০৪ মে ২০২৪, শনিবার



নতুন শিক্ষাক্রম: দূর হবে অসুস্থ প্রতিযোগিতা

শারমিন রহমান || ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৩, ১২:১২ পিএম
নতুন শিক্ষাক্রম: দূর হবে অসুস্থ প্রতিযোগিতা


শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। আর পদ্ধতিগত শিক্ষার ভিত্তি হলো শিক্ষাক্রম। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন  হবে, সেটাই মূলত শিক্ষাক্রম। আর পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে দেশের নাগরিকদের খাপ খাইয়ে চলতে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন আবশ্যক।  এরই ধারাবাহিকতার ফল এই নতুন শিক্ষাক্রম। 

তবে, অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না এই নতুন শিক্ষাক্রম। চলছে প্রতিবাদ, মিটিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক পোস্ট, বিকৃত যতসব মন্তব্য।  যে-কোনো উপায়ে হোক এ শিক্ষাক্রমকে তুলে দেবে, এই প্রত্যয় নিয়ে নেমেছে  রাজপথে। এ যেন, ‘কান নিয়ে গেছে চিলে’, আর কানে হাত দিয়ে দেখার সময় কারোরই  নেই। সবাই চিলের পেছনে ছুটছে। বিষয়টা একদম এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। 

একজন ভ্যানচালক, সবজিওয়ালা বা বাড়িতে হেল্পিং হ্যান্ড যিনি আছেন, তিনিও বলছেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিলো’।" আবার অভিভাবকসহ কিছু শিক্ষকও একই সুরে সুর মেলাচ্ছেন।  সারাদেশে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ৩-৪ টি লাইন দিয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সেগুলো হলো: 

১। ডিম ভাজি শিখে আমরা কী করবো? 
২। পরীক্ষা না থাকলে কী পড়ালেখা হয়?
৩। আমার সন্তান কেন ঝাড়ু দেওয়া শিখবে? 
৪। জাতিকে ধ্বংস করতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা।

এমন সরলীকরণ যারা করছেন, তারা মূলত শিক্ষাব্যবস্থার গভীরতা সম্পর্কে বুঝতে অপারগ। তারা পুরো শিক্ষাক্রম থেকে সুবিধামত ১-২টা বিষয়কে নেতিবাচকভাবে  উপস্থাপন করে তর্ক করছেন। বাকিরা সেই চিলের পেছনে দৌঁড়ানোর মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছেন।

বর্তমান শিক্ষাক্রমের রূপকল্পের দিকে খেয়াল করি। রূপকল্প হচ্ছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী,অভিযোজনে সক্ষমসুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা।’ এই রূপকল্পকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর মধ্যে মূল যে  বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো হলো 

১। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক 
২। উৎপাদনমুখী 
৩। অভিযোজনে সক্ষম 
৪। সুখী 
৫। বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা  

রূপকল্প থেকেই স্পষ্ট যে, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ যদি উন্নত বাংলাদেশ হতে চায়, তাহলে যে বিষয়গুলো ভবিষ্যতের নাগরিকদের থাকা প্রয়োজন, সেই বিষয়গুলোকেই নতুন শিক্ষাক্রমে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। উন্নত বিভিন্ন দেশের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা এবং আমাদের দেশের আগের শিক্ষাক্রম বিশ্লেষণ করেই বর্তমান শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। পাইলটিং করে দেখার পরে  এই শিক্ষাক্রমকে  চালু করা হয়েছে। 

বর্তমানে কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৮-৬৫ বছর বয়সের) মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৬৮ ভাগ। এই কর্মক্ষম জনসংখ্যার সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে এটি ৫০/৫০ হয়ে যাবে।  এরপর আমাদের সিনিয়র সিটিজেন বাড়তে শুরু করবে।  তখন অধিকাংশ মানুষ অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এই পরিবর্তন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শুরু হয়ে গেছে। জাপান, তাইওয়ান এই পরিস্থিতিতে আছে বর্তমানে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দ্রুত অভিযোজনক্ষম মানুষ দরকার। যেন তারা পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের অনেক মানুষ অন্য দেশে কাজের খোঁজে যায়।  যেন দেশের বাইরে গিয়ে সেখানে তাদের ভাষা,কাজ ও বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে। অর্থাৎ অভিযোজনক্ষম নাগরিক গড়ে তোলা এই শিক্ষাক্রমের রূপকল্পে রয়েছে। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য এই শিক্ষাক্রম অত্যন্ত জরুরি।

