২০ অক্টোবর ২০২৪, রবিবার



উদয় হাকিমের কলাম
প্রিন্ট

ছোট্ট দেশ মালটার ইতিকথা

উদয় হাকিম, মালটা থেকে || ১০ অক্টোবর, ২০২৪, ০৭:১০ পিএম
ছোট্ট দেশ মালটার ইতিকথা


ভূমধ্য সাগরের একটি দ্বীপ। যেখানে প্রচুর ফুল ফুটতো। জংলা ফুলের নাম ছিল মেলিতা। ওই মেলিতা ফুল থেকে প্রচুর মধূ পাওয়া যেতো। নাবিকরা ওই ফুলের নাম অনুসারে দ্বীপের নাম দেন মেলিতা, যা পরে মালটা হয়ে যায়। 

পাঁচটি দ্বীপ নিয়ে পুরো দেশ। দ্বীপগুলো হলো মালটা, গোজো, কমিনো, কোমিনোত্তো এবং ফিলফিলা। তবে মানুষের বসবাস আছে কেবল মালটা এবং গোজো দ্বীপে। অন্য দ্বীপগুলোতে কোনো মানুষের বসবাস নেই। 

দেশটির আয়তন সব মিলিয়ে ৩১৬ বর্গ কিলোমিটার। লোকসংখ্যা সাড়ে ৫ লাখ। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং শেনজেনভুক্ত একটি দেশ। ছোট্ট দেশ হলেও এটি ধনী দেশ। মানুষের মাথাপিছু আয় ৩৪ হাজার মার্কিন ডলার, সেটিও ২০২২ এর হিসেব অনুযায়ী। 

এই দ্বীপ দেশটির সবচেয়ে কাছের রাষ্ট্র ইতালি। ইতালির সঙ্গে রয়েছে ফেরী যোগাযোগ। মালটার নিকটবর্তী ভূখণ্ড ইতালীর সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ। সিসিলি থেকে মালটা ৯৩ কিলোমিটার দক্ষিণে। আফ্রিকার তিউনিসিয়ার দূরত্ব ২৮৮ কিলোমিটার। ভূমধ্যসাগরের মাঝের দ্বীপ হওয়ায় নাবিক ও বণিকদের কাছে এর গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। অসংখ্যবার এই দ্বীপে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে।   



ফিওনিশিয়ানস, রোমান, বাইজেন্টাইন এমনকি আরবরাও এই দেশ শাসন করেছেন। ফিওনিশিয়ানস হচ্ছে খ্রীষ্ট জন্মের ১৫৫০ বছর আগে সিরিয়া ও লেবানন উপকূল এবং ভূমধ্যসাগরে প্রভাব বিস্তারকারী গোষ্ঠী। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ সাল পর্যন্ত তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। তার মানে সেই প্রাচীন কাল থেকে মালটা গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখণ্ড ছিল, ছিল মুখর জনপদ। নিজেদের ভূখণ্ড থেকে খুব কাছে বলে রোমান বা ইতালিয়ানরা এখানে বেশি প্রভাবশালী ছিল। এমনকি এখনো ইতালিয়ান সবকিছুর সঙ্গে মালটার সম্পর্ক রয়েছে। 

বাইজেন্টাইন কারা। শব্দটা অপরিচিত লাগতে পারে। যদিও এই শব্দটা খুব একটা পরিষ্কারও না, কিছুটা জটিলও বটে। গ্রীক প্রভাবিত রোমান সাম্রাজ্য বা এর অংশ বিশেষকে বলা চলে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। যাদের মধ্যে গ্রিক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য প্রকট ছিল। 

৪০০ খ্রিষ্টপূর্বে কার্থেজেনীয়রা মালটা দখল করে প্রায় আড়াইশো বছর শাসন করে। ২১৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তা চলে যায় রোমানদের অধীনে। চতুর্থ শতকে রোমান সাম্রাজ্য মাল্টাকে পূর্ব ও পশ্চিমে দুই অংশে বিভক্ত করে। মাল্টার পূর্ব অংশ, যেটি রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, তা পরবর্তীকালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিতি পায়। ৮৭০ সালে মালটা চলে যায় আরবদের দখলে। তারা প্রায় ২০০ বছরের বেশি দেশটি শাসন করে।  

