২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার



উদয় হাকিমের কলাম
প্রিন্ট

জলদানব নেসি, লেক-ক্যাসেলের আকর্ষণে সারা দুনিয়া পাগল

উদয় হাকিম, স্কটল্যান্ড (যুক্তরাজ্য) থেকে || ০৬ জুন, ২০২৩, ০৬:৩৬ এএম
জলদানব নেসি, লেক-ক্যাসেলের আকর্ষণে সারা দুনিয়া পাগল আর্কহার্ট ক্যাসেল ও লক নেস লেক


স্কটিশ রূপকথার এক জলদৈত্য হচ্ছে নেসি। যাকে জলদানবও বলা হয়। কিম্ভুৎকিমাকার দেখতে এটি। তবে অনেকের মতে, এটি মোটেও রূপকথা নয়, বাস্তবেই রয়েছে এই দৈত্য। সেই দৈত্য বা জলদানব বাস করে লক নেস নামের এক বিশাল-গভীর লেকে। জলদানবটির নাম নেসি।

স্কটল্যান্ডের অনিন্দ্য সুন্দর এক লেক লকনেস। নয়নাভিরাম এই লেকের দুই পাশে পাহাড়। একপাশে সড়ক। অন্যপাশে ঘনজঙ্গল। গ্রেট ব্রিটেনের সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে বড় লেক এটি। লেকের পানির নিচে একটি গুহায় বাস করে নেসি। বাস্তব কিংবা মিথ যাই হোক না কেন, ওই দৈত্যের কারণে সারা বিশ্বের হাজার হাজার পর্যটক ভ্রমণ করে লক নেস লেক। লেকের পাড়েই এলাকার প্রধান পর্যটনকেন্দ্র আর্কহার্ট ক্যাসেল। সারা দুনিয়া পাগল ওই দৈত্য আর লেক-ক্যাসেলের আকর্ষণে। 

নীল জলের ওই লেকটি ৩৭ কিলোমিটার লম্বা। একটু কল্পনা করুন, অনেক নদীও এত লম্বা হয় না। এর পানির গভীরতা ৭৫৫ ফুটেরও বেশি। আয়তনে প্রায় ৫৭ বর্গকিলোমিটার। 

স্কটিশ ভাষায় লক হচ্ছে লেক। আর নেস হচ্ছে একটি নদীর নাম। যা এই লেকের উত্তর দিকে অবস্থিত। নেস শব্দের অর্থ গর্জনকারী। স্কটল্যান্ডের হাইল্যান্ডে এর অবস্থান। হাইল্যান্ড হচ্ছে উঁচু পাহাড়ি ভূমি। স্কল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমের বিচিত্র ভূমি হাইল্যান্ড হিসেবে বিখ্যাত। হাই ল্যান্ডের রাজধানী বা প্রধান শহর মনে করা ইনভারনেসকে। এই ইনভারনেস লেকটির উত্তর পাশে। দক্ষিণে ফোর্ট অগাস্টাস। 

এডিনবরাহ থেকে প্রাইভেটকার নিয়ে যাচ্ছিলাম লক নেস লেকে। গাড়ি চালাচ্ছিলেন হুমায়ুন কবীর ভাই। চ্যানেল আইয়ের স্কটল্যান্ড প্রতিনিধি। দারুণ মিশুক মানুষ। রিয়েল ভ্রমণলাভার। ডান্ডি হয়ে যাওয়ার কারণে পথ অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। ডান্ডি ছাড়িয়ে ইনভারনেসে দেখলাম লোকালয় কম। রাস্তার দুপাশে শুধু পাইন বন। জানা গেলো একসময় এই এলাকা বরফে ঢাকা ছিল। বরফ সরে গেলে ন্যাড়া পাহাড় বেরিয়ে পড়ে। গবেষণা করে এখানে পাইন গাছের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয় হেলিকপ্টার থেকে। এরপর পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে পাইন বনে। 

পাইন বন খুব ফাইন বন! যে কারও কাড়ে মন। হঠাৎ বনের ফাঁক গলে দেখা মেলে বিশাল এক লেক। নীল শান্ত জলে মন ছুঁয়ে গেলো। এই লেক গাড়িতে পাড়ি দিতে আধা ঘণ্টা লেগে যায়। লেক থেকে বেরিয়ে কাছের একটা ছোট বাজারে গেলাম আমরা। যার নাম হাউজ অব ব্রুয়ার। মানে মদ উৎপাদনকারীদের বাড়ি। মনে হয় গ্রামের মতো কোনো স্থাপনা হবে। মোটেও তা নয়। সেটি ছিল কসমোপলিটানের আধুনিক রূপ। দামি গাড়ি, ঝকঝকে রেস্টুরেন্ট, ফুলের দোকান। সেখানে জিজ্ঞেস করলাম আর্কহার্ট ক্যাসেল কোন দিকে। পথ দেখিয়ে দিলেন একজন। সামান্য চা-নাস্তা খেয়ে বের হলাম। আবারও লেকের পাশে। 

