২৫ জুন ২০২৪, মঙ্গলবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

হেমন্ত রাইডার্সের একদিন সারাদিন

মোহাম্মদ নূরুল হক || ১০ জুন, ২০২৪, ০৬:০৬ পিএম
হেমন্ত রাইডার্সের একদিন সারাদিন


হেমন্ত রাইডার্স-এর মোহাম্মদ হেদায়েতুল হাসান ফিলিপ ভাই কদিন আগে ঘোষণা দিলেন ৭ জুন (শুক্রবার), লিচু রাইড। গ্রুপ যাবে গাজীপুরের পিরুজালী। পোস্ট দেখে যথারীতি তিন জনকে নক দিলাম। প্রথমত কায়সার ভাই, এরপর আলতাফ ভাই এবং সব শেষে হাসান ভাইকে। কায়সার ভাই যাবেন না জানালেন। তবে, বললেন, ‘আমার দোস্ত জেফরী যাবেন’। আলতাফ ভাই বললেন, ‘আপনি গেলে আমিও যাবো’।  হাসান ভাই নীরবতাকেই ব্রত মানলেন।


৬ জুন বৃহস্পতিবার রাতে সাইকেল গ্যারেজে গেলাম। মেকানিককে বললাম, আমার সাইকেলের চেইন-ক্যাসেট ভাইব্রেট করছে। ঘটনা কী, দেখুন তো।  তিনি দেখে বললেন, ৫/৬ নম্বর কাঁটা ক্ষয় হয়ে গেছে। তবে আরও ছয় মাস চালাতে পারবেন। বললাম, না। চেঞ্জ করে দিন। এরআগে অবশ্যই প্যাডেলও চেঞ্জ করলাম। চেঞ্জ করলাম সিটপোস্টও। সবমিলিয়ে খরচ পড়লো ৬,৫৫০ টাকা। এরপর নিলাম সিএসটি টিউব, প্যাচকিট, সল্যুশন আঠা, টায়ার লিভার। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত একটা। দুটায় ঘুমাতে গেলাম। মোবাইলফোনে ভোর চারটার অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম। চারটা বাজতেই উঠে গোসল। এরপর টিউব-রেইনপঞ্চ-প্যাচকিট সরঞ্জাম ভরে নিলাম ব্যাকপ্যাক ও স্যাডলব্যাগে। সঙ্গে নিলাম দুই প্যাকেট মিনি গ্লুকোজ, দুই প্যাকেট স্যালাইন। আর দুটি পানির বোতল। ভোর ৫টা বাজতেই বের হলাম। একঘণ্টা প্যাডেলিং শেষে পৌঁছে গেলাম মানিক মিয়া এভিউনিতে রাজধানী উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে। আমার আগে সেখানে দুজন পৌঁছেছিলেন। এরপর জেফরী ভাই এলেন। বললেন, ‘আলতাফ ভাই কই? কল দেন।’ আলতাফ ভাইকে কল দিতেই জানালেন, তিনি লাল বাগ থেকে পলাশী পর্যন্ত এসেছেন। 


সবাই এসে গেলে এই রাইডের লিডার আসিফ ভাই রাইড শুরুর ঘোষণা দিলেন। রাইডাররা এগিয়ে চললেন জাতীয় সংসদদের পূর্বপাশের রাস্তা ধরে আগারগাঁও হয়ে মিরপুর ১২, মেট্রোরেল উত্তরা উত্তর, হাউজ বিল্ডিং। আমরা ছুটে চলেছি ‘দুই চাকার ছন্দে, নব আনন্দে’। কেউই গলা ছেড়ে না গাইলেও মনে মনে অনেকেই হয়তো গেয়ে উঠেছেন, ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে উইড়া-উইড়া’। আর কারও মনে বাংলা সিনেমার সোনালি যুগের এই গান বেজে উঠেছিল কি না, জানি না। কিন্তু আমার মনে বেজে উঠেছিল। আর তখনই ছন্দপতনটাও ঘটলো। হঠাৎ আমার মনে হলো, পেছনের চাকা দুলছে। ঘটনা কী? বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে একজন বললেন, ‘ভাই আপনার চাকা পাংচার’। কী আর করা, কষলাম ব্রেক। অন্য সময় হলে এই হার্ডব্রেকের কারণে কাৎ হয়ে পড়ে যেতাম। কিন্তু আজ পড়লাম না। আমাকে থামতে দেখে আলতাফ ভাই থামলেন।


সাইকেল থেকে নেমে প্রথমে টিম লিডার আসিফ ভাইকে জানালেন। এরপর শামীম নামে একরাইডার বললেন, ‘তুমি ভাইয়ের সাইকেলের চাকার লিকেজ সারিয়ে দাও’। শামীম যেমন করিৎকর্মা, তেমনই বিনয়ী। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভাই, প্যাচকিট, টায়ার লিভার, সল্যুশন আঠা, পাম্পার আছে?’ বললাম, পাম্পার ছাড়া সবই আছে। তবে এসব লাগবে না। আমার স্যাডেল ব্যাগে নতুন টিউব আছে। আলতাফ ভাই বললেন, ‘পাম্পার আমার কাছে আছে’। শামীমের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললেন, ‘সাইকেল সোজা না রেখে উল্টো করে ধরুন, তাহলে দ্রুত কাজ করা যাবে।’ এরপর ৮ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই তিনি নতুন টিউব ইনস্টল করে দিলেন। সহযাত্রীদের সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আমরা আবার এগিয়ে চললাম, আগের গতিতে, রাস্তায় শো-শো শব্দ তুলে। ড্রোন দিয়ে দেখলে ৩১ জনের এই সাইকেল বহরকে মনে হবে সারিবদ্ধ পিঁপড়ার লংমার্চ। রাস্তার পাশঘেঁষে আমরা ছুটে চলেছি। কিছু দূর যাওয়ার পর আসিফ ভাই একটি রেস্টুরেন্টের সামনে সবাইকে থামতে বললেন। জানালেন, এখানেই সকালের নাস্তা সেরে নেবো। 


