২৬ জুন ২০২৪, বুধবার



ভক্ত-সাধকদের পদচারণায় মুখরিত নরসিংদীর বাউল মেলা

এইচ মাহমুদ, নরসিংদী || ০৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩, ০৪:৩২ পিএম
ভক্ত-সাধকদের পদচারণায় মুখরিত নরসিংদীর বাউল মেলা


নরসিংদীতে মেঘনার তীরে দেশ-বিদেশের শতাধিক বাউল সাধক ও হাজারো ভক্তর পদচারণায় মুখোর হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী বাউল মেলা। আত্মশুদ্ধি আর আত্মমুক্তির লক্ষ্যে বাউলদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে সরব হয়ে উঠেছে মেঘনা পাড়ের এই বাউল আখড়াধাম। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মানব ধর্ম ও সাম্যের জয়ধ্বনী করছেন সবাই। ভক্তদের উপস্থিতিতে বাউল ঠাকুরের আখড়া পরিণত হয়েছে মিলন মেলায়।

নরসিংদী শহরের কাউরিয়া পাড়ায় মেঘনা নদীর তীরে বাউল আখড়াধামে গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রথম বাতির মধ্যদিয়ে প্রায় ৭০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মেলা শুরু হয়। এরই মধ্যে শতাধিক বাউল সমবেত হয়েছেন। বুধবার প্রসাদ বিতরণ। পাঁচ দিনব্যাপী এই মেলা চলবে আগামী বৃহস্পতিবার  (৯ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মেলা উপলক্ষে মেঘনার পাড়ে শিশুদের হরেক রকমের খেলনা, খাবারসহ বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাঝিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।

বাউল ঠাকুরের আখড়াবাড়ি সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছরই মাঘী পূর্ণিমার দিনে শ্রী চৈতন্য দেবের জন্ম তিথী উপলক্ষে এই মহাযজ্ঞের আয়োজন করা হয়। সমাগম ঘটে লক্ষাধিক নারী-পুরুষের। নদীতে চলে পুণ্যস্নান । পাশেই রয়েছে বাউল ঠাকুরের আখড়া। যেখানে বসে গানের আসর। মেলাকে ঘিরে মেঘনা নদীর পাড় ঘেঁষে জমে উঠেছে খেলনা, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, কাঠ-বাঁশ ও মাটির তৈরি শিল্প-সামগ্রীর দোকান। এ ছাড়াও শিশুদের আকৃষ্ট করতে মেলায় বসেছে পুতুল নাচ, নাগরদোলাসহ নানা বিনোদনমূলক রাইডস।

এদিকে বাউল ভক্তরা সারি বেঁধে মহাযজ্ঞানুষ্ঠানে ঘি-প্রদীপ, মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে পূজো দিচ্ছেন আর প্রার্থনা করছেন পরিবার ও দেশের মানুষের কল্যাণসহ যত ধরনের অশুভ শক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা ও অস্থিরতা এবং সর্বোপূরি করোনাভাইরাস থেকে নিস্কৃতি পেতে।

কথিত আছে, ৭০০ বছর আগে নরসিংদীতে এক বাউল ঠাকুর ছিলেন। তিনি নিজেকে শুধু বাউল বলেই পরিচয় দিতেন। এজন্য বাউল ঠাকুরের প্রকৃত নাম জানেন না এখানকার কেউই। সেই বাউল ঠাকুরের স্মরণে তার আখড়া ধামে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই মেলা। তবে কে প্রথম এখানে বাউল মেলার আয়োজন করেন তার প্রকৃত তথ্য কারোই জানা নেই। সর্বশেষ ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এখন পর্যন্ত মেলার আয়োজন করছেন স্বর্গীয় মনিন্দ্র চন্দ্র বাউলের পরিবার। বর্তমানে এই মেলায় আয়োজকদের মধ্যে রয়েছেন মনিন্দ্র চন্দ্র বাউলের পরিবারের সদস্য শীর্ষেন্দু বাউল পিন্টু, মলয় বাউল রিন্টু ও স্বপন বাউল।

ভক্ত ও দর্শনার্থী জানান, এ আখড়ায় বাউল ঠাকুরের অন্তর্ধান হয়েছিল। বাউল আখড়ায় জগন্নাথ দেবতার মন্দির রয়েছে। মন্দিরে মহাবিষ্ণুর পূর্ণাঙ্গ প্রতিমা, জগন্নাথ দেবতার প্রতিমা, মা গঙ্গার (৩৩ কোটি দেবতার) গট, নাগ দেবতার বিগ্রহ ও শিবলিঙ্গ রয়েছে, যা বাউল ঠাকুর নিজে প্রতিস্থাপন করে গেছেন বলে কথিত রয়েছে। পাশে রয়েছে বাউল ঠাকুর ও মাতাজির সমাধি মন্দির। মধ্যে রয়েছে উপাসনার জন্য বিশাল আটচালা ঘর। এ খানে মহাযজ্ঞে জগতের কল্যাণের জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের পূজা করা হয় এবং ঠাকুরের কাছে দেশ ও মানুষের কল্যাণে প্রার্থনা করা হয়।

এদিকে, বাউল মেলা উপলক্ষে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা বাঙালির চিরচেনা মুখরোচক খাবার ও বাহারি পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে মিষ্টি, সন্দেশ, বারো মিঠাই, দই, মুড়ালি, গুড়ের তৈরি মুড়ি ও চিড়ার মোয়া, তিলের মোয়া, তিলের সন্দেশ, খাস্তা, কদমা, নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, খাজা, গজা, নিমকি, মনাক্কা, গাজরের হালুয়া, পিঠাসহ রকমারি খাবার। এছাড়া শিশুদের খেলনা, ঘরের তৈজসপত্র, আসবাবপত্র, বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাক, মাটি ও বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রসহ নানা ধরনের পণ্যের স্টল নিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।

মেলার আয়োজক ও নরসিংদী বাউল আখড়াধামের সেবায়েত শ্রী শীর্ষেন্দু বাউল পিন্টু বলেন, জীবের মঙ্গলার্থে বাউল ঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছিল। কীভাবে সহজে মানুষ নিজেকে চিনতে পারবে সেই পথ তিনি দেখিয়ে গেছেন। আমরা তার পথ অনুসরণ করে ভেদাভেদ বিভেদ না করে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ভালোবেসে যাচ্ছি। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিবছর সবার মিলন ঘটানোর জন্যই মেলার আয়োজন।

ঢাকা বিজনেস/এইচ



আরো পড়ুন