২৫ জুন ২০২৪, মঙ্গলবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

আমার ‘জয়িতাজয়ী’ মা: অনুপ্রেরণার বাতিঘর

শারমিন রহমান || ১২ মে, ২০২৪, ১১:০৫ এএম
আমার ‘জয়িতাজয়ী’ মা: অনুপ্রেরণার বাতিঘর


আমার মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব বেশি ভালো ছিল না অথবা মায়ের ভূমিকা খুব বেশি টের পাইনি, যতদিন বাবা  বেঁচে ছিলেন। মাকে বরাবর রাগী, কড়া মানুষ হিসেবেই দেখেছি। পড়ালেখার বিষয় মা-ই দেখতেন। তাই মা  নয়, বাবাই প্রিয় মানুষ ছিলেন। বাবা বকেন না, যা চাই তাই এনে দেন। আর মা বোঝান সংসারের কষ্ট বুঝতে হবে তো! অভাব না বুঝলে সন্তান মানুষ হয় না। বাবা-মার মধ্যে তর্ক এই নিয়ে। মাকে তখন  সিনেমার খলনায়িকাই মনে হতো। বেড়াতে যাওয়ার দরকার নেই সামনে পরীক্ষা, রেজাল্ট কেন ভালো হলো না? এত টিভি দেখার কী আছে? সমাজ সংসার বোঝাতে চাইতেন। 

আমি তখন ফড়িং অথবা দোয়েলের জীবনের মতো মুক্ত, স্বাধীন! জীবন আমার কাছে রঙিন, সবুজ। মনে হতো সবার মা আমার মায়ের থেকে বেশি ভালো৷ টিভি দেখলে রাগ করেন না। নানু বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ১৫ দিনও থাকেন। আর আমার মা শুধু পড়া পড়া করেন। একরাত নানুবাড়ি গিয়ে নিজেও থাকেন না, আমাদেরও যেতে দিতে চান না।

কিন্তু, হঠাৎ আমার বাবা  যেদিন কোনো কিছু বোঝার আগেই  পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন, সেদিন চারপাশের চেনা মানুষ এমনকি চেনা পরিবেশ, মায়া, স্নেহ; সব বদলে গেলো; সেদিন বুঝলাম আমার সেই সিনেমার খলনায়িকা মায়ের অবদান আমাদের জীবনে কতটা! একটা জীবনের পুরোটাই নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে আমাদের জীবনকে আলোকিত করেছেন আমার মা। এখনো করে যাচ্ছেন।  একজন মানুষ এত বেশি আত্মত্যাগ করতে পারেন, তা আমার মাকে না দেখলে  অজানাই থেকে যেতো। বাবা মারা যাওয়ার পর অর্থনৈতিকভাবে এতটাই খারাপ অবস্থা হয়ে যায় যে, আমাদের জীবন চলাই দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। কাছের মানুষগুলো দূরের হতে হতে আবছা মূর্তি হয়ে যায়৷ একজন শিক্ষক হয়েও আমার মা কখনো দর্জি, কখনো মুরগী-হাঁসের খামারের মালিক, কখনো টিউটর, কখনো সবজি চাষি হয়েছেন। তবু আমাদের গায়ে আঁচ লাগতে দেননি। কত অল্প টাকায় সংসার চালানো যায়, তা আমার মায়ের থেকে দেখা আমার। 

কোনো টাকা নেই; তবু সব চলছে। আমার মায়ের সুপার পাওয়ার আছে। ভাত কম থাকলে তার ক্ষুধা লাগে না, গ্যাস হয়। অথবা  তার অনেক জামা কাপড় আলমারি ভরা, তার লাগেই না কিছু। সেগুলো শুধু আমরা দেখতে পাই না। আমাদের চার ভাই-বোনকে মাছ খাওয়ানোর জন্য তার লেজ যে কখন প্রিয় হয়ে গেলো, বুঝিনি। আমরা জানতাম  মা মাছের লেজ ছাড়া খান না। প্রথম দিকে লেজই তুলে রাখতাম মায়ের প্রিয় বলে। পরে বুঝলাম মাছের লেজের কাটা বেছে খেতে আমাদের কষ্ট হবে বলে মায়ের লেজ প্রিয় হয়ে গেছে। সারাক্ষণ আমাদের প্রিয় খাবার রান্না  করতে করতে যে মানুষটি নিজের পছন্দ আজ আর মনে করতে পারেন না, তিনি আমার মা। 

আমাদের যে খাবারটা প্রিয় সেটা তার পুরপুরি অপছন্দের। বলবে, আরে এটা কোনো খাবার। অনেক দেরিতে হলেও বুঝেছি আমার মা না খেলে ওই খাবারটা আমরা আরেকবার খেতে পাবো, বলেই সেটা তার অপ্রিয় খাবার। বাবা নেই কিছুদিন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার দিন কাছে চলে আসছে, টাকা নেই। কী করবো! মায়ের চুড়ি আর কানের দুল খুলে দিলেন আমাকে। সোনার দোকানে জমা দিয়ে আমার ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। আমার মেসের  চারতলায় সবজি, মাছ, চালের বস্তা  টেনে নিয়ে ওঠাতেন মা। আগে জানালে আমার ব্যাগ টানতে কষ্ট হবে বলে না জানিয়েই চলে আসতেন। 

এই আমার মা!

এখনো লিখতে বসলে বা ঘুমিয়ে থাকলে কোনো শব্দ না করে চুপিচুপি উঠে কাজ করতে থাকেন, যেন টের না পাই। আমাদের ঘুম বা পড়ায় কোনো ব্যাঘাত না হয়।  আমার মা তার জীবন সংগ্রামে এক সুপার উইমেন। বুক দিয়ে সামলেছেন সকল ঝড়। শিক্ষকতা পেশায় তিনি রেখেছেন অনন্য অবদান। শিক্ষকতা পেশা, সন্তানদের সফলতা; সর্বোপরি তার সংগ্রামর জীবনের জন্য পেয়েছেন ‘জয়িতা’ পুরস্কার।  এত কিছুর পরেও আমার মা এই ৫৯ বছর বয়সে এসেও নিজের গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন সফলভাবে। আমার মা এক অনুপ্রেরণার বাতিঘর। 

অনেক ভালোবাসি মা। তুমি আরও অনেক অনেক বছর আমাদের আগলে রাখো এভাবেই। তুমি আছ বলেই এখনো টিকে আছি, বেঁচে আছি তোমার মুখের দিকে তাকিয়েই।

পৃথিবীর সকল মা’কে শ্রদ্ধা জানাই।
ভালো থাকুক  পৃথিবীর সব মা।



আরো পড়ুন