নাস্তাপর্ব শেষে আবার রাইড শুরু। এরপর আবারও প্যাডেলে পড়লো পা, দৃষ্টি সামনের দিকে, ছুটি চললাম আমরা। চলতে চলতে চলে গেলাম বাহাদুরপুর রোভার স্কাউট ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে ৫ মিনিটের বিরতি। তুললাম গ্রুপ ছবি। এরপর কালিয়াকৈরে চা-বাগান বাজারে মাঠার উদ্দেশ্যে। মাঠা খাওয়া শেষে ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকায় হাজির।  কচি তালের শাস খাওয়া শেষে গোসলের উদ্দেশ্যে পিরুজালী সরকার পাড়ার দিকে যাত্রা। সেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী মনজুরুল হাসান জুয়েল। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন পিরুজালী সরকার পাড়া বিলে। তখন মাথার ওপর গনগনে সূর্য। প্রচণ্ড রাগে তার সমস্ত ক্রোধ যেন ঢেলে দিচ্ছিল ধরণীর দিকে। সেই তাপে আমরা ঘর্মাক্ত। বিলের পানি দেখে কেউ পরনের ট্রাউজারসহ ঝাপিয়ে পড়লেন, কেউ বা ট্রাউজার পরিবর্তন করে গামছা কিংবা লুঙ্গি পরে নামলেন।  গোসল পর্বে আমাদের কাটলো ঘণ্টাখানেক। শরীর তখন রৌদ্রের তাপমুক্ত। হালকা বাতাসও বুঝি বয়ে গেলো আমাদের শরীর ছুঁয়ে। আর তখনই পেট জানান দিলো ক্ষুধার। এবার দুপুরের খাবারের উদ্দেশ্যে প্যাডেলে পা। পৌঁছে গেলাম নুহাশ পল্লী পার হয়ে হোতাপাড়ার আগে মনিপুরবাজারে। এই বাজারে দুই ভাগ হয়ে আমরা ঢুকলাম ভাতের হোটেলে। 


দুপুরের খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর ঘরমুখো হবো হবো, চলছে এমন প্রস্তুতি। আর অমনি আকাশ নিকষ কালো করে নামলো ঝুম বৃষ্টি। আমরা সবাই একটি সুপার মার্কেটের শেডের নিচে দাঁড়ালাম। এমন সময় আমাদের এক সহযাত্রী মুখ ব্যাদান করে এসে হাজির। ব্যাপার কী ব্যাপার কী, ভাবতে ভাবতেই তিনি জানালেন, তার সাইকেলের পেছনের চাকা পাংচার হয়ে গেছে। তিনি নাকি আমাদের রেখে আগে চলে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু বিধি বাম, তাকে আমাদের কাছেই ফিরে আসতে হলো। এবারও উদ্ধারকর্তা হয়ে এগিয়ে এলেন সেই শামীম, যিনি যাওয়ার পথে আমার সাইকেলের সমাধান করে দিয়েছিলেন।


শামীম বললেন, ‘প্যাচকিট, টায়ার লিভার, সল্যুশান, সিরিজ পেপার দিন।’ কিন্তু যার সাইকেল, তার কাছে এর কিছুই নেই। কী আর করা, আমার সঙ্গে যা ছিল, তার সবই দিলাম। আলতাফ ভাই দিলেন তার পাম্পার। সমস্যার সমাধান হতে না হতেই আরেক সুখবর।  জেফরী ভাই ও সানি ভাই নিয়ে এলেন একব্যাগ লিচু। প্রত্যেককেই মুঠোভর্তি করে দিলেন সেই লিচু। বললেন, ‘লিচু রাইডে এসে লিচু না খেলে চলে?’ লিচু খাওয়া শেষ। বৃষ্টিও থামলো। আমাদেরও ফিরতি যাত্রা শুরু। আবার পিঁপড়ার মতো সারি বেঁধে রাস্তাকে হাতের ডানে রেখে কিনারঘেঁষে এগিয়ে চলা।  রাত দশটার মধ্যে যে যার গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। সবাই হেমন্ত রাইডার্সের গ্রুপ ম্যাসেঞ্জারে নিজ-নিজ বাসায় পৌঁছানোর তথ্যও জানিয়ে দিলাম। সেদিনের মতো ‘ভাঙলো মিলন মেলা ভাঙলো’। আমরা আবারও পরবর্তী কোনো রাইডে যাওয়ার বাসনা মনে পুষে ঘুমিয়ে পড়লাম। 

আরও পড়ুন:  বাইসাইকেল আরোহীদের পান্তাবেলা




আরো পড়ুন