আবারও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম বাড়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। রোববার (৩ ডিসেম্বর) এলপিজির দাম বাড়ার ঘোষণার পর সাধারণ ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ঢাকা বিজনেসকে তারা বলেন, প্রতিটি নিত্যপণ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এলপি গ্যাসের দামও লাগামহীন ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে জীবনযাপন খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। তারা ক্ষোভের সঙ্গে প্রশ্ন তুলছেন, এই দাম বাড়ার লাগাম টেনে ধরবে কে?
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, সরকার এলপিজি’র যে দাম বাড়িয়েছে তার থেকেও অনেক বেশি দামে সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রির পেছনে তারা (ব্যবসায়ীরা) নানারকম যুক্তি দেখাচ্ছেন। সরকার ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা না করেই এই দাম নির্ধারণ করেছে বলে তারা অভিযোগ করেছেন। এদিকে, দাম বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের মতো ফুটপাতে থাকা ছোট ছোট চায়ের দোকানদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তারা প্রভাব মুক্ত হতে প্রতিনিয়ত চায়ের দাম বাড়াচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে আরও জানা গেছে, দাম বেড়ে যাওয়ায় এলপি গ্যাসের ক্রেতা ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে। যেসব খুচরা ব্যবসায়ীরা গত মাসেও প্রতিদিন ৭০টি থেকে ৮০টি ১২ কেজি’র এলপি গ্যাস বিক্রি করেছেন; সেখানে এখন বিক্রি হচ্ছে ২০টি থেকে ২৫টি। সম্প্রতি অনেক ব্যবসায়ী প্রত্যেকদিন ১০টির বেশি এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সূত্রে জানা গেছে, ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ২৩ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪০৪ টাকা করা হয়েছে। অন্যদিকে অটো গ্যাস প্রতি লিটার ৬৩ দশমিক ৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৪ দশমিক ৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। রোববার (৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর কাওরান বাজারে বিইআরসি হল রুমে এ ঘোষণা দেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. নূরুল আমিন।
এর আগে, গত ২ নভেম্বর এলপিজির দাম ১ হাজার ৩৬৩ টাকা থেকে ১৮ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৩৮১ টাকা নির্ধারণ করা হয়। একইসঙ্গে বেসরকারি এলপিজির রিটেইলার পয়েন্টে ভোক্তা পর্যায়ে মূসকসহ মূল্য প্রতি কেজি ১১৫ টাকা ৯ পয়সায় সমন্বয় করা হয়।
সাধারণ ক্রেতারা জানান, রাজধানীর অনেক স্থানে সরকারি গ্যাসের সংযোগ থাকলেও গ্যাস ঠিকভাবে পাওয়া যায় না। ফলে এলপিজি’র ওপর অনেক পরিবার নির্ভরশীল। সেই এলপিজি’র দাম বাড়ানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গত মাসেও দাম বাড়িয়েছে সরকার। এভাবে প্রতিনিয়তই দাম বাড়তে থাকলে মানুষের পক্ষে এলপি গ্যাস কেনা দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়াবে।
মিরপুর-১-এর চা দোকানদার শাহজাহান বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়াতে আমি চায়ের দাম বাড়িয়ে দিয়েছি। ৫ টাকার লাল চা এখন ৬ টাকায় আমি বিক্রি করছি। আগের মতো কাস্টমারও নেই।’
রাজধানীর হীরামতি ট্রেডিংয়ের সেলস ম্যান আজাদ বলেন, ‘সরকার ব্যবসায়ীদের কথা না ভেবেই এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে। সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, সেই দামে এলপি গ্যাস বিক্রি করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের দোকানের ভাড়া, সেলসম্যানদের বেতন, ডেলিভারি চার্জ রয়েছে। ১২ কেজি’র প্রতিটি এলপি গ্যাস কমপক্ষে ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা লাভে বিক্রি করলে কিছু লাভ হয় আমাদের।’
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, ১২ কেজি’র এলপিজি পেট্রোমেক্স ১ হাজার ৩৫০ টাকা, পদ্মা ১ হাজার ৩৫০ টাকা ও বেক্সিমকো ১ হাজার ৪৭০ টাকায় ডিলারদের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা কিনছেন। আর তারা বিক্রি করছেন যথাক্রমে ১ হাজার ৪২০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকা, ১ হাজার ৪২০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকা ও ১ হাজার ৫২০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা।
পেট্রোম্যাক্স ও পদ্মা এলপি গ্যাসের ডিলার রাকিব ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘এলপি গ্যাসের ব্যবসা করে আমরা ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। সরকার আমাদের কথা চিন্তা না করে দাম নির্ধারণ করে। এখন ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। আমাদের অনেকেই এই ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, সেই দামে বিক্রি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণ ক্রেতা থেকে শুরু করে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘বিইআরসি এলপি গ্যাসের দাম যখন বাড়ায়, তখন আমরা সেখানে উপস্থিত ছিলাম না।’ তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘বিইআরসিকে কারা দায়িত্ব দিয়েছে, এভাবে এলপি গ্যাসের দাম বাড়ানোর। বেআইনিভাবে বিইআরসি এলপি গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে। তারা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এই কাজটি করে যাচ্ছে। আর যে কাজটি বেআইনি সেখানে সেই কাজের জন্য কারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেটা তো প্রশ্ন হতে পারে না। সাধারণভাবে আমরা সবাই জানি এলপি গ্যাসের দাম বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব বরাবরের মতোই সাধারণ ভোক্তাদের ওপরেই পড়ছে ও পড়বে।’
বিইআরসি সদস্য (গ্যাস) ড. মো. হেলাল উদ্দিন ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘কিছু প্যারামিটারের ওপর ভিত্তি করেই মূলত গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়। প্যারামিটারগুলোর মধ্যে রয়েছে ডলারের মূল্য ও সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দর। এবার আন্তর্জাতিক বাজারদর অপরিবর্তিত থাকলেও ডলার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় দাম বেড়েছে। তবে শীতের মধ্যে এই দাম আবার কমে আসবে।’
হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, ‘যারা বিইআরসির বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে এলপি গ্যাস বিক্রি করবেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ভবিষ্যতেও নেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১২ এপ্রিলের আগে পর্যন্ত এলপিজির দর ছিল কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীন। ১২ এপ্রিল দর ঘোষণার সময় বলা হয় আমদানিনির্ভর এই জ্বালানি সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে ভিত্তিমূল্য ধরা হবে। সৌদির দর ওঠা-ওঠা-নামা করলে ভিত্তিমূল্য ওঠানামা করবে। অন্যান্য কমিশন অপরিবর্তিত থাকবে। ঘোষণার পর থেকে প্রতিমাসে এলপিজির দর ঘোষণা করে আসছে বিইআরসি।
ঢাকা বিজনেস/এনই/