১৭ জুন ২০২৪, সোমবার



বিলুপ্তির পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটির ঘর

আজহার উদ্দিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া || ২৫ জুলাই, ২০২৩, ১২:০৭ পিএম
বিলুপ্তির পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটির ঘর


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে গরিবের ‘প্রাসাদ’ ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর। মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, পারিবারিক নিরাপত্তা ও রুচির পরিবর্তনের কারণে এখন আর মাটির ঘরে তারা থাকতে চায় না। সচ্ছল ব্যক্তিরা এখন পাকা দালানের মধ্যেই থাকতে স্বস্তিবোধ করেন।  

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় ভারতের সীমান্তঘেঁষা বিজয়নগর উপজেলার ১০ ইউনিয়নের মধ্যে ৫টিরই বেশিরভাগ বাড়িতে ছিল মাটির ঘর। এখন আর নেই। এখন সেখানে  শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন ডিজাইনের পাকা দালান।

উপজেলার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, একসময় বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর, কালাছড়া, বক্তারমোড়া, ছতরপুর, দুলালপুর, পত্তন ইউনিয়নের আদমপুর, শ্রীপুর, হরষপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া, পাঁচগাও, বাগদিয়া, হরষপুর, সোনামোড়া, বড়চাল, মেঘশিমুল, পাহাড়পুর ইউনিয়নের খাটিঙ্গা, মকুন্দুপুর, দাড়িয়াপুর, কামালমোড়া, সেজামোড়া, ভিটি দাউদপুর, দুরানাল, কচুয়ামোড়া,  সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের মেরাশানী, রানুর বাজার, আলীনগর, কানপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষের বাড়িতেই ছিল মাটির ঘর। বর্তমানে ওইসব গ্রামের হাতেগোনা কিছু বাড়িতে মাটির ঘর থাকলেও অধিকাংশ বাড়িতে শোভা পাচ্ছে পাকা দালান ঘর ও সেমি-পাকা টিনের ঘর।

এলাকাবাসী জানায়, উপজেলার যে সব  গ্রামে লাল মাটি ও এঁটেল মাটি পাওয়া যেতো, সেসব গ্রামের লোকই বাড়িতে মাটির ঘর তৈরি করতো। প্রথমে লাল মাটি ও এঁটেল মাটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে প্যাক করা হতো। পরে সেই মাটি দিয়ে তৈরি করা হতো ২০/৩০ ইঞ্চি  চওড়া দেয়াল। প্রতিবার ১/২ ফুট উঁচু করে দেয়াল তৈরি করে সেই দেয়ালকে ৫/৬ দিন রোদে শুকানো হতো। তারপর এই দেয়ালের ওপর আরও ১/২ ফুট উঁচু দেয়াল তৈরি করা হতো। এভাবে পর্যায়ক্রমে ১০/১২ ফুট উঁচু দেয়াল নির্মাণ করা হতো।  পরে এই দেয়ালের ওপর টিন বা ছন দিয়ে ছাউনি দিয়ে ঘর নির্মাণ করা হতো। প্রতিটি ঘর নির্মাণ করতে সময় লাগতো প্রায় ২/৩ মাস। পরে বিশেষ প্রক্রিয়ায়  ঘরের ভেতরের দিকে ধানের তুষ (কুড়া) দিয়ে দেয়ালের ওপর প্রলেপ দেওয়া  হতো। বাইরের দিকে দেওয়া হতো চুনের প্রলেপ বা আলকাতরা। চুনের প্রলেপ দিলে ঘরের সৌন্দর্য যেমন বৃদ্ধি পেতো, তেমনি ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকেও মাটির দেয়াল রক্ষা পেতো। বন্যা বা ভূমিকম্প না হলে এসব ঘর ২০/২৫ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতো। যারা মাটির ঘর নির্মাণের কারিগর ছিলেন তাদের বলা হতো দেয়ালি। 


উপজেলার হরষপুর ইউনিয়নের নিদারাবাদ গ্রামের দেয়ালি নোয়াজ আলী বলেন, ‘মাটির ঘর তৈরির উপযুক্ত সময় হচ্ছে কার্তিক মাস।  এ সময়  বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিহাত ঘর নির্মাণে ১০টাকা করে নিতাম। আবার অনেক সময় ৫/৬ হাজার টাকা চুক্তিতেও ঘর নির্মাণ করে দিতাম।  মানুষ এখন আর মাটির ঘর তৈরি করে না। যার জন্য আমরা এই পেশা ছেড়ে দিয়েছি।’

উপজেলার নিদারাবাদ গ্রামের বাসিন্দা সংবাদকর্মী এস.এম টিপু চৌধুরী বলেন, ‘আমি ছোট বেলায় মাটির ঘরেই বসবাস করেছি। মাটির ঘরে বসবাস খুবই আরামদায়ক। গরমের দিনে ঠাণ্ডা লাগতো। আর শীতের দিনে শীত লাগতো না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে ৭টি বড় মাটির ঘর ছিল। বর্তমানে একটি ঘর ছাড়া বাকি ঘরগুলো ভেঙে সেখানে পাকা দালান নির্মাণ করা হয়। বাড়ির ঐতিহ্য হিসেবে এখনো প্রায় শতবর্ষ পুরনো একটি মাটির ঘর রাখা রয়েছে।  গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে এই মাটির ঘরটিকে আমরা রেখে দেবো।’ 

উপজেলার পাহাড় ইউনিয়নের বাসিন্দা ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. রাসেল খান বলেন, ‘আমি এখনো মাটির ঘরেই বসবাস করি।  মাটির ঘরে বসবাস করা খুবই আরামদায়ক। গরমের দিনে ঠাণ্ডা আর শীতের দিনে ঘরে গরম অনুভুত হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে ৫টি মাটির ঘর ছিল। এখন আমার বাড়িতে দুটি মাটির ঘর আছে। বাকিগুলো ভেঙে পাকা দালান নির্মাণ করা হয়েছে।’

উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের খাটিঙ্গা গ্রামের রফিক মিয়া বলেন, ‘আগে আমাদের গ্রামের প্রতি বাড়িতেই মাটির ঘর ছিলো। বর্তমানে মাটির ঘরের সংখ্যা খুবই কম।’


বিজয়নগর উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বকুল বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে মানুষের আয়-রোজগার বেড়েছে। এছাড়া, বিদেশে গিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মানুষের রুচিবোধ সামাজিক মর্যাদাবোধও বড়েছে। তাই মানুষ এখন আর মাটির ঘরে বসবাস করতে চায় না। ফলে মাটির ঘর ভেঙে পাকা দালান নির্মাণ করা হচ্ছে।’

উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বেড়েছে। আয়-রোজগার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে সামাজিক মর্যাদাবোধ বেড়েছে। মানুষ এখন নিজের পরিবারিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তাই মানুষ এখন আর মাটির ঘরে বসবাস করতে চায় না।’ 

ঢাকা বিজনেস/এনই



আরো পড়ুন