১৮ মে ২০২৪, শনিবার



বিকল্প চিকিৎসায় জোর দিতে হবে

মাহাবুল ইসলাম || ০৪ আগস্ট, ২০২৩, ০৪:০৮ পিএম
বিকল্প চিকিৎসায় জোর দিতে হবে


একটি দেশের স্বাভাবিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি সরকারকে কিছু জরুরি খাত নিয়ে বাড়তি নজর দিতে হয়। জাতীয় বাজেটেও এই বিশেষ খাতে বাড়তি বরাদ্দ থাকে। খাতটি স্বাস্থ্যসেবা। প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও উন্নয়নের সঙ্গে-সঙ্গে এই খাতে ব্যয় বাড়ছে। সেটা যে শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এমনটিই নয়; ব্যক্তি ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বাড়ছে। আর স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশে স্বীকৃত ও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্ত চারটি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েই পকিল্পনার কথা জানিয়েছে সরকার। তবে প্রতিযোগিতার লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি। বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে অনেকটা কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চলছে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক। আর এই বিকল্প পদ্ধতিগুলোকে একসঙ্গে অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার (এএমসি) বলা হচ্ছে।    

দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের সূচনালগ্ন থেকেই অ্যালোপ্যাথি প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। বাকি পদ্ধতিগুলো বিকল্প। অবহেলা-অনাদারে পথচলা বিকল্প পদ্ধতিগুলো গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষের আস্থার হাত ধরেই অনেকটা এগিয়ে চলছে। তবে গবেষণা ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে বিকল্প পদ্ধতিগুলোও এক সময় অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে প্রতিযোগতায় ভালো করবে; এটা বলাই বাহুল্য।

ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক পদ্ধতি শত শত বছরের প্রাচীন ও আদি চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার হওয়ার বিষয়টি ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। গ্রিক থেকে ইউনানি, ভারত উপমহাদেশ থেকে আয়ুর্বেদিক এবং জার্মানি থেকে  হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উৎপত্তি। তবে বিকল্প চিকিৎসার ওষুধ ছাড়াও যোগ ব্যায়াম, মেডিটেশন, কাপিং থেরাপি, আকু প্রেসার, আকুপাংচার, লিচ থেরাপি, রেজিমেন্টাল থেরাপিসহ বেশকিছু পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আর এই পদ্ধতিগুলো নিয়ে জন সাধারণের মাঝে বিভিন্ন ধারণা বদ্ধমূল রয়েছে।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পেক্ষাপটে একজন ব্যক্তি এখন আর একক কোনো চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তবে দিন শেষে প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে অ্যালোপ্যাথির দ্বারস্থ হন সবাই। তবে একইসঙ্গে একাধিক চিকিৎসা পদ্ধতির সংমিশ্রণ রোগীর স্বাস্থ্যে কখনো কখনো মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুতরাং সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়ন ভাবনার সঙ্গে এ বিষয়ে উচ্চতর গবেষণারও পর্যাপ্ত সুযোগ থাকতে হবে। এক কথায় ‘বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি’ নিয়ে ২০২১ সালে হাইকোর্টের দেওয়া পরামর্শগুলোর বাস্তবায়ন জরুরি।

দেশে কত শতাংশ মানুষ বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করছেন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ এএমসির মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে থাকে।

জানা যায়, বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে সরকার খুবই ইতিবাচক। ১৯৮৯ সালে এএমসি নিয়ে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক পর্যায়ে ৫ বছর মেয়াদি শিক্ষা কোর্স ও এক বছরের ইন্টার্নশিপ (বিইউএমএস, বিএএমএস ও বিএইচএমএস) ডিগ্রি চালু করে। এরপর ১৯৯৯ সালে ৪৫টি জেলা সদর হাসপাতালে অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ারের অধীনে ৪৫ জন ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে সরকারিভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকরা জেলা পর্যায়ে বহির্বিভাগে রোগীদের বিকল্প চিকিৎসার মাধ্যমে সেবাদান করে আসছেন। যেখানে হোমিওপ্যাথিই অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে।

বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে অবস্থিত সরকারি মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের বহির্বিভাগেও ২০০০ সাল থেকে অল্টারনেটিভ মেডিক্যাল কেয়ার (এএমসি) পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর সেখানকার অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার (এএমসি) অফিসার ডা. মো. আতাউর রহমান জানান, হাসপাতালে ২০০৫ সাল থেকে তিনি একাই এএমসি চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। অল্টারনেটিভ মেডিক্যা ল কেয়ারে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক; এই তিনটি পদ্ধতি থাকলেও সরকারিভাবে ওষুধ দেওয়া হয় শুধু হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতির। বছরে ৫ লাখ টাকার হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন দিয়েই বর্হিবিভাগে এএমসি চিকিৎসা দিচ্ছেন। তার ভাষ্যমতে, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে গত দুই দশকে এখানে রোগী বেড়েছে ৮ গুণ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৯ সালেও দেশের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও ২০০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরকারিভাবে ২৯৭ জন ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যেখানে ইউনানি চিকিৎসক আছেন, সেখানে অন্য দুই পদ্ধতির চিকিৎসক নেই। আবার আয়ুর্বেদিক থাকলে সেখানে অন্য দুই পদ্ধতি নেই। হোমিওপ্যাথিকের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। এতে স্থানভেদে ওই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলন ও জনপ্রিয়তাও ভিন্ন ভিন্ন।

সার্বিকভাবে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো বা এএমসির উন্নয়নে পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এএমসি চিকিৎসা ও শিক্ষার উন্নয়নে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরও হয়েছিল। তবে তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া এই পদ্ধতিগুলোর বিদ্যমান নানা সীমাবদ্ধতাগুলো দূরীকরণেও উদ্যোগ জরুরি। কেননা বিকল্প পদ্ধতিগুলো আমাদের দেশে সহজলভ্য ও কম ব্যয় বহুল। এই পদ্ধতিগুলোর সম্প্রসারণ হলে  একক আধিপত্য নিয়ে পথচলা অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির ওষুধ, প্যাথলজিক্যাল টেস্টসহ সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে গড়ে ওঠা শক্তিশালী প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্র নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।

কারণ এই সিন্ডিকেট দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য এখন বড় হুমকি। যেটা করোনার সংক্রমণকালীন সময়ে খুব স্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান হয়েছে। যাদের গলা কাটার চিত্র গণমাধ্যম প্রায়শই দেশবাসীর সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় সময় এসেছে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোকে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখার। যা স্বাস্থ্যসেবায় পদ্ধতিগত জটিলতা দূর করাসহ সামগ্রীক ভারসাম্য নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির জোয়ার আনতে হবে।

লেখক: সংবাদকর্মী



আরো পড়ুন