০৩ মে ২০২৪, শুক্রবার



বিশেষ প্রতিবেদন
প্রিন্ট

নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর হোক

বিশেষ প্রতিনিধি || ০৮ মার্চ, ২০২৪, ০১:০৩ পিএম
নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর হোক


আজ বিশ্ব নারী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়: ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ; এগিয়ে নিতে হবে বিনিয়োগ’। প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব নারী দিবস। কিন্তু এই দিবসকে কেন্দ্র করে সমাজের পেশাজীবী নারী কী ভাবছেন? এই চিন্তা থেকে ঢাকা বিজনেস কয়েকজন পেশাজীবী নারীর মুখোমুখি হয়েছে। তারা বলেছেন, তাদের স্বপ্নের কথা, পরিকল্পনার কথা। রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা। 

এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নিয়ে কথা হয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তা ইসরাত জাহান দিপার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে অনেকাংশ নারীই আছেন, যারা অবহেলিত। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রাম, দ্বীপ-হাওড়, উপকূলীয় ,পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছালেও নারীদের শিক্ষার হার খুবই কম। সুতরাং অবস্থান কিংবা পরিবেশগত দিক বিবেচনা করলে সব নারীই কিন্তু সম-অধিকার কিংবা সমসুযোগ সমানভাবে পাচ্ছে না। একজন নারী, শিক্ষা, মেধা, মননে শক্তিশালী জনসম্পদে পরিণত হতে পারে, যদি তার প্রতি বিনিয়োগ করা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক পরিবারে এখনো মেয়ে শিশু ও ছেলে শিশুর বিনিয়োগের তারতম্য অনেকগুণ। ছেলেকে নামকরা স্কুলে ভর্তি করা হয়। তার জন্য প্রাইভেট শিক্ষক রাখা হয়। মেয়ের বেলায় ঠিক উল্টো। বিনিয়োগের প্রথম ধাপেই বৈষম্য। এমন হাজারটা বৈষম্য সমাজে এমনভাবে গেঁথে আছে, যা  থেকে উত্তরণ একার পক্ষে সম্ভব নয়।’


ইসরাত জাহান দিপা

এই ব্যাংক কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘নারীর সমঅধিকার ও সমসুযোগ বাস্তবায়ন হলো দেশকে এগিয়ে নেওয়ার মূলমন্ত্র। আমাদের দেশে এমন কোনো পেশা নেই, যেখানে নারীর বিচরণ ঘটেনি। উড়োজাহাজ থেকে মেট্রোরেল পরিচালনায় নারী অবস্থান দৃঢ়। আবার সেই নারী ক্ষুধা নিবারণে শক্ত হাতে অটোরিকশা চালাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যখন নারী তার মর্যাদার লড়াইয়ে নেমে ছিল,চেয়েছিল ভালো বেতন, বেতনবৈষম্য দূরীকরন,কিংবা ছুটির ক্ষেত্রে অধিকার,ভোট দেওয়ার সুযোগ; তখন থেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষোভ মিলে আন্দোলন শুরু।’ 

দিপা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ধারণাটি নিউইয়র্কে ১৯০৮ সালের শ্রম আন্দোলন থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল। আজ এই শতাব্দীতে এসে অনেক নারীই বলছি, নারী দিবস কেন? কোনো পুরুষ দিবস তো নেই। তবে নারী কেন এই দিবস পালন করে নিজেদের ছোট করবো? আজ এই ভাবনাই প্রমাণ করে, আমরা এগিয়েছি। কারণ আমরা সমঅধিকার এবং সমসুযোগ পাচ্ছি বলেই আজ আর আলাদা কোনো দিনকে আমরা ভাবতে চাই না। তবে, আমার মনে হয়, এই ভাবনাটা এখনো মুষ্টিমেয় নারীর ভাবনা । যখন সব নারী এভাবে ভাবতে পারবে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে; তখনই সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত  তবে। তখন বিনিয়োগের সার্থকতা পাওয়া যাবে। আমরা যদি চিন্তা-চেতনায় উদার হই; সমআধিকার ও সমসুযোগ নিয়ে বেড়ে উঠি; তাহলে নারী-পুরুষ উভয়েই হবো দেশের মেধাবী ও দক্ষ মানবসম্পদ।’


                                                                                             সিফাত-ই-ফারহানা

ব্যাংক কর্মকর্তা সিফাত-ই-ফারহানা বলেন, ‘এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য খুব ভালো লেগেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, নারী উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। নারী একজন মানুষ। তার দক্ষতা, প্রতিভা সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে সম্পদের রূপান্তরিত করলে লাভবান হবে একটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। নারীকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে বিনিয়োগের শুরুটা হতে হবে পরিবার থেকে। নারীরা যখন পড়াশোনা করতে চায় বিজ্ঞান, গণিত, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, অর্থনীতি ও নানা চ্যালেঞ্জের বিষয়ে, তখন তাকে সে সুযোগটা দিতে হবে। বাল্যবিবাহ এখনো আমাদের রাষ্ট্রে শূন্যের কোঠায় পৌঁছায়নি। স্বাস্থ্যপুষ্টির ব্যাপারেও নারীরা রয়েছে অবহেলিত। শিক্ষার অনেক উচ্চপর্যায়ে বৃত্তি এবং আর্থিক সহায়তা দিতে হবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের। শুধু রাষ্ট্র নয় সমাজের অনেক বড় শিল্পপতি ও রাজনীতিবিদদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।’

