২৫ জুন ২০২৪, মঙ্গলবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

বাইসাইকেল আরোহীদের পান্তাবেলা

মোহাম্মদ নূরুল হক || ২৫ মে, ২০২৪, ০৪:০৫ পিএম
বাইসাইকেল আরোহীদের পান্তাবেলা রাইড শুরুর আগে রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে মিটিং


আমরা যারা কর্মজীবী, কাজ করি সমাজ-রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, তাদের জীবন সাধারণত দুই শিফটেই বাঁধা। এক শিফট পরিবারের দায়িত্ব পালন, অন্য শিফট কর্মস্থলের কার্যসম্পাদন। বাসা টু কর্মস্থল, এর বাইরে আমাদের অনেকেরই কোনো জগৎ নেই। এই কঠিন রুটিনবাঁধা জীবনযাপনে অনেকেই হাঁপিয়ে উঠলেও মুক্তির উপায় কী? সেই উপায় বের করলো বাইসাইকেল চালকদের সংগঠনগুলো। তেমনই একটি বহুল জনপ্রিয় সংগঠন ‘হেমন্ত রাইডার্স’। সংগঠনের ফেসবুক গ্রুপ থেকে অ্যাডমিন একদিন ঘোষণা দিলেন, ‘২৪ মে, শুক্রবার পান্তা রাইড’ হবে। শুক্রবার সকাল ৬ টা ২০ মিনিট রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউস্থ রাজধানী উচ্চবিদ্যালয়ে সামনে থেকে রাইডিং শুরু হবে। গন্তব্যস্থল ‘ধলেশ্বরী ক্যাম্পিং ও কায়াকিং’। বিষয়টি গত ১৪ মে আমাকে জানালেন সাইক্লিস্ট কায়সার আহমেদ ভাই। এরপর একটি ফরমের লিংক দিলেন। ফরমটি পূরণ করলাম। এরপর অপেক্ষার পালা। দিন যায়, রাত যায়, ২৪ মে যেন আর আসতে চায় না। ভেতরে ভেতরে প্রথম প্রেমে পড়ার মতো উত্তেজনা কাজ করছে। কিন্তু কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারছি না। এর কারণও আছে।  

ছুটে চলেছে হেমন্ত রাইডার্স

আমার চারপাশে বিষয়টি নিয়ে শেয়ার করার মতো কেউ ছিলেন না। যারা আমার মতো সাংবাদিকতায় রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই অফিসের প্রাইভেটকারে চলাফেরা করেন। বাইসাইকেল চালান না। যদিও নিজের প্রাইভেটকার নেই, তবু অনেকেরই আবার বাইসাইকেলের প্রতি নাকসিঁটকানো স্বভাবও রয়েছে। আর প্রাইভেটকারের প্রতি রয়েছে অসনীয় মোহ। এর বাইরে পরিচিতজনদের মধ্যে কেবল কায়সার ভাই-ই বাইসাইকেলে চলাফেরা করেন। যদিও তাঁর নিজেরই প্রাইভেটকার রয়েছে। তিনি আবার এসব রাইডে অভিজ্ঞ ও পুরনো মানুষ। ফলে তাঁর সঙ্গে নিজের ভেতরের উত্তেজনার বিষয়টি শেয়ার করতে বিব্রতবোধ করছিলাম। 

রাইড থামিয়ে পাড়াগ্রাম ব্রিজে ছবি ‍তুলছেন কায়সার আহমেদ

অনেক অপেক্ষার পর অবশেষে এলো আবেগে থরোথর বৃহস্পতিবার রাত। ওই রাতে কায়সার ভাইকে ফোন দিলাম। ওই পাশ থেকে হ্যালো বলতেই, আমি বিনয়ে বিগলিত। ভাই সম্বোধন না করে বলি, স্যার, কাল তো রাইড। কী কী পরবো, একটু ইনস্ট্রাকশন দিন। কায়সার ভাই যেন আমার ফোনেরই অপেক্ষায় ছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একান্ত অনুগত ছাত্র পেয়ে প্রধান শিক্ষক হয়ে গেলেন কায়সার ভাই। বললেন, হেলমেট, গ্লাভস পরবেন। সকাল ৬টার মধ্যেই রাজধানী স্কুলের সামনে হাজির হবেন। বললাম, সঙ্গে টাকা-পয়সা কিছু নিতে হবে নাকি? তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। এরপরই তার গম্ভীর গলা শোনা গেলো। যেন তিনি মহাভারতের ভীষ্ম। অভিমন্যু যখন ভীষ্মকে পিতামহ বলে সম্বোধন করে, তখন ভীষ্ম বলেন, পৌত্র আমি তোমার পিতামহেরও পিতামহ। তেমনি কায়সার ভাইও যেন বোঝাতে চাইলেন, ‘টাকা-পয়সা নিয়ে এত ভাবতে হবে না। আমি আছি কী করতে?’ তার এমন মনোভাবে আমিও নির্ভার, যেমন নির্ভার বিশাল থাকে বটবৃক্ষের শাখায় মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়া স্বর্ণলতা। 

