ইউরোপের একটি চাকরি অনেকের জন্যই পরম আরাধ্য। শেনজেন বা শেঙ্গেনভুক্ত দেশে হলে তা নিশ্চয় সোনায়-সোহাগা। ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত দ্বীপদেশ মালটা তাই দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। মালটায় চাকরির বাজারও সবার জন্য উন্মুক্ত। দেশটির কর্তৃপক্ষ ভিসাও দিচ্ছে অন্যদের চেয়ে সহজে।
মালটা একটি ছোট দেশ। জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে ৫ লাখ। কিন্তু শেঙ্গেনভুক্ত ইউরোপীয় দেশ হওয়ায় এটি এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়েছে। মালটার স্থানীয়রা খুব ফূর্তিবাজ। তারা সারাদিন খাওয়া-দাওয়া, বিনোদন এসব নিয়ে থাকে। কেবল অফিসিয়াল এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় তারা কাজ করে। যেমনটা দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্যের বেলাতেও। বাকি কাজ করা হয় ভিনদেশিদের দিয়ে।
মালটার চারিদিকে শত শত হোটেল রেস্টুরেন্ট। সবসময় পর্যটকে ভরপুর থাকে দেশটি। প্রায় সারা বছরই নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া থাকে বলে, পর্যটকের অভাব হয় না এখানে। সমভাবাপন্ন আবহাওয়া মালটার লোকদের জন্য প্রকৃতির অসামান্য এক দান বা উপহার। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আমেরিকার লোকজনের একটি প্রিয় ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন মালটা। বেশি গরম অঞ্চলের লোকেরা যেমন এখানে আসেন সাগরের হাওয়া খেতে, তেমনি বেশি ঠাণ্ডা অঞ্চলের লোকেরা আসেন রোদ পোহাতে।
পর্যটননির্ভর দেশ হওয়ার কারণে মালটায় সবচেয়ে বেশি চাকরির সুযোগ হোটেল, রেস্টুরেন্টে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের দোকান, শোরুমেও চাকরির সুয়োগ রয়েছে। হোটেলগুলোতে রয়েছে ম্যানেজার, হিসাবরক্ষক, বেলম্যান, রুম সার্ভিস, রুম অয়েটার, লাইন ওয়েটার, কনসিয়ারসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ। রেস্টুরেন্টগুলোতে প্রচুর পরিমাণে দক্ষ শেফ, কিচেন সহকারী, সার্ভিস ম্যান, ওয়েটার ইত্যাদি দরকার।
এছাড়া কৃষিখাত, শিল্পখাত, রিটেইলার-কর্নার শপ, প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি, গেমিং, আইটি, ব্যাংকিং, ফুড প্রসেসিং, পেশাদার ডাক্তারসহ নানা পেশায় লোকবল দরকার মালটায়। শিল্পেও এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের দিকে নজর দিয়েছে তারা। আছে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি। সারা বিশ্বের মতো মালটাতেও আইটি সেক্টরে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।
অনলাইন গেমিং শিল্পেও তারা বেশ অগ্রগামী। এখানে রয়েছে মাল্টা গেমিং অথরিটি (এমজিএ)। যারা এই শিল্পটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেক বিদেশি কোম্পানি মালটাতে তাদের অফিস স্থাপন করছে; পণ্যের উন্নয়ন, গ্রাহকসেবা কেন্দ্রও করছে মালটাতে। এসবই তৈরি করছে চাকরির সুযোগ।
মাল্টার কৌশলগত অবস্থান এটিকে ভূমধ্যসাগরীয় ট্রান্সশিপমেন্ট হাব করে তুলেছে। এখানে জাহাজ মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণ শিল্পেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। মালটার ফ্রি পোর্ট বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেখানেও অনেক লোক কাজ করে। ছোট দেশ হলেও কৃষিকে তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কৃষি শ্রমিক তারা বাইরে থেকে নিয়ে আসেন।
এদিকে ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশগুলোতে আগামী দিনে প্রচুর হেল্থকেয়ার (স্বাস্থ্যসেবা)-কর্মী দরকার। এসব অঞ্চলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে। সন্তানেরা ব্যস্ততার কারণে বাবা-মাকে সময় দিতে পারছে না। ফলে আগামী বছরগুলোতে শুধু ইউরোপেই ২০ লাখ হেল্থকেয়ার জবের সুযোগ তৈরি হবে বা হচ্ছে। এরইমধ্যে বিভিন্ন দেশ ডাক্তার ও নার্সিং স্বল্পতায় ভুগছে। কোনো কোনো দেশ আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নার্সদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।