এত লম্বা লেক জীবনে কখনো দেখিনি। লেকটি উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে বয়ে গেছে। আমরা উত্তর পাড় দিয়ে পশ্চিম-দক্ষিণে যাচ্ছিলাম। একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে লেকের ওপর ড্রোন চালালাম। অনেক পর্যটকবাহী জাহাজ চলছিল। এমন লেকে, এমন জাহাজে ভ্রমণ করা যে-কারও জন্য স্বপ্নের মতো ব্যাপার। বনের ভেতরে সমুদ্রের মতো বিশাল এই লেকটি মিঠা পানির লেক। 

ড্রোন শেষ করে আবার গাড়িতে উঠলাম। লেক যেন শেষ হয় না। আমাদের বা পাশ ধরে চলছিল। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে প্রায় শেষের দিকে এসে গাড়ি থামলো। ওই আর্কহার্ট ক্যাসেলের কথা বলছিলাম। সেখানে নামলাম। ক্যাসেল মানে দুর্গ। সাধারণত প্যালেস বা রাজপ্রাসাদ রক্ষার জন্য ক্যাসেল থাকে। তবে রাজ্য রক্ষার জন্য বা রাজ্যের উচ্চ পদস্থ লোকদের থাকার জন্য ক্যাসেল ব্যবহৃত হয়। তবে ক্যাসেলেও রাজা, জমিদারেরা থাকতেন। টিকিট কেটে ভেতরে যেতে হয়। ক্যাসেল আমাকে খুব একটা টানলো না। ভেতরে গিয়ে সময় নষ্ট করলাম না। বাইরে থেকে দেখলাম। অসংখ্য মানুষ ভেতরে। ক্যাসেলের ছাদে, উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকজন আসলে লেক উপভোগ করছিলেন। কেউ কেউ টিকিট কেটে লেকের জাহাজে উঠছিলেন।


জলদৈত্য নেসির প্রথম প্রকাশিত ছবি (নেট থেকে নেওয়া)

লক নেস এবং এই ক্যাসেল এখন মিথলজিক্যাল স্পটে পরিণত হয়েছে। যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক বেড়াতে যান। কেন যান? কারণ একটি মাত্র শব্দ। শব্দটি হচ্ছে ‘নেসি’। আর ওই একটা শব্দের কারণেই লেকটি এখন বিশ্বখ্যাত। নেসি হচ্ছে একটি দৈত্যের নাম। যে জলদৈত্য থাকে ওই লেকে। কেউ কেউ মনে করেন, ওই ক্যাসেলের কাছেই নেসি থাকে। নেসির ছাও-পোনারাও ওই ক্যাসেলের কাছে কোনো পানির নিচে কোনো গভীর গুহায় বাস করে!

১৯৩৩ সালের কথা। যখন প্রথম ওই লেকের উত্তর পাড়ে একটি রাস্তা নির্মাণ চলছিল। যে রাস্তা দিয়ে হাইল্যান্ডের পশ্চিম প্রান্তে যাওয়া যায়। যে সড়কের মাধ্যমে স্কটল্যান্ডের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সাগর পাড়ের পশ্চিম অংশের যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। নতুন রাস্তা ধরে এক দম্পতি বাড়ি ফিরছিল। দিনটি ছিল ১৯৩৩ সালের পহেলা এপ্রিল। সন্ধ্যের দিকে তারা অচেনা এক প্রাণী দেখলেন। যেটি পানির ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল এবং সেটি ডুবে যাচ্ছিল। অদ্ভূত এই প্রাণীটির সঙ্গে কোনো প্রাণীর মিল ছিল না। যেটি ছিল দেখতে বিশাল আকৃতির হাঁসের মতো। লম্বা গলা। শরীর অনেকটা তিমির মতো। এই অঞ্চলে যারা থাকেন, তারা জানেন, এখানকার জলাশয়গুলোতে রাজহাঁসের মতো বা তার চেয়েও বড় আকারে হাঁস দেখা যায় সবসময়ই। 