ইঞ্জিনচালিত নৌকায় পার হওয়ার সময়

সে যাই হোক, কায়সার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ঘুমুতে গেলাম। মোবাইলফোনে অ্যালার্ম দিলাম ভোর সোয়া চারটা। কিন্তু আমার ঘুম ভেঙে গেলো পৌনে চারটায়। কী আর করা, প্রত্যাশার আগেই ফল পেলে সাধক যেমন কৃতজ্ঞতায় ফলদাতার প্রতি নুয়ে আসেন, আমিও তেমনি আবেগে থরোথরো। উঠে বসলাম।   আমার রকরাইডার বাইসাইকেলটির চেইন পরিষ্কার করলাম। এরপর লুব করলাম। যেন সাইকেল স্মুথলি চলে, আর গতিতেও সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি। 

পাড়াগ্রাম ব্রিজে গ্রুপ ছবি

হেমন্ত রাইডার্সের লোগোযুক্ত টিশার্ট, আর জিন্স পরলাম। বেল্টঅলা স্যান্ডেল পরতে পরতেও পরলাম না। কী বুঝে পরলাম লোপাস। ভোর পাঁচটা বাজতেই বের হয়ে পড়লাম বাসা থেকে। ৫০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মানিকমিয়া এভিনিউ। দেখি, আমার আগে মাত্র দুজন এসেছেন। এরপর কিছুক্ষণ পর এলেন আরও একজন। তাঁদের কাউকেই আমি চিনি না। আমাকেও তাঁরা কেউ চেনেন না। ধীরে ধীরে পরবর্তী ২০ মিনিটের মধ্যে শতাধিক রাইডার এসে হাজির হলেন। এত এত মানুষের ভিড়ে আমার চোখ খুঁজে চলেছে কায়সার ভাইকে। দেখি তিনি ভিড়ের মধ্যে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছেন। এগিয়ে গেলাম। আমার পায়ের দিকে তাকিয়েই তিনি মুচকি হেসে বললেন, কী ব্যাপার, লোপাস কেন? এবার বেশ লজ্জা পেলাম। একথা-সেকথার পর গ্রুপ লিডার ঘোষণা দিলেন রাইড শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যে। 

পান্তাপর্বের আগে শরবত বিতরণ

৬ টা ৪০ মিনিটে রাইড শুরু হলো। মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে আসাদ গেট হয়ে মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড। এরপর বেড়িবাঁধ চৌরাস্তা দিয়ে সোজা পশ্চিমমুখী চললো হেমন্ত রাইডার্স। পাশেপাশে চললো দুটি মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল আরোহীরা মূলত রাইডার্সদের জন্য পথ ট্র্যাফিকমুক্ত রাখার কাজসহ নানা রকম দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। বছিলা ব্রিজ ছিল কিছুক্ষণের জন্য মিটিং পয়েন্ট। এরপর বছিলা ব্রিজ থেকে নেমে সোজা ঘাটারচর। মধুসিটি হয়ে জয়নগর তিন রাস্তার মোড় পৌঁছালাম। জয়নগর তিন রাস্তার মোড় থেকে ডানে ভাওয়াল হয়ে কলাতিয়া বাজার। রাস্তার দুই পাশে যেমন দোকানপাট, তেমনি ঘরবাড়ি। আবার মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে ফসলের ক্ষেত। আমরা কলাতিয়া বাজার হয়ে ঢালিকান্দি ব্রিজ পার হয়ে হযরতপুর বাজারের দিকে ছুটে চলেছি। মাঝখানে নদীর পাড়ে একটু বিশ্রাম। গ্রুপ ছবি তোলা হলো বেশ কিছু। এরপর আবার যাত্রা। হযরতপুর বাজারে গিয়ে বামে মোড় নিয়ে হযরতপুর ব্রিজ পার হয়ে পাড়াগ্রাম বাজারে ঢুকে গেলাম। রাস্তার দুই পাশে কৌতূহলী চোখগুলো দেখতে দেখতে আমাদের দল এগিয়ে চললো গন্তব্যের দিকে। পাড়াগ্রাম বাজার থেকে বামে মোড় নিয়ে পাড়াগ্রাম ব্রিজে আবার যাত্রা বিরতি। এই যাত্রাবিরতির সময় তোলা হলো বেশকিছু গ্রুপ ছবি। ব্রিজ থেকে নেমে বামে মোড় নিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে চলেছি ধলেশ্বরী নদীর পাড়ের খেয়াঘাটে। খেয়াঘাটের পাশে শির উঁচু করা নিঃসঙ্গ শেরপার মতো দাঁড়িয়ে আছে একটি গভীর নলকূপ। দীর্ঘসময় মগজগলা রোদে রাইডিং করতে করতে গলা শুকিয়ে চৈত্রের ঠা-ঠা মাঠ তখন। গভীর নলকূপ দেখেই তৃষ্ণা যেন চাতক পাখির মতো প্রবল হয়ে উঠলো। আমার পানির বোতল ভরে নিলাম নলকূপের পানি। এমন সুস্বাদু পানি বহুদিন পান করিনি। 

