১৯ মে ২০২৪, রবিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

মরমি সুফিসাধক দুর্বিন শাহ: জন্মদিনের শুভেচ্ছা

রুবেল সাইদুল আলম || ০৩ নভেম্বর, ২০২৩, ১২:১১ পিএম
মরমি সুফিসাধক দুর্বিন শাহ: জন্মদিনের শুভেচ্ছা


এক.
উনিশ শতকের আশির দশকে (১৯৭৪ সালে) প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক তাঁর ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ সিনেমায়  শিল্পী রণেন রায় চৌধুরীর কণ্ঠে ‘নামাজ আমার হইল না আদায়’ গানটি ব্যবহার করেছিলেন। গানটি তৎকালীন আদলে বিচার করলে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বটে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিশ শতকের শেষের দিকে বাংলাদেশের কণ্ঠশিল্পী আনুশেহ আনাদিল তার এক অ্যালবামে এই গানটি গেয়েছিলেন। ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় চারদিকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজে। অনেকেই তখন জানতো না যে গানটি কার? এত সুন্দর মরমি কথামালার পদকর্তা কে? আসল তথ্যটি তখন সবার জানা ছিল না যে,  গানটির পদকর্তা ছিলেন মরমি সাধক দুর্বিন শাহ।

একই ঘটনা আরও বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের ক্ষেত্রে এখনো রয়েছে। ‘প্রেমশেল বিন্দিল বুকে মরি সে ব্যথায়/ আমার অন্তরায় আমার কলিজায়’, ‘নির্জন যমুনার কূলে বসিয়া কদম্বতলে/ বাজায় বাঁশি বন্ধু শ্যমরায়’, ‘বন্ধু যদি হইত নদীর জল/ পিপাসাতে পান করিয়া পোড়া প্রাণ করতাম শীতল’, ‘অচিন জংলা পাখি থাকে মাটির পিঞ্জিরায়/ ধরা দেয় না ঘরে বাইরে আসা যাওয়া সর্বদায়।’ কালজয়ী এই গানগুলোর স্রষ্টাও মরমি মৃত্তিকায় ১৯২১ সালের ২ নভেম্বর জন্ম নেওয়া  এই সাধক যাকে বলা হতো ‘জ্ঞানের সাগর’। 

দুই.
বাউলদের সাধন ভজন ও সংগীত সৃষ্টি সবই গোপন সাধনার অংশ। তত্ত্বসমৃদ্ধ বাউলগানগুলোকে কেবল নিজেদের ভাব ও তাত্ত্বিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখতেন তাঁরা। কিন্তু তাঁর ব্যতিক্রম বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাধকগণ। তাঁরা সেই গান মানুষের কাছে মঞ্চে  প্রচার করতেন, এর গুরুতত্ত্বের ভাব কেউ বুঝতেন, কেউ বুঝতেন না। দুর্বিন শাহ এই বাউল পরম্পরার ই স্বার্থক উত্তরসূরি। প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ নানান কারণে লালনকেন্দ্রিক কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউলদের সঙ্গে ভাটিবাংলার বাউলদের গানের তত্ত্ব ও রীতিতে কিছুটা তারতম্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু এর দর্শনের জায়গাটা সর্বদাই ঠিক রয়েছে। এক্ষেত্রে মোটেও কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। কুষ্টিয়া-যশোহরে বেশ কিছু বাউল সাধকের সন্ধান মিললেও পদকর্তা হিসেবে এর সংখ্যা অনেক কম। ফকির লালন সাঁই, লালশশী, কুবির গোসাই, দুদ্দু শাহ, জাদুবিন্দু, পাঞ্জু শাহসহ অল্প কিছু সংখ্যক পদকর্তার নাম পাওয়া যায়। কিন্তু বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহে এই তালিকা বেশ দীর্ঘ। সেই তালিকার শ্রেষ্ঠ পদকর্তাদের মধ্যে দুর্বিন শাহ অন্যতম। দুর্বিন শাহের গানে বাউল দর্শনের গুহ্য ও নিগূঢ় বিষয়াবলী স্পষ্টত পরিস্ফুটিত হয়েছে যা পূর্বসূরিদের চেয়ে আলাদা ও বৈচিত্রপূর্ণ। কোরআন-পুরাণ-শরীয়ত-মারফত বিশ্লেষণের পাশাপাশি দেহের নানান কাঠামোকে উপজীব্য করে তিনি গান রচনা করেছেন। এ কাঠামোর পরতে পরতে রয়েছে নানান রকমের বাতেনী ভাষা ও বাউলদের গোপন তত্ত্বের ইঙ্গিত। জাতিগত বিদ্বেষ ও ধর্মীয় হানাহানির বিপরীতে দুর্বিন শাহের গান এক মানবতাবাদী ও সমন্বয়বাদী চেতনার উৎস।

সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার; এই চার অঞ্চলের অখণ্ড নাম শ্রীহট্ট যার মাটি, জল, বাতাস, আর মানুষের মননে রয়েছে মরমি ঐতিহ্যের আবহ। অসংখ্য মরমি সাধকদের জন্মস্থান এই অঞ্চল তাই এই অঞ্চলকে বিশিষ্ট বাউল গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী নাম দিয়েছেন মরমি মৃত্তিকা। এই মরমি মৃত্তিকা আসলে বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী যার একাংশ সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নোয়ারাই গ্রামের তারামন টিলায় (যার বর্তমান নাম দুর্বিন টিলা) বাবা সফাত আলী ও মা হাসিনা বানুর ঘরে জন্ম নেন জীবন ও জগতের রহস্যসন্ধানী, মানুষ সত্যের উপাসক এই মরমি সাধক। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সুরমা নদীর তীরের হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলাটি বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এবং গান ও সুরের লীলাভূমি হিসেবে সর্বাধিক সমাদৃত। সুনামগঞ্জ জেলার ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় চৌদ্দশত পনেরটি হাওর রয়েছে। বর্ষায় এ অঞ্চলের হাওর-বাওর-নদীদ-নালা পানিতে টলমল করে। তৈরি হয় এক ভাবশ্রীত আবহ। তাই সুনামগঞ্জ জেলায় রয়েছে এক সমৃদ্ধ লোকজ সংস্কৃতির ভান্ডার। সুফিমত, বৈষ্ণবীয় তত্ত্ব, বৌদ্ধ সহজিয়া মতবাদের সঙ্গে দেশজ লৌকিক সংগীত আশ্রয়ী আধ্যাত্ম সাধনার ধারা মিলেমিশে  এ অঞ্চলে সুদীর্ঘকাল থেকেই তৈরি হয়েছে এক মরমি প্রেক্ষাপট। 

সৈয়দ শাহ নূর, শিতালং শাহ, দীন ভবানন্দ, কালা শাহ, রাধারমণ দত্ত, দীনহীন, শাহ আবদুল লতিফ, হাসন রাজা, সহিফা বানু, রকিব শাহ ও শাহ আবদুল করিমসহ এসব মহাজন তাঁদের সুর ও সংগীতের মাধ্যমে এই মরমি মৃত্তিকা সৃজন করেছেন যার উত্তরাধিকারের ধারায় অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম মরমি সাধক দুর্বিন শাহ।

তিন.
বাউল কবি দুর্বিন শাহ’র বাবা সফাত আলী ছিলেন একজন ফকির ও মরমিসাধক এবং মা ছিলেন পিরানি যাঁরা তৎকালীন সময়ে সবার কাছে ছিলেন অত্যন্ত পূজনীয় ব্যক্তিত্ব। ফলে সংগীত ও আধ্যত্ম সাধনার এক পারিবারিক ঐতিহ্য নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন দুর্বিন শাহ। দুর্বিন শাহ’র পিতা সফাত আলী শাহ কলকাতার জাহাজের সারেং ছিলেন। একদিন রহিম বক্স মস্তান নামে স্বপ্নে দেখা এক দরবেশের নির্দেশে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং সেই দরবেশের আস্তানার সন্ধান করতে থাকেন। ঘটনা পরম্পরায় ওই দরবেশের সঙ্গে সফাত আলী শাহের দেখা হয় এক নদীর তীরে। সফাত আলী শাহ  স্বপ্নে পাওয়া দরবেশের আধ্যাত্মিক শক্তি ও আল্লাহ-রসূল (সা.)-এর সাধনায় একাত্মতা দেখে সেই নদীর তীরে আস্তানা তৈরি করে সেই দরবেশের খেদমত করতে থাকেন। এই দরবেশ রহিম বক্স মস্তান একসময় মরমি মৃত্তিকার আরেক সাধক সৈয়দ শাহ নূরের শিষ্য ছিলেন। 

