২৬ জুন ২০২৪, বুধবার



ক্যাম্পাস
প্রিন্ট

অতন্দ্র প্রহরী বাবা

আসলাম বেগ || ১৮ জুন, ২০২৩, ০২:০৬ পিএম
অতন্দ্র প্রহরী বাবা


স্বার্থের এই ধূলি ধরায় সবচেয়ে নিঃস্বার্থপর শব্দটি হচ্ছে- বাবা। যিনি কণ্টকাকীর্ণ পৃথিবীতে সন্তানের জীবন চলার পথকে কুসুম-কানন করতে নিরলস পরিশ্রম ও নিরব ত্যাগ স্বীকার করে চলেন অবিরত।

সন্তানদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নিরাপত্তায় এবং তাদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার গুরুদ্বায়িত্ব বাবাকেই পালন করতে হয়। আমাদের পরিবারে মা মধুবৃক্ষ হলে, বাবা হলেন বটবৃক্ষ। যিনি জীবন সংগ্রামের যত রোদ-বৃষ্টি সয়ে পরিবারকে বনসাইয়ের মতো করে আগলে রাখেন। আমার বাবাকে দেখেছি, আমাদের তিন ভাইবোনকে সুহৃদ, চরিত্রবান, আত্মমর্যাদার অধিকারী  মানুষ করে গড়ে তুলতে কি আপ্রাণ প্রচেষ্টা।

শৈশবের অপরিপক্ক মস্তিষ্কে জমে থাকা কিছু স্মৃতি মনে হলে এখনো আবেগঘন হয়ে উঠি। তখনকার কিছু স্মৃতি নিছক ঘটনা হিসেবে মনে থাকলেও এখন এসবের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারি। আমাদের সামান্য অস্বস্তি বাবার জন্য যেন পাহাড় সম পেরেশানির কারণ হয়ে যেত। এমনি একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় বড় আপু বৃষ্টিতে ভিজে যায়। মাঝরাতে শুরু হয় অসহ্য জ্বর ও বমি। বাসায় কোনো ঔষধ-পত্র নেই। মাঝরাত, ঝুম বৃষ্টি, নিরুপায় অবস্থা! অন্যদিকে তীব্র জ্বরে আপুর আর্তনাদে বাবা দিশেহারা। এর মাঝেই দেখলাম একটা বড় তালা আর শাবল হাতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাবা কথায় চলে গেলেন। মিনিট পয়তাল্লিশ পর দেখি হাতে খাবার স্যালাইনসহ কমন কিছু মেডিসিন নিয়ে বাবা হাজির। পরে জানলাম, বাসা থেকে এক কিলো দূরের বাজারে এক আঙ্কেলের ঔষধ দোকানের তালা ভেঙ্গে ওই সব মেডিসিন নিয়ে এসেছেন। আগে মেয়ের জ্বর নিয়ন্ত্রণে আসুক, পরে সকাল হলে দেখা যাবে অবস্থা কি দাঁড়ায়। এতো গেল শৈশব! কৈশোর কিংবা যৌবনেও বাবা এখনো আছেন জন্মের প্রথম দিনের মতোই। এইতো কোভিড মহামারিতে যখন পুরো পৃথিবী স্থবির, শহর-গ্রাম জুড়ে জারি হলো লকডাউন, আমিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে ঘরবন্দি দিন যাপন শুরু করলাম। নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন সীমান্তবর্তী অজপাড়া গ্রাম আমাদের। কোভিড ভয়ে লোকালয় এড়াতে দিনে ঘরবন্দি থাকতাম। রাত গভীর হলে ঘুমিয়ে পড়তো সবাই, তখন আমি গ্রামের জনশূন্য মেঠো পথে বের হতাম রিফ্রেশমেন্টের জন্য, সাথে রাস্তার কোন মোড়ে যদি সামান্য নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় তবে প্রিয় বন্ধু-সহপাঠীদের সাথে একটু যোগাযোগ করা যাবে, দেশ ও দেশের বাইরের সার্বিক অবস্থা জানা যাবে এই আশায়। এমন এক রাতে বাসায় যখন সবাই ঘুমিয়ে, খুব স্মিত পায়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে কিছুদূর এসে রাস্তায় বাধানো কালভার্টে বসে মোবাইল স্ক্রলিং করছি। এর এমন সময় সীমান্ত টহলে যাওয়া তিনজন বিজিবি সদস্য এসে জেরা শুরু করলেন। বাসা কথায়? এতো রাতে বাইরে কেন? কি কর? এই বর্ডারে চোরাচালানের সঙ্গে যোগসূত্রতা আছে কিনা? এইসব জিজ্ঞেস করলে  উত্তর দিলাম। তারা সত্যতা যাচাই করতে তারা আমার সঙ্গে বাসার অভিমুখে দু-কদম হাটতেই বাঁ দিকে মোড় নেওয়া রাস্তার আড়ালে আরেকজন লোক দেখা গেলো। ভদ্রলোকের উপর বিজিবি'র লাইট পড়তেই দেখলাম ‘বাবা'। বুঝতে পারলাম তিনি আড়াল দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করছিলেন। বিজিবি সদস্যরাও আব্বাকে চিনতে দেরি করেনি। আব্বাকে দেখে বললেন,  হুজুর সাহেব! এতো রাতে বাইরে কি করেন! বাবা আমার দিকে দেখিয়ে বললেন,  এইযে আমার ছেলে, রাতের বেলা সবার নজর এড়িয়ে রাস্তায় চলে আসে। একজন সদস্য আব্বাকে বললে, বর্ডারের অবস্থা তো জানেন। নিষেধ করেন না কেন? বাবা- দিনে তো বের হওয়ার সুযোগ নেই, সারাদিন বাড়িতে ঢুকে থাকে। এই রাত্রি একটু বের হয়...আর হবে না। আর একজন সদস্য মজা করে বললেন, ছেলে মোবাইল টেপে আর বাবা পাহারা দেয়, বিষয়টা দারুন তো। আমারা বর্ডার পাহারা দিচ্ছি, আর আপনি পাহারা দিচ্ছেন ছেলে। সেদিন বুঝলাম বাবা আসলে প্রতি রাতেই এমন করেই আড়াল থেকে আমাকে লক্ষ্য করে, পাহারা দেয়। দুই-একদিন মুখোমুখি হলে বলতো, বাসায় প্রচুর গরম তাই আমিও রাস্তায় আসছি হাওয়া খেতে। সেদিন বুঝলাম বাবা যে আমাক সেই ছোট্টোটি এখনো মনে করে অতন্দ্র প্রহরীর মতো আগলে রাখতে চান তা হয়তো আমৃত্যু বহাল থাকবে। দেহ নিশ্চল হয়ে গেলে হয়তো তসবির পুঁথি ঠেলে আমার ভাগ্যকে প্রশস্ত করতে চাইবেন। এভাবেই ভালোবাসে আগলে রাখো বাবা। আমিও তোমাকে প্রচুর ভালোবাসি। তোমাকে হয়তো বলা হবেনা কোনো দিনই।

ঢাকা বিজনেস/এন/ 



আরো পড়ুন