১৮ মে ২০২৪, শনিবার



হিজাবে কড়াকড়ি ও ইরানি নারীদের দুর্ভাগ্য

নুরজাহান নুর || ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ১২:০৯ পিএম
হিজাবে কড়াকড়ি ও ইরানি নারীদের দুর্ভাগ্য


কট্টরপন্থী ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে একটি ইরান। নারী স্বাধীনতার পক্ষে নয় ইরানের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও সরকার। তাই তো এই দেশে হিজাব নিয়ে এত তোলপাড়। হিজাব সঠিকভাবে না পরার অপরাধে এক নারীকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া, অতঃপর পুলিশ নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। যদিও এমনটা মোটেই কাম্য নয়। যেই ইরানে হিজাব না পরার অপরাধে ২২ বছর বয়সী মাসা আমিনিকে পৃথিবী ছাড়তে হলো, সেই ইরানেও একসময় হিজাব নিষিদ্ধ ছিল। বর্তমানে ইরানের নারীদের হিজাব আন্দোলনের বিষয়ে কথা বলার আগে ইরানের হিজাব নিষিদ্ধ প্রথা ও হিজাব প্রথার অতীত ইতিহাস আগে একটু ঘুরে আসা যাক।  

১৯৩৬ সালে ইরানের রাজা শাহ পাহলভি বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধ করেছিলেন। যদিও এর আগে ইরানের কলেজ ও স্কুলে হিজাব পরা নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৯ সালের আগে ইরানে পাবলিক প্লেসে নারীদের পশ্চিমা পোশাকে দেখা যেতো। ওই মহিলারা জিন্স, স্কার্ট ও টি-শার্ট পরতেন। অর্থাৎ তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। নারীদের নিজের শরীরে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পোশাক পরতে পারতেন। যদিও এই সময়ে ইসলামি মৌলবাদীরা এর বিরোধিতা করেছে। নারীদের পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা থাকা উচিত এই সত্যটি তারা কখনোই মেনে নেননি। কিছু ইরানি নারীও তখন এই আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে হিজাব পরতেন। হিজাব তখন রাজার বিরোধিতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ইরানের নারীরা ভাবতেই পারেননি যে, একসময় হিজাব তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। 

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হয়। এসময় হিজাব নিয়ে কড়াকড়ি থাকলেও ১৯৮৩ সাল থেকে ইরানে হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০০৫ সালে ইরানে পুলিশের একটি বিশেষ শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। নাম দেওয়া হয় নৈতিকতা পুলিশ। ইরানে তাদের বলা হয় গাশত-ই এরশাদ (গাইডেন্স পেট্রল)। পুলিশের এই বিশেষ ইউনিটের দায়িত্ব-ইসলামিক নৈতিকতার সম্মান নিশ্চিত করার এবং পোশাকবিধি অনুসরণ না করা ব্যক্তিদের আটক করার। শরিয়ার ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তৈরি করা আইনের অধীনে একজন নারীকে তাদের চুল ঢেকে রাখতে হয় এবং লম্বা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হয়। আর আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় নৈতিকতা পুলিশের ওপর।

মাসা আমিনিকে গ্রেপ্তার করে এই নৈতিকতা পুলিশ। মাসার অপরাধ ছিল তিনি হিজাব সঠিক নিয়মে পরেন নি। হিজাব পরার পরও তার চুলের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল। আর এর জেরেই তাকে গ্রেপ্তার করে নৈতিকতা পুলিশ। গ্রেপ্তারের তিন দিন পরেই পুলিশ হেফাজতে মাসা আমিনির রহস্যজনক মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর খবর খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে নেট দুনিয়ায়। আর মাসার মৃত্যুর পরেই উত্তাল ইরানের নারীরা অভিযোগ রয়েছে, গ্রেপ্তারের পর তাকে অকথ্য নির্যাতন করে পুলিশ। মাসার পরিবারের দাবি, পুলিশ তাকে ,মাথায় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আঘাত করে। কিন্তু কর্তিপক্ষের দাবি, মাসা আগে থেকেই অসুস্থ ছিল। করতিপক্ষের এমন বক্তব্যে আরও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মাসার মৃত্যু ঘিরে এই আন্দোলনের ফলে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর সবচেয়ে মারাত্মক অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়ে দেশটি।