ফারহানা আরও বলেন, ‘কর্মজীবনে নিজেদের দক্ষতা, পেশাগত দায়িত্ব পালন যেন সুন্দরভাবে করতে পারে সেজন্য ‘শিশু দিবা যত্ন কেন্দ্র’ আরও বাড়াতে হবে। প্রয়োজনের তুলনায় এ সংখ্যা অনেক কম। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে ভালো করার জন্য মেয়েদের লিডারশিপ ট্রেনিং এবং আরও নানা ধরনের পেশাদারি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে কাজের সুযোগ দেওয়া। ব্যবসার জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে, সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ করা যেতে পারে। যদিও সেটা আমাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।’

এই ব্যাংক কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মেয়েদের থাকার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ, নারী হোস্টেল তৈরি করা দরকার । বাংলাদেশের ৬১% নারী কর্মী রয়েছেন পোশাক খাতে। তাদের স্বাস্থ্যের এবং নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে । এছাড়া রয়েছে নিশ্চিন্ত পরিবহনের ব্যবস্থা অভাব। কর্মক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ভাতা এখনো সকল প্রতিষ্ঠান দিতে পারেনি, ৬ মাসের ছুটির ব্যবস্থাও করতে পারেনি । আমরা সবকিছুই খুব কম সংখ্যক অথবা সীমিত আকারে করেছি। এর পরিসর সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। মেয়েদের সৃষ্টিশীল কাজ অথবা উন্নয়নমুখী কাজ, প্রযুক্তিগত কাজের ব্যাপারেও সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। রয়েছে বিনিয়োগের প্রয়োজন। পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের উচিত মেয়েদের নানারকম অর্জনের স্বীকৃতি দেয়া ,কাজে উৎসাহ দেয়া।  মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করার পর রাষ্ট্র সমাজ কিংবা পরিবার তাদের উপর বিনিয়োগ করার পর আমার প্রচন্ডভাবে আত্মবিশ্বাস আছে এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে এর ফলাফল তারা দেখতে পাবে। কোন কাজটিতে তারা পিছিয়ে থাকবে, আকাশে প্লেন চালানো ,বড় বড় বাড়ির ডিজাইন করা, বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, ছবি আঁকা, বই লেখা, শিক্ষকতা করা, আরো কত শত পেশাগত দায়িত্ব তারা পালন করে চলেছে এবং ভবিষ্যতে করবে তা তো বলাই বাহুল্য তাই আবারও বলবো রাষ্ট্রের একটি বড় অংশ নারীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে এবং তাদের প্রতিভাকে কাজে লাগালে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাবে।’


তানিয়া তপু
সুপ্রিম কোর্টের তানিয়া তপু  বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের অধিকার  বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আমাদের  দেশে শিক্ষা অনেক  প্রসার লাভ করেছে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। একজন  নারী  যে একজন  মানুষ, সে বিষয়ে  সচেতনতার অভাব  রয়েছে। আমাদের  চারপাশে শুধু পুরুষই  নয়, নারীও তার  ঘরের কন্যা সন্তানকে পুত্র সন্তানের  চেয়ে  বঞ্চিত করে। যখন  কোনো  ছোট ছেলে বা মেয়ে পরিবারের  তাদের  মধ্যে  বৈষম্য  দেখতে  পায়, তখন ছেলেরা বড় হয়ে  মনে করে  সবকিছুই  তাদের  একার  অধিকার। আর এভাবেই সে তার  বোনকে   প্রাপ্য  অধিকার  থেকে বঞ্চিত করার  শিক্ষা  পরিবার  থেকে পায়।’  

প্রায় একই কথা বললেন, চাইল্ড হ্যাভেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চেয়ারপারসন নাঈমা পারভীন অনামিকা। তিনি বলেন, ‘সমাজের জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। তাই সার্বিক উন্নয়ন প্রসঙ্গটা এলে নারীদের উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। আর নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রথম যে ধাপ, সেটা হলো সমাজের সর্বস্তরে নারীর অধিকার এবং সুযোগের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা। বহুকাল ধরে সমাজে চলে আসা ধ্যান-ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গির বলয় থেকে বেরিয়ে এসে এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করা সহজ নয়। তবে অসম্ভবও নয়। যদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কথা বলি, তাহলে বলবো—পরিবর্তন এসেছে। আগের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ, ক্ষমতায়ন বেড়েছে। ফলে  সফলতার গল্পের সংখ্যাও বেড়েছে। তবে সেটা যথেষ্ট নয়। প্রকৃতপক্ষে এসব সফলতার গল্প দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যেকোনো প্ল্যাটফর্মে একজন নারী একজন পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমান যোগ্যতা নিয়ে কাজ করতে পারে। সফলও হতে পারে। ’


নাঈমা পারভীন অনামিকা

নাঈমা আরও বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য দেশের যেকোনো অর্থনৈতিক বিনিয়োগে নারী-পুরুষ বৈষম্যের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা এখনো দূর হয়নি। এখনো তীর্যক দৃষ্টিতে নারীর যোগ্যতাকে ছোট করে দেখার প্রবণতা আছে। তাই সামনে এগোনোর পথগুলো বেশ কঠিন হয়ে যায় একজন নারীর জন্য।  আমি আশাবাদী। তাই স্বপ্ন দেখি এসব বৈষম্য প্রতিবন্ধকতা কেটে যাবে একদিন। সম-অধিকার, সম-সুযোগ নিয়ে নারী এগিয়ে যাবে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। ত্বরান্বিত হবে সম-বিনিয়োগ, সবাই মিলে সমস্বরে গাইবে সফলতার গান, হাতে হাত ধরে সমান তালে বিজয়ের পতাকা ওড়াবে বিশ্বের দরবারে।’ 




আরো পড়ুন