১৮ মে ২০২৪, শনিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

ধারাবাহিক

বুড়ি ও পরী

সরোজ মেহেদী || ২৭ জানুয়ারী, ২০২৩, ০৩:৩১ এএম
বুড়ি ও পরী


আজকে বাড়িতে উৎসব দাদু ভাই।    
-ও তাই। এ জন্যই বুঝি কুটনা বুড়িটা লাল কটকটী হয়েছে। ও মা একেবারে বিয়ের সাজুনি সেজেছে দেখি। 
কটকটী না টুকটুকি দাদুনি। 
-ও তাই! খুব সুন্দর লাগছে আমার দাদু ভাইকে। খুউব সুন্দর। একেবারে পরী। 

উৎসবের খবর দিতে দিতে দাদুর চেয়ারে গিয়ে বসে উলফাত। এরপর আয়নায় মুখ রাখে। লিপস্টিক ঠোঁট ছাড়িয়ে গালে এসে চিকমিক করে হাসছে। তুর্কিরা বলে তেবাসসুম হাসি। সে মুছতে গিয়ে জামায়-গতরে আরও বেশি করে মাখায়। বদনখানা জোকার সিনেমার দুঃখী নায়কের মতো সং বানিয়ে ছেড়েছে। যে মানে না কোনো বাধা। সব ভেঙে করে চুরমার। উলফাতের যেন আজ যেমন খুশি তেমন সাজের দিন।   

দাদু ভাই হেসে এগিয়ে এসে উলফাতকে কোলে তুলে নেয়। ও ছোট্ট মানুষ। না বোঝে সং সেজেছে। আর যারা বুঝেশুনে সং সাজে ঢং করতে। সেসব আমলা, রাজনীতিবীদ বা মোটিভেশনাল ম্যা-ওয়ালাদের কাছে লাজ শব্দটাই লজ্জা পেয়ে যায়। উলফাতরা যতদিন শিশু থাকে, ততদিন থাকে পবিত্র। বড় বানাতে বানাতে এ সমাজ তাদেরও বেহায়া জোচ্চোর বানিয়ে ছাড়ে।  

-কী উৎসব উলফু? তোমাকে দেখতে অসবে? এরপর বধূ করে নিয়ে যাবে।
-যাহ্ বলে দুই হাতে মুখ ডাকে সে। বিয়ের কথায় যেন লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।  
নানুরা আসছে। আম্মু রান্না শুরু করেছে। 
-ও তাই। তুমিও রান্না কর গিয়ে যাও। 
না আমি যাবো না। আমি তোমার কাছে থাকবো।

এই জানুয়ারিতে সাতে পড়বে উলফাত। সেই সঙ্গে উঠে যাবে ক্লাস টুতে। এক একে এক, দুই একে দুই নামতা পড়ার দিন। ‘ভোর হলো দোর খোল/ খুকুমনি উঠরে’ ছড়া কাটার, বেহুদা চিমটি কেটে ঝগড়াঝাটির জীবন। মেয়েরা নাকি বয়সের আগে বাড়ে। বোঝার সময় আসার আগেই অনেক কিছু বুঝে ফেলে। এরা বাড়ে আগে, বুড়োও হয় আগে। উলফাতের আচরণ মেয়ে সুলভ না ছেলে সুলভ। এখনো যেন সেই শিশু। এই হিহি হাসেতো মন মতো না হলে কাঁদে। তার হাসি ও কান্নার বাক্স হলো দাদু আজফর আলী। রোজ নিয়ম করে স্কুলে যাওয়ার আগে দাদুর ঘরে আসা চাই। স্কুল থেকে ফিরেও দাদুকে একবার দেখা চাই। সন্ধ্যা হলে দাদুর রুমে বসে বসে পড়বে। মা বকলেও কাজ হয় না। মেয়েটা হয়েছে দাদু অন্তপ্রাণ। দাদু যেন তার শৈশবের বিশাল আকাশ। সে দাদুকে শাসন করে। না শুনলে কাকলী ফুপ্পিকে ফোন দিয়ে অভিযোগ জানায়। বড্ড পাগলাটে এক শিশু মন। এমন টলটলা নদীর মতো মেয়েদের কপালে নাকি দুঃখ থাকে! আজফর আলী ভাবতে গিয়ে আঁতকে ওঠেন। 

৭৮ বছর বয়সী আজফরের জীবনের একমাত্র সঙ্গীও উলফাত। এই মেয়েটা না থাকলে কিভাবে দিন কাটত ভেবে আনমনা হন। মেয়েটা শিশু থাকতে থাকতেই যেন ওপারের ডাক আসে এই কামনা করেন। চলে গেলে বেঁচে যাই ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। আবার মন খারাপও হয়। ইসলাম ধর্মে নিজের মৃত্যু কামনা করার কথা ভয়াবহভাবে নিষেধ করা আছে। হাদিসে নাকি বলা হয়েছে, বান্দা স্বেচ্ছা মৃত্যু চাইলে আল্লাহ-তা’আলা বেজার হোন। এই জীবন নিয়ে তার খুব, খুব দুঃখ আছে, আছে বোবা কান্নাও।

প্রতিদিন সকালে নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে দুঃখ ভোলার বৃথা চেষ্টা করেন। আল্লাহর কাছে শান্তি কামনা করে শান্ত থাকার ভান ধরেন। তবু যেন দিন কি দিন বেঁচে থাকাটা কঠিন ও অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। একা হতে হতে নিজের চিবুকের কাছেও অচেনা আর একা হয়ে যাচ্ছেন। এমন জীবনের ভার বয়ে নিয়ে যাওয়া বড্ড ক্লান্তিকর। দীর্ঘ বিস্বাদের এক বুড়ো জীবন। কতকছিুর জন্য তার বেয়াড়া হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু উপায় নেই। শরীর আর কোনোকিছুতে সায় দেয় না। সকালের ভালো শরীর বিকেলে কেন খারাপ হয়ে যায় বোঝা যায় না। হায় সময়। হায় সময়। এজন্যই বোধহয় আল্লাহ কোরআনে সময়ের কসম কেটেছেন। মানুষকে করেছেন সতর্ক। হায় সময়। হায় সময়।

চলবে...



আরো পড়ুন