জানা গেছে, শুধু মালটায় প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। যার প্রায় পুরোটাই ওভারসিস এমপ্লয়ি বা বিদেশি লোক দিয়ে পূরণ করা হয়।
তবে আগামী দিনগুলোতে মালটা লোকবল সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ-মালটা বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জেরাল্ড ফিনেক। তিনি বলেন, সারা বিশ্বেই এখন দক্ষ লোকবল সংকট। মালটাও এর বাইরে নয়। ওভারসিস ম্যানপাওয়ার হয়তো আছে। কিন্তু একদিকে তারা দক্ষ নয়। অন্যদিকে মালটা’র কালচার, ভাষাগত পার্থক্য এসবও কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সম্প্রতি মালটা সরকার স্কিলপাস নামে একটি স্কিম হাতে নিয়েছে। হোটেল রেস্টুরেন্টে যারা কাজ করতে চায়, তারা এর মাধ্যমে দক্ষতার পরীক্ষা দিয়ে জব পেতে পারে।
জিরাল্ড ফিনেক এর মতে, পেশাগত দক্ষতা এবং ইংরেজি ভাষায় কথা বলার যোগ্যতা থাকলে সহজেই ভালো বেতনের জব পাওয়া যায় মালটায়। যেহেতু এটা ট্যুরিস্ট সার্ভিস ওরিয়েন্টেডে কান্ট্রি, সেহেতু ব্রেক্সিট-এর পর এর গুরুত্ব বেড়ে গেছে। জিব্রালটার ইউকের অধীনে ছিল। ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্য আলাদা হয়ে গেছে। ফলে ওখান থেকে আইটি, গেমিং ইন্ডাস্ট্রি, কাস্টমার সার্ভিস, সার্ভার এগুলো মাল্টায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। এই কারণে মালটায় দক্ষ ও পেশাজীবীদের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। জাহাজ মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণ শিল্পেও এখানে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। মালটার ফ্রি পোর্ট ইউরোপের ব্যস্ততম বন্দর হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
জেরাল্ডের মতে, মালটা ইউরোপ মহাদেশের ছোট্ট একটি দেশ হলেও এখানকার অর্থনীতি ও জীবনযাপন অনেক বেশি উন্নত। কৌশলগত অবস্থান মালটাকে ভূমধ্যসাগরীয় ট্রান্সশিপমেন্ট হাব করে তুলেছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, অনেক দেশ যেখানে ব্লকচেইন বা ক্রিপ্টোকারেন্সিকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না, ষেখানে মালটা সরকার অনেক বেশি ভিশনারি। এখানে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যাংকও আছে।
বুলগেরিয়ার নাগরিক স্টিফান নিকোলভ দীর্ঘদিন ধরে মালটাতে বসবাস করছেন। তিনি মূলত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার কারণে এদেশে থাকেন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধশীল হওয়ার কারণে এখানকার বেতন কাঠামো ভালো। প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক শ্রমিক এখানে আসে।
সিলভিয়া টেইলর নামে এক রূপচর্চা বিশেষঙ্গের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ইংল্যান্ড থেকে মালটা এসে স্পা সেন্টার খুলেছেন, যার নাম বাবুর। পর্যটননির্ভর দেশ হওয়ায় এখানে তার ব্যবসা বেশ জমজমাট। কিন্তু তিনি জানান, এখাতে দক্ষ কর্মীর বেশ অভাব রয়েছে। যে কারণে পর্যটনের ভর মৌসুমে তিনি সেবা দিতে হিমশিম খান।
মালটা ইউরোপের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠার পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে। এখানকার আকর্ষণীয় কর নীতি এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও পরিকাঠামো ভূখণ্ডটিকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রেখেছে। বিশেষ করে সহজ ব্যাংকিং, বীমা ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে মালটা। এখানে সহজ করা হয়েছে বিনিয়োগ পদ্ধতি। সহজে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্যবসা খোলা এবং পরিচালনা করা যায়। ব্যবসা করা বা ডুয়িং বিজনেস র্যাংকেও ভালো অবস্থানে আছে এই দ্বীপদেশ।
সংশ্লিষ্টদের মতে,জনশক্তি একটি দেশের জন্য বিরাট সম্পদ। কিন্তু সেটাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হবে, দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ইউরোপ আমেরিকার শ্রম বাজার সহজে দখলে নিতে পারে। এই বিশাল শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে দক্ষ এবং বাজার উপযোগী করে পেশাজীবী তৈরি করতে হবে। যারা কাজটি আগেভাগে করতে পারবেন, এগিয়ে যাবেন তারাই।