একসময় সফাত শাহ দরবেশের ইশারায় আল্লাহর দিদার লাভের আশায় গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়েন। এভাবে কয়েক বছর গত হলে তার উস্তাদ দরবেশ রহিম বক্স মস্তানের নির্দেশে নির্জনে সাধনার উদ্দেশ্যে সুরমা নদীর উত্তর পাড়ে গভীর জঙ্গলে তারামন টিলায় আস্তানা পাতেন যেখানে তখন ছিল বাঘ, সিংহসহ অন্যান্য হিংস্র পশুদের উপদ্রব। কিন্তু নির্জন বনের সেই হিংস্র জন্তু-জানোয়ার এই সাধকের ইশারা শুনতো এবং বনে জীবিকার জন্য চলাফেরারত কোনো মানুষের ক্ষতি করতো না। সফাত শাহ ছিলেন একজন সিদ্ধ পুরুষ ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন আল্লাহর ওলি। দুর্বিন শাহ-এর জন্মের পর সফাত শাহ তাঁর এক শিষ্যের আনা মিষ্টি নিজে খান এবং এক টুকরো তাঁর নবজাত সন্তানের মুখে দিয়ে বলেন, তোমাকে আমি মুখে জ্ঞান তুলে দিলাম। এই জ্ঞানে তুমি জগৎ বিখ্যাত হবে। তিনি তখন আধ্যাতিক চিন্তাধারা থেকেই ছেলের নাম রাখেন দুর্বিন শাহ । যার সাহায্যে দূরের জিনিসকে কাছে দেখতে পাওয়া যায়। দুর্বিন শাহ এর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন কোনো এক ফাল্গুন মাসের বৃহস্পতিবার ভোর রাতে তাঁর মুরিদদের পূর্ব ঘোষণা দিয়ে তাঁর স্ত্রীকে ডেকে ‘আমার সময় হয়েছে, আমি চলে যাচ্ছি’ বলে গায়ে চাদর দিয়ে মুখসহ ঢেকে মুখে কালিমা পরে তিনি ওপারে চলে যান। যাওয়ার পূর্বে তিনি তাঁর পাঁচ বছরের ছোট ছেলে দুর্বিন শাহ নালায়েক বিধায় তাঁর চল্লিশার শিরনি খাওয়ার আয়োজন তিনি নিজে করে যান।

চার.
শৈশবে পারিবারিক বিত্তবৈভব, বংশকুলীন্য কিংবা পরিচিতি-প্রতিষ্ঠা কিছুই ছিল না দুর্বিন শাহ’র। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও তেমন মেলেনি। ছয় বছর বয়সে তিনি ছাতক বাজারে বাঘবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। লেখা-পড়া আর আগায়না দুর্বিন শাহের। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত একজন মানুষ। মরমি ঐতিহ্যের জন্য তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পরিবারের কাছেই দায়বদ্ধ কারণ, তাঁর পিতা ছিলেন একজন বিখ্যাত মরমি সাধক-ফকির এবং মাতা ছিলেন একজন পিরানি, সাধন পথেরই পথিক। তাই, দুর্বিন শাহের রক্তে ছিল এক আধ্যাত্মিক ফকিরি নেশা। মূলত শুরুতে বাবা-মা ই ছিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু। পরে ১৯৫৬ সালে তিনি আজমীর শরীফে গিয়ে বিখ্যাত আধ্যাত্মিক গুরু সৈয়দ আবদুস সামাদ গুলজেবীর কাছে চিশতিয়া তরিকার বায়াত গ্রহণ করেন। 