যাই হোক, এই দৈত্যটি নিয়ে অনেক কথা-উপকথা, মিথ রয়েছে। কারও মতে, এটি সাপের মতো লম্বা। এর শরীরে চারটি কূঁজ বা উঁচু ভাঁজ। কারও কাছে নেসি দেখতে ডাইনোসরের মতো। 

ক্রিপটোজোলজিক্যাল বলে একটা টার্ম আছে। যা মিথিক্যাল এনিমেল বা মনস্টার নিয়ে গবেষণা করে। রহস্যময় জলজপ্রাণী তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু। গবেষকরা অবশ্য এ ধরনের প্রাণীর অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন। তাদের মতে, ৭ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে এরকম প্রাণী ছিল।

লক নেসের এই জলদানবের কথা প্রথম প্রকাশ পায় ৬ষ্ঠ শতকে। একটি জীবনী থেকে। বলা হয়, একটি গুহা আছে ওই লেকের নিচে। যেখানে ওই প্রাণীটি বাস করে। এ ধরনের প্রাণী মৎস্যভোজী।   লম্বায় ৩০ ফুট। শরীরে কূঁজ আছে। 

লক নেস এবং নেসি নিয়ে রয়েছে অনেক গুজব। সাধারণত মিথ নিয়ে যা থাকে। আছে কিছু পৌরানিক কাহিনি। অনেক গল্প, অনুমান আর কিছু অপ্রমাণিত সত্যাসত্য। সত্য মিথ্যের ঊর্ধে্ব উঠে এটি মানুষের মুখে মুখে। কিছু লেখক, চলচ্চিত্রকার, আলোকচিত্রী, ভ্রমণকারী এবং গবেষক এই দৈত্য নিয়ে নানারকম কথা বলেছেন। কেউ কেউ নিজের চোখে ওই জলদানব দেখেছেন বলে দাবি করেছেন। কেউ ছবি তুলেছেন বলে দাবি করেছেন। আর বিজ্ঞানী বা গবেষকরা মেলানোর চেষ্টা করেছেন আগের অভিজ্ঞতা দিয়ে। 

ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের একটি টিম মনে করে, সাহারা মরুভূমিতে এ ধরনের প্রাণীর ফসিল পাওয়া যাওয়ার পরে ওই ধরনের প্রাণীর অস্তিত্ব মেলে। প্রাগৈতিহাসিক সময়ে এ ধরনের সরীসৃপগুলো মূলত নোনা জলে বাস করতো। তাহলে একে মনস্টার বা দৈত্য কেন বলা হবে? আসলে আকৃতির কারণে এবং জীবটি অপরিচিত বলে মানুষ একে দৈত্য মনে করে। এ ধরনের সরীসৃপ লোনা পানিতে থাকতে পারে। কিন্তু মিঠা পানিতে কিভাবে? কারও কারও মতে, এই এলাকাটি একসময় সমুদ্রের অংশ ছিল। ভূমিকম্প বা অন্য কোনো দৈবক্রমে এ ধরনের প্রাণী এই জলাধারে আটকা পড়তে পারে। যেহেতু নেসি নামের প্রাণীটি লেকের পানিতে বাস করে, তার মানে এরা মিঠা পানিতেও বাঁচতে পারে। দৈত্যটি এখন বেঁচে আছে না কি মরে গেছে? এই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর নেই। কেউ একজন আবার যদি দেখে, ছবি তোলে, ভিডিও করে, তখন আবার সামনে চলে আসবে বিষয়টি। নেসির কোনো বাচ্চা-কাচ্চা আছে কি না, সেটিও এক বিরাট প্রশ্ন। তবে এরকম এক দৈত্যের কথা শোনা যায়, উত্তর আয়ারল্যান্ডের জায়ান্ট কজওয়ে ঘিরে। যে দৈত্যের বাচ্চা-কাচ্চা ছিল। 

একথা সত্যি যে, জলদানবের এই লোককাহিনি স্কটল্যান্ডের এই এলাকাকে ট্যুরিস্টদের হট স্পটে পরিণত করেছে। ১৮৪৮ সালে রয়্যাল নেভির এইচএমএস ডেডালাসের এক ক্যাপ্টেন দক্ষিণ আটলান্টিকে বিশাল সাপের মতো একটি প্রাণী দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। সেই সময়ে এটা নাবিক এবং গণমাধ্যমে বেশ আলোচনা হয়েছিল। 

