১৯ মে ২০২৪, রবিবার



৩৬১ বছরের ঐতিহ্য ‘আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ’

মো. আজহার উদ্দিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া || ৩১ মার্চ, ২০২৩, ১১:০৩ এএম
৩৬১ বছরের ঐতিহ্য ‘আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ’


ইসলামের অনন্য নিদর্শন মুঘল আমলের অপরূপ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ‘আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ’। ১৬৬২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার আরিফাইল গ্রামে নান্দনিক শৈলীতে নির্মিত হয় মসজিদটি। প্রাচীন স্থাপত্যকলা ও অপূর্ব নির্মাণশৈলীর মসজিদটি দেখতে অনেকটা তাজমহলের মতো। ছাদের উপরে থাকা গম্বুজ এবং এর নান্দনিক কারুকার্য যেন জানান দিচ্ছে মুঘল আমলের ঐতিহ্য। সুপ্রাচীন হওয়ায় বাংলাদেশের অনন্য এ স্থাপত্যটি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের তালিকাভুক্তও হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীন হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। স্থানীয়দেরই এর দেখভাল করতে হয়। সেসঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় মসজিদ দেখতে আসা দর্শনার্থীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে দরবেশ শাহ আরিফ এই মসজিদটি নির্মাণ করেন এবং তার নামানুসারে এই মসজিদের নামকরণ করা হয়।

সরেজমিনে সরাইল উপজেলা সদরের আরিফাইল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৩৬১ বছর আগে নির্মিত আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ। উপজেলা সদর থেকে আধা কিলোমিটার দূরবর্তী আরিফাইল গ্রামের সাগরদিঘীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত মসজিদটির আয়তন লম্বার ৮০ ফুট ও প্রস্থে ৩০ ফুট। মসজিদের চার কোনায় চারটি বুরুজ ও মোট তিনটি গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজগুলোতে পদ্মফুল আঁকা রয়েছে। 

মসজিদের ছাদ তিনটি বড় গম্বুজ দ্বারা আবৃত। চুন, সুরকি আর ইটের গাঁথুনীর সঙ্গে মসজিদের ভেতরে ও বাইরের অপরূপ কারুকার্য এর সৌন্দর্য্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মূল গেট থেকে কারুকার্য শুরু করে মসজিদের ভেতরেও বিভিন্ন অংশ কারুকার্য যেন জানান দিচ্ছে মুঘল আমলের উৎকর্ষতার। মসজিদটির মোট প্রবেশপথ ৫টি, যার তিনটি পূর্বদিকে এবং বাকি দুটি যথাক্রমে উত্তর ও পূর্বদিকে।


মসজিদের উত্তর পাশেই বিশাল আয়তনের একটি দীঘি। যার একটির নাম সাগরদীঘি। জনশ্রুতি রয়েছে, সাগরদীঘি থেকে পানি পান করে আগত ব্যক্তিরা রোগমুক্ত হতেন। এ ছাড়াও মসজিদের দক্ষিণে রয়েছে দুটি কবর, যা ‘জোড়া কবর’ বা ‘রহস্যময় কবর’ নামে পরিচিত। কবর দু’টিতেও মুঘল স্থাপত্যকলা ও অপূর্ব নির্মাণশৈলীর প্রভাব বিদ্যমান। মসজিদের পাশে অবস্থিত জোড়া কবর নিয়ে রয়েছে অনেক জনশ্রুতি ও কল্পকাহিনী। তবে সেসময় এগুলো কার মাজার ছিল তার প্রকৃত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। প্রতিদিন এই মাজারে লোকজন এসে নামাজ আদায় করে বিভিন্ন মান্নত করেন।

স্থানীয়রা বলেন, মসজিদের ভেতরে কারুকাজ খুবই নান্দনিক। ভেতরের বিভিন্ন অংশে কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পুরাতন হলেও দূর থেকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগে। মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে কিছু অংশ মেরামত করা হয়েছে। তবে আগের অবকাঠামো ঠিক রাখা হয়েছে। এখানে একটি সাগরদীঘি রয়েছে, যার পানি পান করলে মানুষ এক সময় রোগমুক্ত হতো বলে আলোচনা রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. শের আলম বলেন, শত শত বছর ধরে মসজিদটি টিকে আছে ইতিহাসের নির্দশন হিসেবে। ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা আসে। তবে এখানে আসার যোগাযোগ ব্যবস্থা সরু হওয়ায় দর্শনার্থীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। তাই সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ, রাস্তাটি প্রশস্ত করলে দর্শনার্থীদের চলাচলের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।

আব্দুল লতিফ খন্দকার বলেন, এটি মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছে বলে আমরা বাপ-দাদার কাছ থেকে শুনতে পেয়েছি। অনেকেই আবার গায়েবী মসজিদ বলেও ডাকে। এর উত্তর পাশে একটি বড় দীঘি রয়েছে, যা সাগরদীঘি নামে সবাই ডাকে। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাগুলোকে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে সংরক্ষণ করা গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাসগুলো সংরক্ষিত হতো।

মসজিদের খতিব নজরুল ইসলাম বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে এই মসজিদের আযান ও ইমামতি করে আসছি। প্রতিদিনই এটিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখছি। দেশের বিভিন্ন পর্যটক আসে ও টাকা পয়সা দান করে। এলাকাকাসীর টাকায় মসজিদ চলে।

মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন মন্তু বলেন, আগ্রার তাজমহলের সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে এই মসজিদের। ইট, সুরকির গাঁথুনি দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই মসজিদটি। এটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীন হলেও তারা কেবল সাইনবোর্ড টানিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। এর উন্নয়নে তারা তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এর রক্ষণাবেক্ষণ আমরা স্থানীয় লোকজন করে আসছি। আমরা আশা করি সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রাচীন এই মসজিদ সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশের ঐতিহ্য বিশ্ব দরবারে উপস্থাপিত হবে।


সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ সরওয়ার উদ্দীন বলেন, সরাইল একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ। প্রায় সাড়ে ৩ শত বছরের পুরনো আরিফাইল মসজিদ। এটি দেখার জন্য অনেক পর্যটক আসে। এটি সংরক্ষণ যাতে করা যায়, সে উদ্যোগটি নেওয়া হবে। সড়কটি যেহেতু সংকীর্ণ, কীভাবে প্রশস্ত করা যায় সে বিষয় আমরা দেখবো।

যেভাবে যাবেন মসজিদটি দেখতে

বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল বিশ্বরোড মোড় নেমে সিএনজি অটোরিকশা যোগে ২০ মিনিট গেলেই সরাসরি মসজিদে যাওয়া যায়। সরাইল উপজেলা চত্বরের মূল ফটক থেকে রিকশা যোগে কিংবা পায়ে হেঁটেও যাওয়া যায়।

ঢাকা বিজনেস/এম



আরো পড়ুন