১৮ মে ২০২৪, শনিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

আমার লারাম ভাই

সৈয়দা আমিনা ফারহিন || ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩, ০৭:৩২ পিএম
আমার লারাম ভাই


‘আমার প্রথম ট্রেকিং লারাম ভাইকে দিয়ে শুরু’দাইফ বলছিল। দাইফের আরেক নাম মুকীত।  পুরো লেখায় দাইফকে মুকীত নামে সম্বোধন করবো।

মুকীতের ট্রেকিং গুরু মারুফ-বিন-আলম। তিনি বাংলাদেশের প্রথম সবোচ্চ পর্বত তাজিংডং আবিষ্কারকদের একজন। তিনি কিশোরদের তাজিংডংয়ে নিয়ে যাবেন বলে কয়েকজনকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরে মুকীত, ফয়সাল, মুসাবাংলাদেশের এই তিন কিশোর, যারা প্রথম তাজিংডং পর্বত আরোহন করেন। সময় নব্বইয়ের দশক। সে হিসেবে আমার জীবনসঙ্গী প্রথম কিশোর, যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত আরোহন করে। বিষয়টি নিয়ে আমার একটা প্রচ্ছন্ন অহঙ্কার কাজ করে। আর তাদের সঙ্গে  যান মারুফ ভাই। সম্পর্কে তিনি আমার ভাসুর। আর লাল রামচরণ বম, মানে লারাম ভাই। 

মুকীতের সঙ্গে লারাম ভাইয়ের প্রথম দেখা হয় রুমায়। এরপর অনেকটা স্বপ্নের মতো সময় চলে যায়। লারাম ভাই মাঝে-মাঝে ঢাকা আসতেন। মারুফ ভাইয়ের আম্মু (মাহমুদা আলম খালা) লারাম ভাইকে খুব আদর করতেন। মাহমুদা আলম খালা ছিলেন ভিকারুননেছা নূন স্কুলের ইংলিশের টিচার। মুকীত যখন ক্লাস নাইনে পড়ে, একদিন খুব জ্বর। বারবার বগা লেক, লারাম ভাই, চাচা মানে লারাম ভাইয়ের বাবা, অনু (অনু মানে ভাবী)-র  কথা বলছিল। হঠাৎ আলো খালা এসে বললেন, ‘এই এই দেখ! কে এসেছে!’ মুকীত ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে লারাম ভাই। লাফ দিয়ে লারাম ভাইকে জড়িয়ে ধরে। তাঁকে দেখে মুকীতের জ্বর শেষ। 

সকালে লারাম ভাইকে নিয়ে খিলগাঁও ঘুরতে নিয়ে গেলো, তালতলা মার্কটেও গেলো। লারাম ভাই মুকীতকে বললেন, ‘এক বাড়ির সাথে এক বাড়ি লাগানো। এখানে তো ঈশ্বরও থাকে না।’

মামুনিকে মুকীত বলে দিয়েছিল, আলাদা করে কাঁচা মরিচ দিতে। লারাম ভাই কয়েক লোকমাতেই সব মরিচ খেয়ে ফেলেছিলেন। খাওয়া-দাওয়ার প্রতি তাঁর আকর্ষণ নেই। পরদিন মামুনি পোলাও, বড় রুই মাছ রান্না করলেন। লারাম ভাই খুব তৃপ্তি নিয়ে রুই মাছ খেয়েছিলেন।  

তারপর থেকেই মুকীত বাড়ি থেকে পালিয়ে বগালেক চলে যেতো। মারুফ ভাই নেতৃত্ব দিতেন। তখন বান্দরবানে একটাই বাস যেতো। ডলফিন। বান্দরবান থেকে চাঁদের গাড়ি করে রুমা ঘাট। সেখান থেকে ট্রলারে করে রুমা বাজার। এরপর বগামুখ পাড়া হয়ে ট্রেকিং করে বগালেক। বগামুখ পাড়া থেকে দু'টি রাস্তা। একটি বগালেক, আরেকটি সাইকত পাড়া।  রাতে পৌছে মারুফ ভাই ডাক দিলেন। 

লারাম ভাই বলেছিন, ‘স্বয়ং ঈশ্বর যেন ডাক দিয়েছেন।’ 

পরদিন খুব ভোরে চাচা, মানে লারাম ভাইয়ের বাবা শিকারের জন্য বন্দুক নিয়ে যাচ্ছিলেন। 

মুকীতদের আরেক সঙ্গী আলী চিৎকার দিয়ে বলছিল, ‘শান্তি বাহিনী, শান্তি বাহিনী।’ 

লারাম ভাই এসে বললেন, ‘এখানে ঈশ্বর ছাড়া কারও কোনো শক্তি নেই যে, তোমার কোনো ক্ষতি করবে।’  

এরপর মুকীতকে নিয়ে খরগোশ শিকারে গিয়েছেন। ওকে জুম চাষে পানি দিতে নিয়ে যেতেন। বাড়ি ফিরে মামুনির হাতের ঝাটার বাড়ি, বড়মামার বাসায় তার আশ্রয়-প্রশ্রয়, কত স্মৃতি!