তবে অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনে বিষয়টিকে সত্য বলে মনে করেন কেউ কেউ। ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গভীর এই লেকে ভয়ঙ্কর এরকম কিছু থাকতেই পারে। তবে দেখতে ভয়ঙ্কর হলেও দৈত্য নেসি এখনো মানুষের কোনো ক্ষতি করেনি। ওই লেকে অসংখ্য পর্যটকবাহী জাহাজ চলে, নৌকা চলে। অনেকেই লেকের জলে গোসল করে। তাদের সঙ্গ ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেনি। ওই যে শুরুতে যে কাহিনির কথা বলেছিলাম, স্কটল্যান্ডের এক দম্পতির কথা; সেটাই লোকের মুখে বেশি শোনা যায়। ১৯৩৩ সালের এপ্রিলে ম্যাক দম্পতি ওই দৃশ্য দেখেছিল। তারা দেখেছিলেন লেকের পানি হঠাৎ ওপরে উঠতে শুরু করে, যেমনটা তিমি বা জলহস্তির ক্ষেত্রে হয়। এরপর সেটি লেকের পানিতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ১৯৩৩ সালের মে মাসে ইনভারনেস কুরিয়ারে সে ঘটনার বর্ণনা প্রকাশিত হয়। 


ড্রোন থেকে নেওয়া লক নেসের ছবি

ম্যাকদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন একজন লেখক। তার নাম রুপার্ট গোল্ড। সেখানে ওই স্বাম-স্ত্রী দু’জনেই বলেছেন, তারা 'দুটি কালো কুঁজ' দেখেছেন। তাদের ওই বর্ণনা থেকে নেসির ক্ল্যাসিক একটি চিত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 

এর কয়েকমাস পর ইনভারনেস কুরিয়ারে জর্জ স্পাইসার নামে এক দর্শনার্থীর বিবরণ প্রকাশিত হয়। তার বর্ণনাও অনেকটা ম্যাকদের মতোই। স্পাইসারের মতে, তিনি স্ত্রীসহ ওই লেকের ধার দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, একটি ড্রাগন বা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো কিছু একটা দেখি। প্রথমেই চমকে উঠেছিলাম। এ কী দেখলাম! প্রাণীটির গলা বা ঘাড় অনেক লম্বা। সেটির মুখে ছিল ছোট ভেড়ার বাচ্চা বা এ ধরনের কোনো প্রাণী। অনেকেই জানেন, স্কটল্যান্ডের মাঠে মাঠে প্রচুর ভেড়া দেখা যায়। মাঠে-ঘাটে সবজায়গাতেই ভেড়ারা খোলামেলা বিচরণ করে। ভেড়ার মাংস এবং ভেড়ার লোমের বেশ চাহিদা সেখানে। দৈত্যাকারের প্রাণীটির রঙ কেমন? বলা হয়েছিল কুৎসিত দেখতে। অনেকটা ধূসর। নোংরা হাতির পিঠের মতো অদ্ভূৎ শরীর। লম্বা ঘাড়সহ একটি বিশাল শামুকের মতো।

রুপার্ট গোল্ড নামে এক ভদ্রলোক লেখক ডি ম্যাকেঞ্জিকে বলেছিলেন, নেসি আসলে ডাইনোসরের মতো। তিনি বলেছিলেন, ১৮৭১-৭২ সালের দিকে লক নেসের ওই পথে অদভূৎ কিছু দেখেছিলেন। সেটি তীব্র বেগে পানি সরিয়ে দিয়েছিল। আবার সমুদ্র মন্থন করার মতো পানিতে ডুবে গিয়েছিল। নেসি নামক ওই দৈত্যের কাহিনি লোকমুখে ছড়িয়ে যাওয়ার আগে তিনি তার বন্ধুদের আড্ডায় এটা নিয়ে অনেক গল্প করেছেন। 

আবার ১৯৩৩ সালেই নেসির প্রথম আলোকচিত্র প্রকাশিত হয়। হিউ গ্রে নামে এক ব্যক্তি ওই ছবিটি তুলেছিলেন বলে তার দাবি। তিরি লেক দিয়ে যাওয়ার সময় ওই ছবিটি তুলেছিলেন। তবে তার ছবিটি ছিল ঝাপসা, অস্পষ্ট। অনেকে বলে থাকেন, সেটি আসলে মুখে লাঠি নিয়ে একটি কুকুরের সাতার কাটার দৃশ্য। 

১৯৩৩ সালে বিষয়টি চাউর হওয়ার পর অনেকেই নেসির ছবির তোলার ধান্দায় ছিলেন। ১৯৪৩ সালে 'সার্জনের ফটোগ্রাফ' নামে একটি ছবি প্রকাশ পায়। ওই ছবিটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যদিও পরে সেটিও নকল বলে প্রমাণিত হয়। প্রাণীটির মাথা ও ঘাড়ের ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল সেখানে। পরে জানা গেলো, পুরো বিষয়টি ছিল অভিনয় বা বানানো গল্প।


