১৮ মে ২০২৪, শনিবার



বিশেষ প্রতিবেদন
প্রিন্ট

শেয়াবাজারে কালো টাকা শর্তহীন বিনিয়োগের সুযোগ চান উদ্যোক্তারা

মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান || ০৯ মে, ২০২৩, ১২:০৫ পিএম
শেয়াবাজারে কালো টাকা শর্তহীন বিনিয়োগের সুযোগ চান  উদ্যোক্তারা


প্রতিবছরেই বাজেটে শেয়ারবাজারের উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাজারে খুব বেশি ইতিবাচক  প্রভাব পড়ে না বলে জানিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী ও  সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, শেয়ারবাজার তার নিজস্ব গতিতেই চলমান থাকে। তবে আসন্ন (২০২৩-২৪) অর্থবছরের বাজেটে সরকারের বিশেষ কিছু উদ্যোগ নেওয়া উচিত। যা শেয়ারবাজারের স্থিরতা ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

সাধারণ বিনিয়োগকারীরা জানান, বর্তমানে তারল্য সংকটে ভুগছে শেয়ারবাজারে। বিনিয়োগ খুবই কম। নতুন নতুন বিনিয়োগ খুব একটা আসছে না। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত আসন্ন বাজেটে যেন অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ শেয়ারবাজারে শর্তহীন বিনিয়োগের সুযোগ থাকে। অনেকেই আছেন, অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করে সেই টাকা দেশের কোথাও প্রদর্শন করতে পারেন না। বিনিয়োগও করতে পারেন না। ফলে তারা অনেক সময় বাধ্য হয়েই সেই টাকা বিদেশে পাচার করেন। অথচ তাদের যদি এই টাকা শর্তহীনভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া যায়,তাহলে অর্থপাচারের পরিমাণ কমে যাবে। পাশাপাশি পুঁজিবাজারের তারল্য সংকট কেটে যাবে।  

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার এবং অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হারের পার্থক্য মাত্র ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে এক্ষেত্রে বাদ রয়েছে ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, টেলিকম, টোবাকো  খাত। অর্থাৎ তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য কর রেয়াত মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এ কারণে উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চান না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে  এবারের বাজেটে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হারের পার্থক্য ১৫ শতাংশ করার দাবি জানান বিনিয়োগকারীরা।  তারা বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কমিয়ে আনতে পারলে ভালো মানের প্রতিষ্ঠানগুলোকে তালিকাভুক্ত করা যাবে, যার ফলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোয় অনেক বেশি প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন বিরাজমান; যা অধিক রাজস্ব আদায়ে সহায়ক হবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির করের হার এবং অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হারের পার্থক্য মাত্র ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ হওয়ায় দেশে রেজিস্ট্রার্ডভুক্ত লাখ লাখ কোম্পানি থাকলেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা মাত্র ৩৫৪টি।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুল হক ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘শর্তহীনভাবে এবারে বাজেটে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকতে হবে। এতে বাজারে তারল্য সংকট দূর হবে। পুঁজিবাজারে গতিশীলতা বাড়বে। পাশাপাশি বিদেশে অর্থ পাচার অনেকাংশে কমে যাবে। এখন কেউ যদি দুর্নীতি করে টাকা উপার্জন করে এবং তিনি যদি সেই টাকা দেশে ব্যবহার করতে না পারে; তাহলে বিদেশে পাচার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তাই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া হয় বাজেটে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কোম্পানি থেকে বর্তমানে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা লভ্যাংশ গ্রহণ করলে তার ওপর ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়। আমি চাই আসন্ন বাজেটে সেটি ১ লাখ টাকা করা হয়। অর্থাৎ ক্ষুদ্রবিনিয়োগকারীরা সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা ডিভিডেন্ড গেইন করলেই কেবল তার ওপর ইনকাম ট্যাক্স আরোপ করার বিধান রাখা উচিত বাজেটে।’ 

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি সায়েদুর রহমান ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘২০১১ সাল থেকে পুঁজিবাজার বিভিন্ন প্রকার প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যান্য আর্থিক সূচক ভালো থাকার পরেও পুঁজিবাজারে তা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি। আমরা মনে করি, পুঁজিবাজারকে পেছনে রেখে উন্নতির অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। তাই পুঁজিবাজারের গতিশীলতা আনয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’

সায়েদুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে মার্চেন্ট ব্যাংকের কর হার ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। ব্রোকারের কর হার ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির করের হার ১৫ শতাংশ। বর্তমানে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বৃহৎ কর অঞ্চলে আওতাধীন রাখা হয়েছে; যা হতাশাজনক। বাংলাদেশে বর্তমানে ৬৭টি মার্চেন্ট ব্যাংক কর্মরত আছে। পুঁজিবাজারের ধীর গতি, কোভিড-১৯ , ব্যবসার সীমাবদ্ধতা থাকায় বেশির ভাগ মার্চেন্ট ব্যাংকের অপারেটিং খরচ চালানোই সম্ভব হচ্ছে না। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে বৃহৎ কর অঞ্চলে যুক্ত করে জটিল ব্যবস্থাপনায় ফেলা হয়েছে। এ অবস্থায় মার্চেন্ট ব্যাংকারদের বৃহৎ কর অঞ্চলে রাখা এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো কর হার নির্ধারণ অযৌক্তিক এবং টিকে থাকা হুমকির সম্মুখীন। তাই, আমরা চাই আসন্ন বাজেটে মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট কর হার যেন ২৫ শতাংশ করা হয়।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, ‘বাজেট কাঠামোর মধ্যে যেন শেয়ারবাজারের উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্যাপিটাল মার্কেটের গুণগত সম্প্রসারণ যে প্রয়োজন, সেটা যেন এড্রেস করা হয় আসন্ন বাজেটে। বর্তমানে করপোরেট কর কর্তনের পর লভ্যাংশ দেওয়া হয়। লভ্যাংশ দেওয়ার সময় ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ হারে অগ্রিম কর কর্তন করা হয়। পরবর্তী সময়ে আবার লভ্যাংশ গ্রহীতার ব্যক্তিগত আয়কর রিটার্নের সময় তার ওপর প্রযোজ্য হারে কর প্রদান করতে হয়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ গ্রহণ না করে রেকর্ড ডেইটের আগেই বিক্রি করে দেয়। দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকে। যা বাজারকে অস্থির করে। তাই বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আগ্রহী করার লক্ষ্যে বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানীর লভ্যাংশের ওপর থেকে কর প্রত্যাহারের যেন সুযোগ থাকে।’

এদিকে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবং অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ভ্যাট হার একই অর্থাৎ ১৫ শতাংশ। বর্তমানে বহুপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা আছে তালিকাভুক্ত না হয়ে বিভিন্নরূপ সুবিধা ভোগ করছে। তাই পুঁজিবাজারের গতিশীলতা ও রাজস্ব বেশি পরিমাণে আদায়ের লক্ষ্যে বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ভ্যাট হার কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা। অর্থাৎ আসন্ন বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ভ্যাট হার কমিয়ে ১০ করার আহ্বান জানান তারা।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘আসন্ন বাজেট যেন পুঁজিবাজার বান্ধব হয়। বন্ড মার্কেটের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূর করতে ট্যাক্স ইনসেনটিভ দেওয়া যায় কি-না, বাজেটে সে ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন বাড়ানোর জন্য বর্তমানে লেনদেনের ওপর যে ট্যাক্স রয়েছে, তা যেন কমানো হয় বাজেটে।’



আরো পড়ুন