০৫ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার



শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন মেনে নিন

মো. শাহ জালাল মিশুক || ০২ জুলাই, ২০২৪, ০২:০৭ পিএম
শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন মেনে নিন


সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চালুর দাবিতে গতকাল ১ জুলাই থেকে সব অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজ থেকে বিরতিতে আছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনভুক্ত দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর ফলে সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে। 

গতকাল থেকে বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করলেও গত অনেকদিন ধরেই, শুরুতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি, অর্ধদিবস কর্মবিরতি এবং পরে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি (পরীক্ষা আওতামুক্ত) পালন করে আসছে। কিন্তু এই আন্দোলনের সময় কতজন শিক্ষক তাঁদের চিন্তা ও কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে পেরেছিলেন? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, কর্মবিরতিতে থেকেও পরীক্ষার খাতা পরীক্ষণ কিংবা গবেষণা শিক্ষার্থীর তত্ত্বাবধান তাঁরা বন্ধ রাখেননি।পাশাপাশি যখন একজন শিক্ষার্থীর রেজাল্ট কিংবা পাস করে যাওয়ায় বিঘ্ন ঘটে তখন কোনো শিক্ষকই আন্দোলনে থাকেননি। কিংবা শিক্ষকরা তাদের নিয়মিত কাজ, প্রবন্ধ লেখা/গবেষণা কাজও থামাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে শিক্ষকেরা জানেন যে, শিক্ষকতার কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টায় নির্ধারিত নয়, বরং তা চব্বিশ ঘণ্টা। কারণ শিক্ষকদের শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রশাসনে এবং গবেষণা কাজ করেন। শিক্ষার্থীর যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো সময় নানা রকমে সাহায্য করেন। সে-সব কাজগুলো শিক্ষক আনন্দের সঙ্গেই করেন, ঢোল পিটিয়ে তার জন্য বাহবা আকাঙ্ক্ষা করেন না। শুরু থেকেই যখন আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ব্যহত হয়নি, তখনই যদি এই দাবিগুলো মেনে নেওয়া হতো কিংবা মেনে নেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা কাজ করতেন, তাহলে হয়তো আজ এমন সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে শিক্ষকদের যেতে হতো না।

একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, অষ্টম পে-স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চরমভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়। কারণ, আমলাতন্ত্রের প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনের ধাপ সুকৌশলে কমিয়ে দেওয়া হয়। ৭ম পে-স্কেল পর্যন্ত সচিব ও পুলিশ প্রধানসহ শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের সমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা বেতন পেতেন। কিন্তু অষ্টম পে-স্কেলে বেতনের পূর্ববর্তীধাপগুলো ঠিক রেখে সুপিরিয়র একটি ধাপ সৃষ্টি করা করা। সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করে সচিবসহ অন্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের তুলনায় তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নেন। এতদিন সচিবসহ অন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের সমান বেতন পেলেও তাদের এই নতুন পদ সৃষ্টির ফলে তাদের বেতন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। তাই, এমন অবনমন থেকে নিজেদের সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে স্বতন্ত্র পে-স্কেল ও সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তির দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু আজ অবদি সেই দাবি মেনে নেওয়া হয়নি। ফলে বেতনবৈষম্য দূর করতে হলে সবার আগে এই ক্ষেত্রে সংস্কার করা প্রয়োজন।

এখন আসি সর্বজনীন পেনশনে প্রত্যয়’ স্কিমের বিরোধিতা কেন? গত বছরের আগস্টে চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশনে নতুন প্রত্যয় স্কিম যুক্ত করেছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। গত ১৩ মার্চ এ নিয়ে দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপনে প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। ২০ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন এ স্কিমের বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে।

প্রজ্ঞাপন ও বিজ্ঞপ্তির তথ্যানুযায়ী, আগামী ১ জুলাই বা তার পরে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার চাকরিতে যারা যোগদান করবেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত করা হবে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এর অন্তর্ভুক্ত হবে।

প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন জারির পরপরই এটি নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। শিক্ষকদের যখন দেখলো, প্রত্যয় স্কিম কার্যকর হলে যেসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করবেন, তাদের আর্থিক সুবিধা কমে যাবে অনেকাংশেই এবং পেনশনের পর এককালীন টাকা পাওয়া যাবে না, বছর বছর পেনশন বাড়বে না। পেনশনের মনোনীত ব্যক্তি এখনকার মতো আজীবন পেনশন পাবেন না। বাংলাদেশে কখনো কোনো পেশায় সুযোগ-সুবিধা সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে কমেছে এমনটা কেউ শোনেনি। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমের মাধ্যমে শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা কমবে। তাই, প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন জারির পরপরই এটি নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। 