জলদানব নেসির কাল্পনিক ছবি (নেট থেকে নেওয়া)

এতক্ষণ যারা নেসির গল্প শুনলেন, তারা মনে করবেন না আসলেই এরকম দৈত্য নেই। এখন হয়তো নেই। কিন্তু একটা সময় ছিল। বিজ্ঞানীরা প্লেসিওসর নামে এক প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী খুঁজে পেয়েছেন, যা হুবহু নেসির সঙ্গে মিলে যায়। (আমরা জানি, ডাইনোসর থাকতো ডাঙ্গায়। আবার জলে থাকতো ইচথিওচর নামে এক বিশাল প্রাণী। বিশাল হাঙ্গর বা তিমির মতো দেখতে ছিল।) একুশ কোটি ৫০ লাখ বছর আগে থেকে সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে প্লেসিওসরদের উপস্থিতি ছিল। তাদের যে খাঁচা বা কাঠামো অনুমান করা যায়, তাতে দেখা যায়, তারা ছিল লম্বা গলার সামুদ্রিক সরীসৃপ। মানে সাপের মতো কিছুটা। অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়াসহ ইউরোপীয় সমুদ্রে এবং প্রশান্ত মহাসাগরের চারপাশে প্লেসিওসরদের বিচরণ ছিল। 

একটি প্লেসিওসর ১৫ ফুট লম্বা হতো। দেহ চওড়া এবং চ্যাপ্টা। ছোট একটা লেজ থাকতো। পানিতে পাখনা ঝাঁকিয়ে সাঁতার কাটতো। যেমনটা করে সিল বা সি লায়ন। বলতে পারি ভোঁদরের মতো। এদের নাকের ছিদ্র চোখের কাছে মাথার অনেক পেছনে। ঘাড় লম্বা এবং ক্রমশ নিচের দিকে বাঁকানো। চোয়ালের লম্বা ধারালো দাঁত দিয়ে তারা শিকার ধরতো। 

প্লেসিওসররা দুটি প্রধান বংশে বিভক্ত ছিল। প্লেসিওসরয়েড এবং প্লেসিওসরয়েডিয়া। প্রথম বংশের প্রাণীদের ঘাড় ছিল ছোট এবং মাথা লম্বা। তার দ্বিতীয় বংশের প্রাণীদের মাথা তুলনামূলকভাবে ছোট এবং ঘাড়টি সাপের মতো লম্বা। একটি প্লেসিওসরিডের ফসিল থেকে দেখা যায় এর ঘাড়ে কশেরুকা ছিল ৭৬টি (মানুষের মাত্র ৪টি)। এর দৈর্ঘ ছিল ১৩ মিটার বা ৪৩ ফুট। ক্রোনোসরাস নামে প্লেসিওসরের জীবাশ্ম মেলে অস্ট্রেলিয়া ও কলম্বিয়াতে। যা প্রায় ৩৬ ফুট লম্বা ছিল। 

সুতরাং নেসির মতো দৈত্যাকার প্রাণীর অস্তিত্ব নিছক গল্প নয়। যখন বান মাছ বা ঈল ফিসের মতো মাছে ইলেকট্রিসিটি পাওয়া যায়, তখন প্লেসিওসর মতো প্রাণীরা থাকতেই পারে। আর নেসিকে তো অনেকেই দেখেছেন বলে স্বীকার করেছেন। 

তবে এত দীর্ঘ লেক, এর গহীন জল যতদিন থাকবে, নেসির গল্প আরও জনপ্রিয় হবে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বলেছেন, লক নেসে মানুষজন যা দেখেছে, তা বিশাল আকৃতির ঈল হতে পারে।

তবে ঈল হোক বা সামুদ্রিক চিল হোক, জলদানব নেসি ভালোই আকর্ষণ করে পর্যটকদের। কেউ কেউ যেমন এটা বাস্তবে দেখেছেন এবং ছবি তুলেছেন বলে দাবি করেছেন, আবার অনেকেই এর কাল্পনিক ছবিও বানিয়েছেন। যা ক্ল্যাসিক হিসেবে সবার মনে জায়গা করে নিয়েছে। মিথ লাভারদের জন্য লক নেস বা আর্কহার্ট ক্যাসেল তাই চমৎকার এক লোকেশন। 

ঢাকা বিজনেস/এনই



আরো পড়ুন