ভেনুতে পান্তার অপেক্ষায়

এবার ধলেশ্বরী নদী পারের অপেক্ষায়। উপায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা। তিন পর্বে আমরা সবাই নদী পার হয়ে পৌঁছালাম পূর্বনির্ধারিত ভেনু ‘ধলেশ্বরী ক্যাম্পিং ও কায়াকিংয়ে।’ ভেনুতে পৌঁছেই তৃষ্ণার্তদের জন্য পাওয়া গেলো গুড়ের শরবত। এরপর কেউ ধলেশ্বরী ক্যাম্পিংয়ে শুয়ে, কেউ বসে গান ধরলো। কেউবা ঘুরে ঘুরে দেখলো নদীপাড়া, পাড়ের মানুষ, ফসলের ক্ষেত। আমগাছ, সবজির বাগান। কেউ বা ব্যস্ত হয়ে পড়লো পান্তা ব্যবস্থায়। এরপর এলো পান্তা খাওয়ার কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। সবার লাইন ধরে একে একে চলেছি বিতরণকারীর দিকে। বিতরণকারী আমাদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন চমৎকার মাটির বাসনে পান্তা। সঙ্গে ডিম ভাজি, আলুভর্তা, শুকনো মরিচ, ডাল ভর্তা। এরপর আরেক বিতরণকারী আমাদের হাতে হাতে তুলে দিলেন চমচম। 

কোনো তাড়াহুড়ো নেই, সবাই যেন পুরাণের ঋষি। সবার মুখাবয়বে একটি শান্ত-সৌম্য কান্তি ভেসে উঠলো। তাঁরা ধীরে, খুব ধীরে পরম তৃপ্তির সঙ্গে পান্তা আহার সারলেন। এরপর চমচম। চমচম নিয়ে একটি ঘটনা আছে এখানে। চমচম পান্তা রাইডের মেনুতে ছিল না। চমচম পেলাম বাইকশপ বিডির মালিক সাইক্লিস্ট শাকিল ভাইয়ের সৌজন্যে। তিনি সদ্য কন্যাসন্তানের জনক হয়েছেন। সেই মিষ্টি।  তবে, ভাবি হাসপাতাল থাকায় তিনি পান্তা রাইডে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছেন।  সব শেষে ছিল চা। চা-পর্ব শেষে ছবি তোলা। 

সেলফিতে কায়সার আহমেদ ও মোহাম্মদ নূরুল হক

পান্তা রাইডের পান্তা খাওয়া শেষ। এবার ভাঙলো মিলনমেলা। কেউ কেউ নিজের মতো করে ফিরতি পথ ধরলেন। তবে, যে পথে গন্তব্যে পৌঁছালাম,  ফেরার সময় সেই পথ ধরলেন না কেউ। ধরলেন বিকল্প পথ। ফেরার পথে ঢালিকান্দি বাজার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে কলাতিয়া বাজার। এরপর জয়নগর তিন রাস্তার মোড় থেকে বামে মোড় নিয়ে ঘাটারচর। ঘাটারচর হয়ে বছিলা ব্রিজ থেকে নেমে বেড়িবাঁধ চৌরাস্তা হয়ে মোহাম্মদপূর বাস স্ট্যান্ড দিয়ে আসাদগেট।  দীর্ঘ বহরের একসঙ্গে রাইডের আপাত শেষ স্টেশন এই আসাদ গেট। সেখান থেকে আমি চলে এলাম গুলশান-১ নম্বরে পুলিশ প্লাজার কাছে আমার কর্মস্থল ঢাকা বিজনেস কার্যালয়ে। সঙ্গে নিয়ে নিয়ে এলাম ৬৪ কিলোমিটার সাইকেল ভ্রমণের এক অপূর্ব অনুভূতিমাখা অভিজ্ঞতা। বহুদিন মনে থাকবে এই হেমন্ত রাইডার্সের পান্তাবেলা ‘পান্তা রাইড’।



আরো পড়ুন