ছোট বেলায় অন্যান্য সহপাঠীরা যখন খেলা-ধুলা করতো, তখন দুর্বিন শাহ নিজের হাতে বানানো দোতরা দিয়ে সুরমা নদীর তীরে নির্জনে বসে গান ধরতেন। তখন থেকেই তাঁর ভেতরে সংগীতের ও সাধনার প্রতি ভাবের উদয় হয়। তাঁর মা তাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। তাঁর বাবার রচিত গানগুলোই তিনি নিজে নিজে গাইতেন। দুর্বিন শাহ যখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন, তাঁর মধ্যে আরো প্রবলভাবে ভাবের উদয় হতে থাকে। একসময় তিনি সব ত্যাগ করে এককেন্দ্রিক হয়ে যান, টা হলো সংগীত চর্চা। এসময় তিনি মায়ের নির্দেশে আজমীর শরীফ গমন করেন এবং বায়াত গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই গান লেখা শুরু করেন এবং নিজের লেখা গান বিভিন্ন মঞ্চে গেয়ে চারদিকে সাড়া ফেলে দেন। 

পাঁচ.
গান নিয়ে মগ্ন থাকতেন দুর্বিন শাহ, সংসার জীবনের প্রতি  তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। তথাপি মায়ের নির্দেশে উপযুক্ত সময়েই ১৯৫৬ সালে ৩৫ বছর বয়সে তিনি সরুফা বিবিকে বিয়ে করেন। এই ঘরে তাঁর তিনটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর মা ও স্ত্রীর অনুমতিতে আরও দুটি বিয়ে করেন। কিন্তু সংসার তাকে বাঁধতে পারেনি। তিনি সুর, সংগীত ও সাধনা নিয়েই মজে ছিলেন, জীবন সঁপে দিয়েছেন। তাঁর মরমি গানের ধারায় ভাবশ্রীত হয়েছে বাংলার নানান জনপদের মানুষ। তিনি সৃষ্টি করেছেন শত শত গান, মানুষের হৃদয়ে তুলেছেন সুরের তুফান। পিতা-মাতার কাছ থেকেই সংগীত তিনি পেয়েছিলেন সংগীত সাধনার আধ্যাত্মিক শক্তি। 

কালক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন বাউল গানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাজন। এ সাধকের গান স্বতন্ত্র ও অসামান্য। তাঁর গানের ভাব , উপস্থাপনার ধরণ শ্রোতাদের তন্ত্রীর গভীরে গিয়ে পৌঁছেছে। দুর্বিন শাহের গানে বাঙালি মানসের সুখ-দুঃখ, বিরহ-ব্যথা, ভক্তি-বিনয়ের আন্তঃসম্পর্ক ও প্রাণসঞ্চারি চেতনা ও আদর্শ রয়েছে। তা হলো মায়া, মানব প্রেম, জীবের প্রতি পরমের প্রেম-পরমের প্রতি জীবের প্রেম। 

বৃহত্তর সিলেটকে যেহেতু মরমি মৃত্তিকা বলা হয়, তাই দুর্বিন শাহের সমসাময়িক সময়ে অনেক সাধক বাউল  বর্তমান ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বাউল শাহ আবদুল করিম, বাউল খালিক মিয়া, বাউল জারিফ মিয়া, বাউল মহিউদ্দিন, নেত্রকোনার বাউল জালাল উদ্দিন খাঁ, বাউল রশিদ উদ্দিন, বাউল আব্দুস ছাত্তার প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

বাউল শাহ আবদুল করিমের সাথে দুর্বিন শাহের ছিল বিশেষ সখ্যতা। তাঁরা পরস্পরকে খুব সন্মান করতেন ও ভালোবাসতেন। শাহ আবদুল করিম সাধক দুর্বিন শাহকে পির সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। তখন মালজোড়া গানের খুব কদর। দুজনের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা এত প্রবল ছিল যে, প্রায়ই তাঁদের মালজোড়া  গানের আসর বসতো এবং এ জুটি খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যার ফলে ১৯৬৮ সালে এই জুটিকে প্রবাসীরা ইস্টার্ন ফিল্ম ক্লাব কর্তৃক লন্ডনে আমন্ত্রণ জানায় গান শোনার জন্য। প্রায় চার মাস তাঁরা বিলাতের বিভিন্ন স্থানে সংগীত প্রেমীদের গানে গানে মাতিয়েছেন এবং মন জয় করেন। তাঁদের গানে মুগ্ধ হয়ে প্রবাসীরা সাধক দুর্বিন শাহকে ‘জ্ঞানের সাগর’ এবং বাউল শাহ আবদুল করিমকে ‘রসের নগর’ উপাধি দেন। সিলেট অঞ্চলে তখন দুর্বিন শাহ-ই এই গানের নেতৃত্ব দিতেন। তিনি বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে গান পরিবেশন করতে পারতেন। 

