২৬ জুন ২০২৪, বুধবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

কবি ওমর আলী ও কয়া গ্রাম

রকিবুল হাসান || ২৬ জুন, ২০২৩, ০৩:০৬ পিএম
কবি ওমর আলী ও কয়া গ্রাম


০১.
কবি ওমর আলীর সরাসরি ছাত্র হওয়ায় তাঁর ওপর অনেক অধিকার সহজেই খাটাতে পারতাম। তিনি  খুশিমনে তা মেনেও নিতেন। এরকম অধিকারবোধেই নব্বইয়ের দিকে তাঁকে নিয়ে কুষ্টিয়া শিল্পকলা অ্যাকাডেমি মিলনায়তনে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি। তখন আমাদের একটা সাহিত্য সংগঠন ছিল, ‘কলকণ্ঠ সাহিত্য অ্যাকাডেমি’। আমি সংগঠনের সভাপতি। তখন অনার্সের ছাত্র। এই সংগঠনের উদ্যোগেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। 

 আমাকে একরকম ধমক দিয়ে আকমল চাচা বললেন, ‘তুমি এতবড় একজন বিখ্যাত মানুষকে গ্রামে নিয়ে এসেছ, আগে আমাদের একটু বলবা না!’ তাঁদের এমন আন্তরিকতায় কবি খুব মুগ্ধ হন। 

অনুষ্ঠানের দুদিন আগে কবি ওমর আলী পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ থেকে বদলি হয়ে সিরাজগঞ্জ সরকারি ইসলামিয়া কলেজে যোগদান করেছেন, সে খবর আমার অজানা। অনুষ্ঠানের একদিন আগে তাঁর চরকোমরপুরের বাড়িতে গিয়ে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে, তিনি সিরাজগঞ্জে। আমি অচেনা সিরাজগঞ্জ শহরে ছুটি। তারপর অনেক চেষ্টায় অতিসাধারণ এক হোটেলে তাঁকে আবিষ্কার করি। তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন আমার অনুষ্ঠানের কথা, ভুলে গেছেন তিনি এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি। তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। স্যারকে নিয়ে ছুটি স্টেশনের দিকে। বেশ রাত করেই ঈশ্বরদী পৌঁছানোর পরে তিনি অত রাতেই গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন। বললেন, ‘রকিব, আমি গৃহকাতর মানুষ। বাড়িতেই যাই। কাল দুপুরের ভেতর তোমার অনুষ্ঠানে চলে আসবো।’ তিনি চলে গেলেন। ভয়টা আমার থেকেই গেলো, তাঁর যে ভুলো মন! তিনি কিন্তু পরের দিন আর ভোলেননি, ঠিক সময়েই এসেছিলেন।

০২.
কবি ওমর আলী প্রধান অতিথি। বিশেষ অতিথি কে? সেটার একটা ইতিহাস আছে। কবি ওমর আলীকে প্রধান অতিথি করে আমরা বিশেষ অতিথির জন্য সে সময়ে কুষ্টিয়ার দু-তিন জন কবি-সাহিত্যিক-অধ্যাপকের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। সেসময়ে শহরে এমনকি জাতীয় পর্যায়েও তাঁরা সুপরিচিত। কেউই কবি ওমর আলীর সঙ্গে বিশেষ অতিথি হতে সম্মত হননি। বরং মৃদু তিরস্কৃত হয়েছি তাঁদের কাছে। আমরা তখন অসহায় অবস্থায় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কবি রেজাউল হককে বিশেষ অতিথি হওয়ার অনুরোধ করি। তিনি বললেন, ‘অত বড় কবির সঙ্গে আমার বিশেষ অতিথি হওয়া কি ঠিক হবে?’ আমাদের করুণ অবস্থা বিবেচনা করে তিনি সম্মত হন। আর একটা ব্যাপারও ছিল, সেসময় কোন কোন কবি আশা করেছিলেন, আমার তাঁদের আমন্ত্রণ জানাবো বিশেষ অতিথি হিসেবে। কিন্তু আমরা তা না করায়, তাঁরাও অনুষ্ঠানে আসেননি। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি নাসের মাহমুদ, কবি খৈয়াম বাসার, প্রফেসর ড. সরওয়ার মুর্শেদ প্রমুখ। তখন  সরওয়ার মুর্শেদ প্রফেসর ড. হননি। রেজাউল হক স্যার শেষপর্যন্ত কী ভেবে অনুষ্ঠানে আসেননি। উপস্থিত কবি খৈয়াম বাসারকে বিশেষ অতিথি করা হয়। তিনি আনন্দের সঙ্গে তা গ্রহণ করেছিলেন। 

