১৮ মে ২০২৪, শনিবার



কৃষ্ণা রানী: এক অদম্য নারী ফুটবলারের গল্প

আব্দুল্লাহ আল নোমান, টাঙ্গাইল || ০৮ মার্চ, ২০২৪, ০৩:০৩ পিএম
কৃষ্ণা রানী: এক অদম্য নারী ফুটবলারের গল্প


ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ ছিল কৃষ্ণা রানী সরকারের। সারাক্ষণ ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন তিনি। দিনের বেশিরভাগ সময় খেলা নিয়ে বাড়ির বাইরে থাকতেন বলে মা প্রায়ই বকা দিতেন। লেখাপড়ায় অমনোযোগী কৃষ্ণা ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে মাতামাতি করায় লোকে নানা রকম কটাক্ষও করতো। অতিষ্ট হয়ে বল কেড়ে নিয়ে কেটে ফেলতেন তার মা। একাধিক বার বন্ধ করে দিয়েছেন খেলা। তবুও বন্ধ করতে পারেননি কৃষ্ণার খেলা। খেলতে না দেওয়ায় কৃষ্ণা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে অনশন করেছেন। পরে বাধ্য হয়ে খেলার সুযোগ দিয়েছেন বাবা মা। বর্তমানে তিনি নারী জাতীয় দলের স্ট্রাইকার হিসেবে রয়েছেন। কৃষ্ণা রানী সরকারের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা উত্তর পাথালিয়া গ্রাম।

২০২৩ সালে ইনজুরিতে পড়ায় এখন পর্যন্ত তিনি জাতীয় দলের খেলা থেকে বিরত রয়েছেন। তবে কৃষ্ণা নিয়মিত প্রাকটিস করছেন। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে উঠে আসা কৃষ্ণা রানী সরকার এখন সারা দেশের তরুণ নারী ফুটবলারের আইকন হয়ে উঠেছেন। কৃষ্ণার বাবা এখনো কৃষি কাজ করেন। আর মা গৃহিণী। 

বাবা বাসুদেব সরকার ও মা নমিতা রানী সরকারের দুই সন্তানের মধ্যে বড় কৃষ্ণা। ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি কৃষ্ণার জন্ম। ফুটবলে হাতেখড়ি ২০১০ সালে উপজেলা পর্যায়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবল টুর্নামেন্টে। সে সময় কৃষ্ণার নেতৃত্বে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তর পাথালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই টুর্নামেন্টে কৃষ্ণা সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ায় সূতি ভি.এম.পাইলট মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীর চর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের নজরে পড়েন এ ফুটবল কন্যা। 

তার অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখে শরীর চর্চা শিক্ষক আগ্রহ নিয়ে কৃষ্ণার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর কৃষ্ণাকে তার স্কুলে বিনা বেতনে ভর্তি করান। সেখান থেকেই ফুটবল চর্চার অবাধ সুযোগ পায় কৃষ্ণা।

কৃষ্ণার ফুটবল নৈপূণ্য আর বিশেষ ভূমিকায় জাতীয় স্কুল ও মাদরাসা ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে পরপর তিনবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দল গঠন করা হলে কৃষ্ণাসহ একই স্কুল থেকে আরও দুই কিশোরী ফুটবলার বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দলেও জায়গা করে নেন।

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক ফুটবলে কৃষ্ণার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। পরের বছর একই টুর্নামেন্টেও শিরোপা ঘরে তোলে বাংলাদেশ। তবে সেই দলে বয়সের কারণে ছিলেন না কৃষ্ণা। কিন্তু একই বছর ঢাকায় হওয়া এএফসসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন কৃষ্ণা রানী সরকার। একই সঙ্গে সেই আসরে ৮ গোল করে দলকে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন এ ফুটবল বিস্ময় কন্যা। ২০১৭ সালে কৃষ্ণার নেতৃত্বেই থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের মূল পর্বে খেলার গৌরব অর্জন করেছে লাল-সবুজের দল। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ভারতে হওয়া সাফ ফুটবলে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ। যে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন কৃষ্ণা।

২০২২ সালে নেপালের সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। দেশের হয়ে তিন গোলের মধ্যে দুটোই করেন কৃষ্ণা রানী সরকার। 

কৃষ্ণার মা নমিতা রানী সরকার বলেন, ‘একসময় টাকার অভাব ও গ্রামের মানুষের কটুকথার কারণে মেয়েকে ফুটবল খেলতে বারণ করেছিলাম। তারপরও কৃষ্ণার ইচ্ছার কাছে কটূক্তি করা মানুষজন হেরে গেছে। সে এখন দেশের গৌরব।’

কৃষ্ণা রানী সরকার  বলেন, ‘প্রথম অবস্থায় পরিবার থেকে কোনো সাপোর্ট পাইনি। পরিবারর কাছ থেকে বকাঝকাও খেতে হয়েছে। পাশাপাশি এলাকার মানুষের কাছ থেকে কটাক্ষও শুনতে হয়েছে। তবে আমি নিয়মিত ফুটবল খেলা চালিয়ে গেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় নিজের খাবার নিজেকেই জোগাড় করতে হয়েছে। বর্তমানে আমি পরিবারের যাবতীয় খরচ বহন করছি।’ 

কৃষ্ণা বলেন, ‘২০২৩ সালে খেলার সময় আমি ইনজুরিতে পড়েছিলাম। তখন থেকে আর জাতীয় দলের খেলা হয়নি। তবে আম নিয়মিত ক্যাম্পে প্রাকটিস চালিয়ে যাচ্ছি।’ 



আরো পড়ুন