বিভিন্ন জায়গায় দুর্বিন শাহ অনেক বড় বড় সাধকদের সঙ্গে গানে অংশগ্রহণ করেন। ছাতক বাজারে দুর্বিন শাহ বিখ্যাত বাউল সাধক আলাউদ্দিনকে গানের আসরে কথা, সুর ও প্রশ্নে হারিয়ে দেন। মালজোড়া গানের রীতি হলো এক বাউল অন্য বাউলকে গানে গানে প্রশ্ন করবেন, অন্যজন গানে গানে জবাব দিবেন এবং পাল্টা প্রশ্ন করবেন। প্রখ্যাত সাধক আলাউদ্দিন কে হারিয়ে দেয়ার পর দুর্বিন শাহের নাম-ডাক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিখ্যাত সাধক উকিল মুন্সির ছেলে প্রখ্যাত বাউল আব্দুস ছাত্তার দুর্বিন শাহের সাথে অনেকবার মালজোড়া গানের আসর করেছেন কিন্তু একবার দুর্বিন শাহ কে হারাতে পারেন নি। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ভালো দোস্তি সম্পর্ক ছিল। তাঁরা পরস্পর পরস্পরের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতেন, বেড়াতেন, গানের আসর দিতেন। 

স্বাধীনতার পর একবার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে দুর্বিন শাহ ঢাকায় আসেন এবং তখনকার ঢাকার প্রখ্যাত সাধক বাউল খালেক দেওয়ান, মালেক দেওয়ান ও রমিজ দেওয়ানের সাথে আসর বসে। আসরে বাউল মালেক দেওয়ান পালা গান করতে রাজি হলেও বড়ভাই প্রখ্যাত সাধক বাউল খালেক দেওয়ান পালাগানে রাজি হননি। তাঁর কথা ছিল, দুর্বিন শাহ একজন গুরুতুল্য সাধক। তাঁর সাথে পালাগান নয়। তারপর তাঁরা সারারাত সকলে মিলে গান গেয়ে আনন্দে সময় কাটান।

মরমি সাধক, বাউল কিংবা ফকির সুফিবাদের অধ্যাত্ত্ব নিয়ে যারা চিন্তা করেছেন, সৃষ্টির রহস্য ও এই দেহ কিংবা সীমার মধ্যে ওসীমকে সন্ধান করেছেন; তাদের উপলব্ধিও আধ্যাতিক চেতনায় পরিপূর্ণ। ফকির লালন সাঁইয়ের আধ্যত্ব চিন্তার সাথে সাধক দুর্বিন শাহের চিন্তার কোথাও কোথাও মিলে যায়। দুর্বিন শাহ ‘কামনদীকে’ রূপকে বলেছেন,

ডুবল জগৎ কামনদীতে
নদীর তরঙ্গ দেখিয়া, মানুষ মরে ডুবিয়া
পারেনা বেহুশ কূলে উঠিতে।

ফকির লালন বলেন- 

করি কেমনে সহজ শুদ্ধ প্রেম সাধন
প্রেম সাধিতে ফাঁপরে উঠে কামনদীর তুফান।

লালন বলেন, ‘মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষের সনে’, পদটিতে সাঁইয়ের মনের মানুষ, সহজ মানুষ, অধর কালা, সাঁই নিরিঞ্জন, অচিন পাখির সঙ্গে মিলনের আকুতি কিংবা দ্যোতনা প্রকাশ পেয়েছে। দুর্বিন শাহের প্রেমতত্ত্বের কিছু গানেও এরকম আকুতি পাওয়া যায়। দুর্বিন বলেন-