০৩.
অনুষ্ঠান যখন শেষ হয়, তখন বেশ রাত। ৯টা পেরিয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা। রাতে পানসি নৌকায় স্যারকে কয়া গ্রামে নিয়ে আসি। সেটা কবির ইচ্ছেনুসারেই। কুষ্টিয়ায় ভালো হোটেলে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করলেও, তাঁর সেখানে থাকতে রাজি হননি। বলেছেন, ‘তোমার গ্রামে থাকবো। ওটা বিপ্লবী বাঘা যতীন আর ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের গ্রাম। ঐতিহাসিক একটা গ্রাম।’ তিনি তাই-ই করেছিলেন। কয়া গ্রামেই থেকেছিলেন। 

সকালে কাঁচারোদে তাঁর লুঙ্গি আর জামা পরে গ্রাম ঘুরতে বেরুলেন। তাঁর সঙ্গে আমি। দেখে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই, কত বড় একজন বিখ্যাত লোক এত অতি সাধারণ হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। খানিকটা যেতেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আমরা একটা ঝোপঅলা তেঁতুল গাছের নিচে দাঁড়াই। ইয়াকুব আলী চাচা খুব অনুরোধ করলেন, তাঁর ঘরে বসার জন্য। তিনি বললেন, ‘একটু ভিজি। ‘  বৃষ্টি কমতেই আবার হাঁটি। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের বাড়ি দেখে আমরা কয়া বাজারে আকমল চাচার দোকানের সামনে যেতেই তিনি কবিকে সালাম দিলেন। তখন ওখানে বসে চা খাচ্ছিলেন, কয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক গুরুদাস দত্ত। তিনিও দাঁড়িয়ে গেলেন কবির সম্মানে। তখনো তাঁরা জানতেন না, ‘ইনি কে?’ আমি পরিচয় করে দিতেই তাঁরা একরকম আঁতকে উঠলেন। কিভাবে আপ্যায়ন করবেন, কিভাবে সম্মান জানাবেন, একরকম অস্থির হয়ে উঠলেন। আমাকে একরকম ধমক দিয়ে আকমল চাচা বললেন, ‘তুমি এতবড় একজন বিখ্যাত মানুষকে গ্রামে নিয়ে এসেছ, আগে আমাদের একটু বলবা না!’ তাঁদের এমন আন্তরিকতায় কবি খুব মুগ্ধ হন। 

ওরা সবাই একদিন বিখ্যাত হবে। তুমি তখন বেঁচে থাকলে বলতে পারবে, ওরা একদিন আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছিল। ওদের জন্য আমার দোয়া ছিল।’

আমরা আবার হাঁটতে থাকি। বাঘা যতীনের বাড়ির দিকে। পালপাড়ার ভেতর ঢুকতেই বৃষ্টিটা হুট করে এবার একটু জোরেই নামলো। একটা খোলা ঘরের কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, একটু দাঁড়ান। বৃষ্টিটা যাক।’ তখন খোলা ঘরের ভেতর কয়েকটা বাচ্চা খেলা করছিল। কবি বললেন, ‘আমরা ঢুকলে বাচ্চাদের খেলাটা নষ্ট হয়ে যাবে। ওরা খেলুক।’ কবি ঢুকলেন না। বৃষ্টিতে আমরা ভিজে ভিজে হাঁটতে থাকি। 