শিক্ষক নেতারা জানান, বর্তমানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার। কর্মকর্তা রয়েছেন ৩০ হাজারেরও বেশি। কর্মচারীসহ সবমিলিয়ে এ সংখ্যা প্রায় চার লাখ। অথচ সরকারের অন্য চাকরিজীবীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের ক্ষেত্রে আগের নিয়মেই পেনশন ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে। অন্যদিকে এটি যেহেতু সর্বজনীন পেনশন, তাহলে এটা তো সবার জন্যই প্রযোজ্য হওয়া উচিত। সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে বৈষম্য ও অসন্তোষ বাড়বে। অবসরকালীন নিশ্চয়তা একই রকম না থাকলে আগামীতে মেধাবীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসতে নিরুৎসাহিত হবেন।

সরকারের তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগ এই স্কিমের আওতাভুক্ত নয়। যে কারণে এই স্কিমকে কোনো অর্থেই সর্বজনীন বলতে নারাজ শিক্ষকরা। শিক্ষকদের যুক্তি, এই পরিকল্পনা যদি এতই ভালো তাহলে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগ এর বাইরে থাকবে কেন? এ ছাড়া বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষকরা অবসরকালে তাদের অভোগকৃত ছুটির একটি অংশ নগদায়ন বা টাকায় পরিণত করতে পারেন, যার সুযোগ প্রত্যয় পরিকল্পনায় নেই। পাশাপাশি বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর চাকরি করলেই একজন শিক্ষকের পরিবারের সদস্যরা নির্ধারিত হারে মাসিক পেনশন প্রাপ্য হন, যা নতুন প্রত্যয় পরিকল্পনায় নেই। নতুন পরিকল্পনায় এই সময় ১০ বছর। শিক্ষকরা মনে করছেন, এতে তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ ছাড়া পেনশনভোগীর উত্তরসূরি নির্ধারণ নিয়েও অনেক জটিলতা রয়েছে। যা নিয়ে শিক্ষকরা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও শঙ্কায় ভুগছেন। একইসঙ্গে প্রত্যয় পরিকল্পনায় আরেকটি বিষয় খুবই অস্পষ্ট। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি পদোন্নতি এক একটি সম্পূর্ণ নতুন নিয়োগ। তাই প্রশ্ন হলো—একজন শিক্ষক যখন সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক হবেন, সেটা তো নতুন নিয়োগ। তাহলে কি তখন ওই শিক্ষক স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রত্যয় স্কিমে চলে যাবেন? এ প্রশ্নের উত্তর শিক্ষকরা জানেন না।

ঈদুল আজহা ছুটি শেষে খুলেছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এতে ক্যাম্পাসে ফিরেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তবে ক্যাম্পাসগুলো খুললেও ক্লাসে ফিরতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিম বাতিলের দাবিতে অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এমন কর্মসূচিতে আশঙ্কায় দিক কাটছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর। কারণ দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এখনো করোনার ধকল কাটিয়ে ‍উঠতে পারেনি। করোনায় দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট তৈরি হয়েছে। তা কাটিয়ে ওঠার আগেই শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছেন। শিক্ষকদের এমন আন্দোলন সেশনজট বাড়িতে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা।

মোদ্দাকথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি স্বতন্ত্র পে-স্কেল ও সুপারগ্রেড প্রদানসহ শিক্ষকদের জন্য প্রত্যয় স্কিম বাতিল করা এখন সব স্তরের জনসাধারনের দাবি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সেশনজট, অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার ফলে বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার মান সমুন্নত রাখতে এবং মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসতে সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সুবিধা অবশ্যই বাড়াতে হবে।  

এ কথা অনস্বীকার্য যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বদা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষকদের সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই নীতিনির্ধারকদের কাছে, আমাদের অনুরোধ, শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবিগুলো মেনে নিন। একইসঙ্গে অতিদ্রুত আন্দোলনরত শিক্ষকদের শ্রেণীকক্ষে ফেরার সুযোগ করে দিন। 

লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, শিক্ষক সমিতি, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়



আরো পড়ুন