বন্ধু যদি হইত নদীর জল
পিপাসতে পান করিয়া পোড়া প্রাণ করতাম শীতল।

দুর্বিন শাহ ছিলেন খুব ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ। তিনি অল্প কথা বলতেন। সাধারণত লুঙ্গি পাঞ্জাবি পড়তেন কিন্তু গানের আসরে তিনি সাদা পায়জামা-সাদা পাঞ্জাবি ও কালো কোট পড়তেন। তিনি কখনো নিজেকে জাহির করতেন না। অনেকটা দাস্যভাব নিয়ে চলতেন এবং মানতেন। তিনি এক গানে বলেন,  ‘দুর্বিন শাহ তোর চির দাসী বিনা মূল্যে কিনা বন্ধুরে।’

লালন বলেন, 

ইতরপনা কার্য আমার ঘটে অহর্নিশি,
গুরু আমারে কি রাখবেন আপনার চরণদাসী। 

তাঁরা উভয়েই আমিত্ববোধকে ত্যাগ করে দাস্য ভাবকে গ্রহণ করেছিলেন। 

 দুর্বিন শাহ বায়াত গ্রহণ করেন তাঁর আধ্যাতিক গুরুত্ব সৈয়দ আব্দুস সামাদ গুলজেবির কাছ থেকে। দুর্বিন শাহও  শিষ্য করেছেন অনেককে। দুর্বিন শাহের শিষ্য ছিলেন বাউল কপিল উদ্দিন সরকার, বাউল খোয়াজ মিয়া, বাউল আব্দুস ছালিক, শ্রী অন্নদা রঞ্জন দাস, বাউল আরাফাত মিয়া প্রমুখ। বাউল মুজিব সরকার ও কারি আমির উদ্দিন দুর্বিন শাহের অনেক গান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়ে দর্শক মাতিয়েছেন। 

ছয়.
মরমি সাধক দুর্বিন শাহ বেদ, কোরআন, বাইবেলসহ বিভিন্ন হাদিসের আলোকে বিচার গানে কথা বলতেন, গান রচনা করতেন। তাই দুর্বিন শাহের গান খুবই তত্ত্ববহুল। দুর্বিন শাহের অধিকাংশ গানে সুফি ও মরমিবাদ ফুটে উঠলেও তিনি অন্যান্য বিভিন্ন মেজাজ ও ভাবের গান রচনা করেছেন। তিনি দোতরা ও বেহালা বাজিয়ে গান গাইতেন। তাঁর উচ্চারণ স্পষ্ট হতো না সবসময়, গাইতেন কাশযুক্ত ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে গলায় কিন্তু তাঁর গানে ছিল বিষাদ ভরা মিনতি, অন্তরমগ্ন মাধুর্য। পুরোদস্তুর সংসারী হয়েও দুর্বিন শাহ ছিলেন একজন ঘরছাড়া বাউল, আপাদমস্তক বোহেমিয়ান মানুষ। তিনি বলতেন, ঘর-বাড়ি মিছে, সংসার হলো মায়া। 

দুর্বিন শাহের গানের একটা বিশেষ শৈলী আছে, আছে এক ভিন্ন লক্ষণীয় প্রবণতা।  তাঁর গানের সঠিক সংখ্যার হিসেব পাওয়া কষ্টকর তবে ধারণা করা হয় যে,  তিনি প্রায় হাজার খানেক গান রচনা করেছেন । কিন্তু তিনি অল্প বয়সে মারা যাওয়ার কারণে খুব বেশি গান সংগ্রহের সুযোগ হয়নি। তবে তাঁর গানের অধিকাংশ প্রেমসাগর পল্লীগীতি নামে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তবে এ যাবৎ তাঁর রচিত প্রায় ৪০০ টি গান বিভিন্নভাবে সংগৃহিত আছে।  শ্রেণীবিন্যাস করলে তাঁর  গানগুলোকে হামদ ও নাত, সৃষ্টিতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, গোষ্ঠ, মালজোড়া, বিচ্ছেদ, জারি, সারি, পাড়ঘাটা, মুর্শীদি, কারবালা, রাধা-কৃষ্ণের মান ভঞ্জন, ভাটিয়ালি, ভক্তিগীতি, দেশাত্ব বোধক প্রভৃতিভাবে ভাগ করা যায়। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন সাধক। একদিকে লিখেছেন হামদ নাত, আবার লিখেছেন গোষ্ঠ গীতি। দুর্বিন শাহ গানের মধ্য দিয়ে প্রচলিত সব ধর্মব্যবস্থাকে এককাতারে নিয়ে এসে অসাম্প্রদায়িক চেতনার দৃঢ় প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। 