১৯৭৯ সালের আগে যেখানে নারীরা হিজাব পরার পক্ষে আন্দোলন করেছে, সেখানে আজ, এই একুশ শতকে এসে তাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে হিজাব প্রথার বিরুদ্ধে। ইরানের নারীরা তাদের হিজাব পুড়িয়ে আন্দোলন করছে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে সবাই। নারীদের সঙ্গে ইরানের পুরুষরাও এসে যোগ দিচ্ছেন এই আন্দোলনে। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই চাচ্ছেন পোশাকের স্বাধীনতা। অবশ্য এই নৈতিকতা পুলিশও তাদের ওপর সরকারের দেওয়া দায়িত্ব পালনে কার্পণ্য করছেন না। আন্দোলনে অংশগ্রহনকারীদের গ্রেপ্তার করছেন, আন্দোলনে অংশ নেওয়া পুরুষদের মেরে ফেলছেন, আন্দোলন চলাকালীন কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ছেন। জলকামানও ব্যবহার করছেন। বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, এই আন্দোলনে ইরানের ৫০০ এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে, সরকার এই সংখ্যাকে ৩০০ তে নামিয়ে আনে। কিন্তু তাতেও দমে যান নি ইরানের নারীরা। অব্যাহত রেখেছেন হিজাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন। 

ইরানের নারীদের হিজাববিরোধি আন্দোলন বহু পুরনো। ১৯৭৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত হিজাবের বিরুদ্ধে ইরানে অসংখ্য আন্দোলন হয়েছে। ২০০৬ সালে ১০ লক্ষ সাক্ষরের একটি পিটিশন দাখিল করা হয় হিজাবসহ সকল আইন যা নারীদের সমতায় বাধা তা বাতিলের জন্য। ২০১৪ সালেও অসংখ্য নারী জনসম্মুখে নিজেদের হিজাব খুলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এটি একটি অনলাইন প্রটেস্ট ক্যাম্পেইন ছিল নারী জাগরণের। ইতোপূর্বে সব আন্দোলন সরকার কঠোর হাতে দমনও করেছে। তরুণ ডাক্তার ফরহাদ মায়েসামি ২০১৮ সাল থেকে জেল খাটছেন নারী আন্দোলনের সমর্থন দেওয়ার জন্য।

তবে, মাসা আমিনির মৃত্যুর পর ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ এই স্লোগানে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ইরানের নারীরা। ইরানের নারীদের এই আন্দোলন শুধু হিজাবের বিরুদ্ধে নয়, নারী স্বাধীনতার পক্ষে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানের যুগে নারীদের হিজাবের মধ্যে আবদ্ধ রাখার বিপক্ষে। যার ইচ্ছা হবে সে হিজাব পরবে, যার ইচ্ছা হবে না সে পরবে না। অর্থাৎ পোশাকে নারীরা অবধারিত বা চাপিয়ে দেওয়া মেনে নিতে পারছেন না। নারীর নিজের শরীরে নিজে কী পরিধান করবে তার সিদ্ধান্ত একমাত্র তার হোক, এই নিয়েই ইরানের নারীদের এই আন্দোলন। 

ঐতিহ্যগতভাবে ইরানে ইসলামিক দণ্ডবিধির ৩৬৭ ধারাকে হিজাব আইন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এই আইন ভঙ্গ করলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ১০ দিন থেকে ২ মাসের কারাদণ্ড  দেওয়ার বিধান রয়েছে। সঙ্গে জরিমানা করা হতে পারে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ ইরানি রিয়াল। কিন্তু মাসা আমিনির মৃত্যুকে ঘিরে গণআন্দোলনের পর হিজাব আইন আরও কঠিন করার কথা ভাবছে সরকার। নারীদের কোনঠাসা করার সব উপায় যেন প্রয়োগ করছে ইরান সরকার। ইরানের প্রতিটি রাস্তায়, অলিগলিতে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। নারীদের সার্বক্ষনিক গতিবিধির ওপর নজর রাখতেই তাদের এই আয়োজন। মূলত চুল না ঢেকে চলাফেরা করা নারীদের অর্থাৎ হিজাব না পরা নারীদের শনাক্ত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনতেই বসানো হয়েছে এই নজরদারি ক্যামেরা। এমনকি হিজাব না পরা নারীদের শনাক্ত করতে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাও ব্যবহার করার কথা ভাবছে দেশটি। তারকা ও ব্যবসায়ীরাও নিস্তার পাবেন না এই নিয়ম থেকে। 

ইরানের নারীদের এই বিক্ষোভ অনেকদিনের। নৈতিকতা পুলিশের অনেক দমন-পীড়নও একদম স্তব্ধ করতে পারে নি। কিন্তু নতুন নতুন আইন তৈরি করে নারীদের তাদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে এই দেশ। দেশের সরকার এখনো নারীদের মানুষ বলে ভাবতে পারে নি। নারীদেরকে তারা এখনো দমিয়ে রাখতে চায়। রুদ্ধ করতে চায় নারীদের কণ্ঠস্বর। শিকল পরাতে চায় নারীদের হাতে পায়ে। মস্তিষ্ক অচল করে দিতে চায় মাথায় হিজাব চাপিয়ে। কবে পুরুষের মৌলবাদী চিন্তা থেকে মুক্তি মিলবে নারীদের? কবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিকল ভেঙ্গে নারী একজন মানুষ হয়ে উঠবে? আর কত মাসা আমিনির মৃত্যু হলে নারীরা পাবে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা?

লেখক: সংবাদকর্মী



আরো পড়ুন