এরপর কত সময় চলে গেলো। চারদিনের জ্বরে মামুনি পৃথিবী ছেড়ে অন্যজগতে চলে গেলেন। কিশোর মুকীত। মমতাময়ী মাকে হারিয়ে বগালেক, কখনো বাসে উঠে উদ্দেশ্যহীনভাবে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছে। বগালেকে লারাম ভাই, সিয়াম দি, চাচা, চাচি তাকে আগলে রাখতো। মুকীতের আরেক ঘর হয়ে উঠলো বগালেক। এই বগালেকের কারণে মুকীত কখনো পথভ্রষ্ট হয়নি। খুব ভালোভাবে পড়ালেখা শেষ করে ট্যালেন্টেড ইঞ্জিনিয়ার, সঙ্গে ব্যবসা। মুকীত আজকে যা, তাঁদের অবদান কম নয়।

আর আমি? মুকীতের কাছে ওদের গল্প শুনতে শুনতে কবে ওদের দেখতে পাবো সেই আশায় থাকতাম। প্রথম যখন বগালেকে গেলাম, লারাম ভাই একটা খাসি দিয়ে পুরো পাড়াবাসীকে খাওয়ালেন। এত নির্মল আনন্দ খুব কম পেয়েছি জীবনে। মুকীতকে ওরা নিজের ছেলে করে নিয়েছিলেন, আমাকে ছেলের বউ। তাঁদের সুখ-দুঃখে ওঁৎপ্রোতভাবে মিশে গেছি। পাহাড় সম্পর্কে মানুষ যা জানে, তার চেয়ে অনেক কাছে থেকে মিশেছি এসব সহজ সরল মানুষদের সঙ্গে। বগালেকটা আগে ভালোই ছিল। সভ্যতার স্পর্শ পেয়ে মানুষের মধ্যে মোহ-লোভ ঢুকে পড়ে। অনেকদিন ধরে বগালেকের জন্য লড়ে যাওয়া মানুষটা অস্ত্র ছেড়ে স্বাভাবিক জীবন, জুমে আদা চাষ, গাইড হয়ে গিয়েছিলেন। এখানে আমার আরও আপনজন আছেন। সিয়াম দি, রবার্ট, লাল কিম, অনু, নকীব, লারাম ভাইয়ের মেঝো ছেলে এন্থনী (এটা আমার একটা লক্ষী বাচ্চা), আলেকজান্ডার, হাই মুকীম (মুকীতের সঙ্গে মিলিয়ে লারাম ভাইয়ের ছোট ছেলের নাম), চাচা, চাচি, দাদা, আমার মেয়ে জ্যাকুলিন।  সবাই আমার আত্মার আত্মীয়।

লারাম ভাইকে এ ফেব্রুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখে কারা যেন অপহরণ করে নিয়েছিল। আজকে হারমেন পাড়াতে তার গলিত লাশ পাওয়া গেছে। আমার অশ্রু বাঁধ মানছে না। লারাম ভাই এখন ডোম ঘরে, অনু হাসপাতালে বসে অপেক্ষা করছেন। আমার ডাইনিং রুমে লারাম ভাইয়ের দেওয়া জুমের মধুর বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। আর লিখছি।

লারাম ভাইয়ের পরিচয় দেওয়া হচ্ছে হোটেল ব্যবসায়ী। আসলে কি শুধু তাই? একটা ইতিহাসের অবসান হলো। বান্দরবানকে বাংলাদেশের কাছে জনপ্রিয় করা, ট্রেকিংয়ের রুট (route) আবিষ্কার করা বোকা, পাগল মানুষটার পরিচয় আমার কাছে, মুকীতের কাছে, মারুফ ভাই, গোটা ট্রেকিং পাগল মানুষগুলোর কাছে একটা ‘লিজেন্ড’!

কিছু মানুষ আছে সারাজীবন অন্য মানুষের মাঝে বেঁচে থাকেন। লারাম ভাই আমাদের তেমন আপনজন!



আরো পড়ুন