কৃষ্ণলীলা বিষয়ক গানের রচনা শৈলীতে তিনি দারুন স্বাতন্ত্র্য দেখিয়েছেন। রাধা-কৃষ্ণ ও তাঁদের প্রেমলীলা সমন্ধে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। তার প্রমান হলো এই গান: 

রাধার মন্দিরে উদয় গো সখি শ্যাম চিকন কালা
অমাবস্যার রাত্রে যেমন পূর্ণিমা উজলা গো সখি।

আবার, নিরাকারের রহস্য ভেদ করে স্রষ্টার কাছে বা প্রভু নিরঞ্জনের আবেদন করেছেন তিনি এই ভাবে, ‘শাস্ত্র ছেড়ে আকার ধরে দিও দেখা দাসেরে।’

সাত.
দুর্বিন শাহ মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামীলীগের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়ে দেশের জন্য গান রচনা করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেছরন, স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন। ১৯৬৬ সালেও ছয় দফা আন্দোলনের সমর্থনে তিনি গান রচনা করেছেন এবং বিভিন্ন স্থানে পরিবেশন করেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় পশ্চিমাদের লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে তিনি গান গেয়েছেন। তিনি আওয়ামীলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং দেশ স্বাধীন হলে দুর্বিন শাহ কে নোয়ারাই ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় যা বাংলাদেশের কোন বাউল সাধকের মধ্যে বিরল।

আট.
দুর্বিন শাহ একজন নিরহংকারী, সাদাসিদে মানুষ ছিলেন। নিজেকে কখনো বড় করে দেখতেন না। সাধারণ ভাবে চলাফেরা করতেন। ১৯৭৬ সালে তিনি শেষবারের মতো আসরে গান করেন। তারপর তাঁর ফুসফুসে পানি জমে যায়। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয় কিন্তু বেশ কিছু চিকিৎসার পর ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর সাধনার স্থান তারামন টিলায় নিয়ে আসা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭ বুধবার বেলা সাড়ে তিনটায় তাঁর গর্ভধারিনী মা ও অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে এই সুর স্রষ্টার ৫৫ বছর বয়সে জীবনাবসান হয়, তিনি ওপারে চলে যান, চির নিদ্রায়। 

দুর্বিন শাহের মৃত্যু হয়েছে আজ প্রায় ৪৫ বছর কিন্তু এখনো তার সমসাময়িক বাউলদের মতো তার গান অতটা জনপ্রিয় হয়নি। তাঁকে নিয়ে আরো কাজ করতে হবে, আরও গবেষণা ও সার্বজনীন করতে হবে এই গুণী মহাজনকে। তিনি আজ ঘুমিয়ে আছেন দুর্বিন টিলায় তাঁর বাবা, মা, সহধর্মিনী, ছেলে, মেয়ে, মেয়ের জামাই মস্তান শাহ সহ তাঁর নাতি-নাতনি ভাগ্নির সঙ্গে।

আজ এই মহান সাধকের জন্মজয়ন্তী। জন্মদিনে এই সাধকের প্রতি রইলো প্রজন্মের শ্রদ্ধাঞ্জলি। ওপারে ভালো থাকবেন হে মহাজন।

তথ্যসূত্র
১. হারামনি: মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন সংকলিত। প্রথম খণ্ড। কলকাতা, বৈশাখ ১৩৩৭।
২. বাউলতত্ত্ব: আহমদ শরীফ। বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ফাল্গুন ১৩৭৯।
৩. ক্লান্তরের পথিক লালন: আবুল আহসান চৌধুরী। মুক্তধারা, ঢাকা, একুশে বইমেলা ২০১২।
৪. মরমি কবি দুর্বিন শাহের গান ও জীবন: অমলেন্দু কুমার দাশ, অনুপম প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০১৮।
৫. দুর্বিন শাহ রচনা সমগ্র: সুমন কুমার দাশ সম্পাদিত। উৎস প্রকাশন, ঢাকা, একুশে বইমেলা ২০১২।

 



আরো পড়ুন