহত;
৯ এপ্রিল দুর্ঘটনা ২৭, নিহত ২৬ এবং আহত ৩৬ জন; ১০ এপ্রিল দুর্ঘটনা ৯, নিহত ১২ এবং আহত
৩৭ জন; ১১ এপ্রিল দুর্ঘটনা ১৯, মৃত্যু ২১, আহত ২৩; ১২ এপ্রিল দুর্ঘটনা ১১, নিহত ১১
এবং আহত ৭জন; ১৩ এপ্রিল দুর্ঘটনা ১৮, নিহত ২৪, আহত ১৩ জন; ১৪ এপ্রিল দুর্ঘটনা ১৩, নিহত
৯ এবং আহত ২৯ জন; ১৫ এপ্রিল দুর্ঘটনা ১৯, নিহত ২০ এবং আহত ১৪ জন; ১৬ এপ্রিল দুর্ঘটনা
২৪, নিহত ৩৭, আহত ৪৯ জন; ১৭ এপ্রিল ২০২৪ এ দুর্ঘটনা ১৯, নিহত ৩১ এবং আহত ৪১ জন। চলতি
মাসের মাত্র ১৭ দিনে সড়কে তাজা প্রাণ হারিয়েছেন ৩১৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৪০৮ জন! মাত্র
১৫-১৬ দিনে যদি সড়কে ৩১৪ জনের প্রাণ হারাতে হয় তবে বছর শেষে কত জন এর শিকার হবেন তা
কি কেউ হিসেব রেখেছেন! একটি দেশের মানুষ বৃহৎ পরিসরে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় প্রাণ
হারাবেন আর কারো সত্যি ঘুম ভাঙবে না!
মৃত্যুকূপ থেকে পরিত্রাণ পেতে এখনই উপর্যুপরি পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এ ধ্বংসযজ্ঞ কিছুতেই কমবে না! তাই বলতেই হয় সড়কে শৃঙ্খলা আসুক। মানুষ বাঁচুক। পরিবার বাঁচুক। দেশ বাঁচুক।
দেশের
সড়কগুলোতে দুই ধরনের যান চলাচল করে। একটি নিবন্ধিত অন্যটি অনিবন্ধিত। যার ফলে সড়ক হয়ে
উঠেছে মৃত্যুফাঁদ! নিবন্ধন আছে কিনা, ফিটনেস আছে কিনা, রোড পারমিট আছে কিনা এসবের সঠিক
পর্যবেক্ষণ নেই এখনও!
১৮
এপ্রিল প্রকাশিত প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশের সড়কে এখন ছয় লাখের
বেশি যানবাহন চলছে অবৈধভাবে, যাদের হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই। পরিসংখ্যানে এমন ভয়াবহ তথ্য দিলেও
কোন তৎপরতা লক্ষণীয় নয়!
পরপর
দুদিন দুটি বড় দুর্ঘটনার পর সম্প্রতি সড়কে শৃঙ্খলা না থাকার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায়
এসেছে । এর পূর্বে ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা মহা-আন্দোলনে নামে।
তখন সবাই একটু আস্বস্ত হয়েছিলেন হয়তো সড়কের চেহারা ফিরবে! কিন্তু বদল যে কিছু ঘটেনি
তা প্রতিবেদনে প্রকাশিত রিপোর্টে নজর দিলেই সহজে অনুমেয়।
সড়কে
দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে এখনই কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ণ করতে হবে। নতুবা এ অবস্থার
কোন পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা করা বোকামি! সড়কে শৃঙ্খলা আনতে কিছু কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ
করলেই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে অনেকটা পরিত্রাণ মিলবে। প্রথমত মহাসড়কে নিবন্ধনহীন
যানবাহন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। সড়কে ছোট বাহন যেমন: রিক্সা, সিএনজি, অটোরিকশা
নিষিদ্ধ করতে হবে। ট্রেন, বাসের ছাদে কোন মানুষ বহন করা নিষিদ্ধ করতে হবে, ফিটনেসবিহীন
গাড়ি নিষিদ্ধ করতে হবে, যানবাহনের বেপরোয়া গতি কমাতে হবে, সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন বা
রোড মার্কিং নিশ্চিত করতে হবে, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে, পণ্যবাহী যানে মানুষ বহন নিষিদ্ধ করতে
হবে, উল্টোপথে যানবাহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে, সড়কে চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ করতে হবে, রেলক্রসিংয়ের
দায়িত্ব কর্মরত ব্যক্তির সতর্ক দৃষ্টি বাড়তে হবে,
মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত নিশ্চিত করতে হবে ও সড়কে নিয়মিত সেইফটি অডিট
চালু রাখতে হবে। দায়িত্বরত পুলিশ তথা কর্তৃপক্ষকে সড়কে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে হবে।
রাস্তায় যদি নিরাপত্তা না থাকে তবে কী হবে এতো এতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে? এতো পুল,
ব্রিজ, ওভারব্রিজ, কালর্ভাট কী হবে!
উন্নত
বিশ্বের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে বিগত দিনগুলোতে তাদেরও সড়কপথে মৃত্যু খুব বেশি ছিল
কিন্তু এখন তা প্রায় জিরোতে নেমেছে। সড়কে গাড়ির গতিরোধ করে, ফিট যানবাহন দিয়ে, ড্রাইভিং
লাইসেন্স সনাক্ত করার মাধ্যমে কয়েকটি কর্যকরী পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করেছেন। মৃত্যুকূপ
থেকে পরিত্রাণ পেতে এখনই উপর্যুপরি পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এ ধ্বংসযজ্ঞ কিছুতেই কমবে
না! তাই বলতেই হয় সড়কে শৃঙ্খলা আসুক। মানুষ বাঁচুক। পরিবার বাঁচুক। দেশ বাঁচুক।
লেখক: গবেষক ও শিক্ষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়