ভবিষ্যৎ যদি কেউ ভাবতে না পারে, বর্তমান সময়ের দিকেই যদি সে  লক্ষ  করে, তাহলে দেখতে পাবে  সনদধারী  শত শত বেকারের সংখ্যা। তাদের হতাশাগ্রস্ত হওয়া এবং নেশায় আসক্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢোলে পড়ার গল্প দেখে, শুনে আমরা কষ্ট পাই। আবার, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে চা বিক্রি করে নিজের পড়ার খরচ চালাতে দেখে বা  পাস করে চাকরির আাশায় না থেকে ফ্রি ল্যান্সিং বা গরুর খামার দিয়ে কোটিপতি হওয়া আত্মবিশ্বাসী যুবকের  গল্প শুনতে আমাদের ভালো লাগে। আমরা যদি একটু ভেবে দেখি তাহলে বুঝতে পারবো আত্মবিশ্বাসী ছেলেটির অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে। কাজের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে। হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করা মানুষের মধ্যে অভিযোজন ক্ষমতা কম। যে-কোনো কাজ করাকে তারা সম্মানহানি মনে করে। ফলে আশানুরূপ কাজ না পাওয়াতে হতাশাগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ঝরে যাচ্ছে সুন্দর জীবন। যারা ডিম ভাজি নিয়ে তাচ্ছিল্য করছে, তারা এই হতাশাগ্রস্তেরই দলভুক্ত। 

একদল মানুষ দেখছে,  ঝাড়ু দেওয়ার প্রয়োজন কী! ডিমভাজি শেখার কী আছে! অন্য একদল মানুষ দেখছে, শিক্ষার্থীরা নিজের হাতে কাজ করে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি সব মানুষকে সম্মান দেওয়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে।  কোনো কাজই ছোট নয়; এই বিশ্বাসটা ভেতর থেকে তৈরি হতে দেখছে। 

যে ছেলে বা মেয়েটা A+ না পেলে বা অকৃতকার্য হলে গলায় ফাঁস দিচ্ছে, যে শিক্ষার্থী প্রশ্নফাঁস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে টাকার লোভে, যে নামকরা ডাক্তার বা বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থী অনেক বছর পর ভুয়া প্রমাণিত হয়ে বাতিল হচ্ছে তাদের অভিভাবকদের কিন্তু এতে খারাপ লাগে না, সম্মানহানিও হয় না। তবে বিদ্যালয়ে ডিমভাজি করলে বা ঝাড়ু দেওয়া শিখলে তাদের সম্মানহানি হয়।

তারাই আবার ২০-৩০ লাখ টাকা খরচ করে অবৈধ উপায়ে হলেও সন্তানকে বিদেশে পাঠায়। সেখানে গিয়ে তাদের সন্তান কৃষিকাজ করে বা হোটেলের থালাবাসন পরিষ্কার করে টাকা পাঠায় দেশে। সন্তান বিদেশে থাকে সেই গর্বে তারাই আবার মাথা উঁচু করে বাঁচে। 

ডিমভাজি  পুরো শিক্ষাক্রমের  জীবন ও জীবিকা বিষয়ের একটা ক্ষুদ্র অংশ  মাত্র।  কিন্তু শিক্ষাক্রম মানেই তাদের কাছে  এখন ডিমভাজি।  কিছুদিন আগে একটি ভিডিও  সবচেয়ে বেশি  ভাইরাল  হয়েছে। ‘ক্লিং ক্লিং সাইকেল চালাই,ফেরিওয়ালা যায়’, কবিতা পড়ানোর ভিডিও। এই ভিডিও শেয়ার দিয়ে  শিক্ষাক্রম নিয়ে বাজে বাজে মন্তব্য চলেছে রকেট গতিতে।  না বুঝে না ভেবেই চলেছে হাজার হাজার শেয়ার ও বাজে মন্তব্য।  পরে দেখা গেলো ভিডিওটি ২০২২ সালের একটি পোস্ট ও ভিডিওটি ভারতের একজন শিক্ষকের। তিনি আনন্দ নিয়ে পাঠদানের জন্য সুনাম কুড়িয়েছেন। তিনি বেশ জনপ্রিয়।  ক্লিং ক্লিং সাইকেল চালাই তাদের পাঠ্য বইয়ের একটি কবিতা। 

এই থেকে স্পষ্ট হয় যে, যারা এই ভিডিও না যাচাই করেই শেয়ার করেছে। শিক্ষাক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এগুলো করছে। যে করেই হোক শিক্ষাক্রমকে ভুল প্রমাণিত করতে তারা সচেষ্ট।  

ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন  দেখে হাজারো শিক্ষার্থী। কিন্তু সবাই কি তার স্বপ্ন ছুঁতে পারে? আপনার সন্তানের জন্য যেটা ভেবে রেখেছেন, তা পূরন হবেই এর নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? স্বপ্নপূরণ না হলেই তাকে হতাশাগ্রস্ত হতে হবে,নেশায় ডুবে যেতে হবে বা সে অযোগ্য হয়ে যাবে বিষয়টি যদি এমন হয়, তাহলে জীবন কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে!