বাঘা যতীনের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, তিনি খুব হতাশ হলেন। তাঁর কোনো স্মৃতি নেই দেখে, খুবই মন খারাপ করে বললেন ‘তোমরা উনার বাড়ির একটা ইঁটও রাখোনি? তোমরা কি জানো না উনি কত বড় বিখ্যাত বিপ্লবী?’ আমার কোনো উত্তর থাকে না। 

০৪.
আমাদের ফেরার সময় হয়। ফিরে আসি। খাবারের পর্ব শেষ হয়। কবি চলে যাবেন নিজের বাড়িতে, শিলাইদহ ঘাট হয়ে পাবনার চরকোমরপুর। এবার আমার সঙ্গে অনেক বন্ধু। কবি এগিয়ে দেওয়ার জন্য কবির সঙ্গে সবাই হাঁটতে থাকি। কয়া ত্রিমোহিনীতে এসে দাঁড়াই। সবাই। ওখান থেকে ভ্যানে যেতে হবে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি ছুঁয়ে শিলাইদহ ঘাটে। কবি কী ভেবে আকাশের দিকে তাকালেন। তাঁর দুচোখের কোণ ভেজা। আচমকা ভেজাকণ্ঠে বললেন, ‘আমি এক সময় অনেক খেতে পারতাম, তখন খাবার পাইনি। এখন আমি খেতে পারি না, এখন আমার কত টাকা।’ বলেই শিশুর সারল্যে বুকপকেটে হাত দিয়ে দেখালেন, ‘দেখো আমার পকেটভর্তি টাকা। কিন্তু আমি এখন ইচ্ছে করলেই খেতে পারি না।’ 

মুহূর্তেই আমাদের সবার মনটা খারাপ হয়ে যায়। পুরো মেঘটা কেমন ভারী হয়ে ওঠে। আমরা সবাই ভ্যানে উঠি। কবির সঙ্গে আমি এক ভ্যানে। আমার সঙ্গে সুমন। এখন সে ব্যারিস্টার। ভ্যান একটু এগুতেই আমি ভ্যানচালকে ভ্যানটা রাখতে বলি। আমি নামি। বাম পাশে তাকিয়ে একটা কবর দেখিয়ে কবিকে বলি,’স্যার, এটা আমার মায়ের কবর।’ মুহূর্ত দেরি না করে তিনি ভ্যান থেকে নেমে আমার মায়ের কবরের দিকে বিমর্ষ চোখে তাকিয়ে থাকেন। আমি জানি তিনি আমার থেকেও ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন। হয়তো সেই বেদনাটাই নতুন করে ক্ষণিক মুহূর্ত স্যারকে বিমর্ষ করে তোলে, আমার মায়ের কবর।

০৫.
আমাদের যে কী হলো একটু একটু করে তাঁকে এগিয়ে দিতে দিতে শেষপর্যন্ত আমরা দশ-বারোজন বন্ধু স্যারের সঙ্গে তাঁর বাড়িতেই চলে যাই।  কবির স্ত্রী সহিদা খাতুনকে সবাই সালাম করি। তিনি খুব খুশি হন। গর্ব করে বললেন, দেখছ কতগুলো ছেলে তোমাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। ওরা সবাই একদিন বিখ্যাত হবে। তুমি তখন বেঁচে থাকলে বলতে পারবে, ওরা একদিন আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছিল। ওদের জন্য আমার দোয়া ছিল।’

আমাদের চোখে পানি চলে আসে। কবির চোখও তখন ভেজা। মমতাময়ী মাতৃসম সহিদা খাতুনের হাত তখন আমাদের সবার মাথায় মাথায় ঘুরছে। 



আরো পড়ুন