নতুন শিক্ষাক্রম আমাদের হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে সব বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের চেষ্টার পথকে উন্মুক্ত করেছে। অনেকগুলো পথ খোলা থাকবে  শিক্ষার্থীর সামনে।  একপথে সফলতা  না এলে অন্যপথে আনন্দ নিয়ে হেঁটে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হবে। 

নতুন শিক্ষাক্রম পরীক্ষা নেই, এটা সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে মানুষের মধ্যে।  কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যার ওপর সৃষ্ট ধারণা। নতুন শিক্ষাক্রমে একটি শিশুকে প্রতি মুহূর্তে মূল্যায়ন করা হবে। প্রতি ক্লাসে, অধ্যায় শেষে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা মূল্যায়ন করা হবে। হতে পারে মৌখিক, লিখিত বা ব্যবহারিক। সারাবছর পড়ালেখা না করে পরীক্ষার আগে কিছু প্রশ্ন মুখস্থ করে খাতায় লিখে দিয়ে এসে নম্বর পাওয়ার শিক্ষাটা কতটা কাজে লাগে, একটা মানুষের জীবনে  সেটাই বুঝতে পারি না। প্রতিটি কাজে, প্রতি দিন একজন শিক্ষার্থী মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে যাবে।  হাতে কলমে করে দেখবে প্রতিটি বিষয়, এতে শিখন স্থায়ী হবে।  সময়ের মূল্য, অধ্যবসায়, দেশপ্রেম রচনা  মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে এসেছি আমরা। সেটা শুধু পরীক্ষায় নম্বর পেতে।  কিন্তু জীবন দিয়ে সে বিষয়গুলো উপলব্ধি করার সুযোগ আমাদের সময়ে ছিল না। ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্সে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েও ইংরেজিতে কথা বলতে না পারা, ইংরেজি না বোঝা, বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারা মুখস্থ বিদ্যারই কুফল। 

নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের সব কিছু হাতে-কলমে করার সুযোগ তৈরি করেছে। এখানে একজন শিক্ষার্থী তার নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ করার সুযোগ পাবে। গতানুগতিক পরীক্ষা এবং রোল নম্বরের চক্করে অভিভাবকদের মধ্যে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। কার সন্তানের রোল নম্বর ১, কার ৫; এই নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা।  যার সন্তানের রোল ১০ বা ১৫ তারা নিজেদের সম্মানহানি হয়েছে বলে মনে করতেন। তার প্রভাব পড়তো সন্তানের ওপর। শিশু নিজেকে অযোগ্য ভাবতে শুরু করতো। ফলে শিশুর মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতো। 

নতুন শিক্ষাক্রম প্রতিটি শিশুর ভিন্ন ভিন্ন যোগ্যতাকে  তুলে ধরবে এবং প্রশংসা করবে। যেখানে উন্নয়নের প্রয়োজন সেই জায়গাটাকেও চিহ্নিত করবে।  মাছ যদি পাখির সঙ্গে উড়তে পারার যোগ্যতা নিয়ে তুলনা করে, তাহলে মাছ ব্যর্থ। আবার পাখিকে যদি মাছের সঙ্গে সাঁতার কাটা নিয়ে তুলনা করা হয়, তাহলে পাখিও অকৃতকার্য হবে। তাই যার যা যোগ্যতা আছে, তাকে সেই যোগ্যতার জন্য প্রশংসা করা উচিত।  সেটাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করা উচিত। নতুন শিক্ষাক্রম প্রতিটি শিশুর নিজস্বতাকেই তুলে ধরবে। আর  সমাজ থেকে অসুস্থ প্রতিযোগিতা দূর হবে।

পরিবর্তন এলে সবাই সহজেই মেনে নেবে; বিষয়টি এমন নয়। সব ভালো কাজেই সবাই সঙ্গে থাকবে; তাও নয়। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কেউ থাকতো না।  তাই নতুন শিক্ষাক্রমকে সহজেই সবাই ভালোভাবে নেবে এটা আাশা করাও ভুল। তবে, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা নিজেকে প্রমাণ করবে আপন আলোয় সেই প্রত্যাশা শতভাগ করি। 

লেখক: শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক 



আরো পড়ুন