১৫৩০ সালে জেরুজালেমের সেন্ট জনের যোদ্ধারা দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এ দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। নিজেদের সুরক্ষার জন্য তারা এখানে প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গ তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করে। ১৫৬৫ সালে নাইটস অব সেন্ট জনের যোদ্ধাদের সঙ্গে তুরস্কের অটোম্যান যোদ্ধাদের সঙ্গে বড় যুদ্ধ হয়। অটোম্যানরা চল্লিশ হাজার সেনা সমাবেশ করেছিল। যুদ্ধে অবশ্য তুর্কিবাহিনী পরাজিত হয়। সেন্ট জন মালটার স্থপতি হিসেবে পরিচিত। সেন্ট জনের তৈরি করা সুরক্ষিত দুর্গ এবং প্রাসাদ সবই আছে এখনো। যদিও তা এখন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানের অন্তর্ভুক্ত। 

ইংরেজরা কোথায় ছিল না? অর্ধেক দুনিয়া তারা শাসন করতো। ১৮১৪ সালে ইংরেজরা মালটা দখল করে। বানায় ব্রিটিশ কলোনি। তাদের শাসনকাল ছিলো দেড়শ’ বছর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালীয় ও জার্মান বাহিনী দেশটির ওপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। তখন মালটার অধিবাসীরা নির্ভীক, অটল, অনড় হয়ে দ্বীপকে রক্ষা করেছিল। নিরস্ত্র মাল্টিজদের অসাধারণ দুঃসাহসিকতার জন্য মাল্টার জনগণকে ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জ ১৯৪২ সালে ‘জর্জ ক্রস’ সম্মানে ভূষিত করেন।



১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ড পার্লামেন্টে মাল্টার স্বাধীনতা বিল পাস হয়। স্বাধীনতা লাভের পর দেশটি ‘স্টেট অব মাল্টা’ নামে পরিচিতি পায়। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন রাষ্ট্রটির প্রধান। ১৯৭৪ সালে দেশটি ‘রিপাবলিক অব মাল্টা’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৪ সালে মালটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়।

সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রাচীন এক দ্বীপ দেশ মাল্টা। পর্যটন শিল্পে বিশ্বে বড় ধরনের এক স্থান দখল করে আছে দেশটি। উষ্ণ আবহাওয়া, ঐতিহাসিক নানা স্থাপনা, নান্দনিক স্থাপত্যশিল্প, বিনোদনের নানা সুযোগ-সুবিধা, কাজের সুবিধা, মাথাপিছু উচ্চ আয় থাকায় দেশটি সবার কাছে আকর্ষণীয়।

ভেলেটা বা ভাল্লেত্তা হচ্ছে মালটার রাজধানী। প্রায় সাড়ে চারশো বছর আধুনিক নগরীর গোড়াপত্তন ঘটে। গ্র্যান্ডমাস্টার জ্যঁ প্যারিজো দে লা ভালেত্তার নামানুসারে নগরীর নামকরণ করা হয়। এই শহরের প্রধান আকর্ষণ দ্য গ্রান্ড মাস্টার্স প্যালেস। নগরীর সবচেয়ে পুরনো ও সুন্দর প্রাসাদগুলোর একটি। বর্তমানে প্রাসাদটির একটি অংশ রাষ্ট্রপতির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর প্রাসাদের বাকি অংশ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এই প্রাসাদের খুব কাছেই রয়েছে রিপাবলিক স্কয়ার। এখানকার সুরক্ষা ব্যবস্থা, কামান স্থাপন, দূর থেকৈ শত্রুদের অবস্থান জানার জন্য দূরবিন- সবই এখনো দেখা যায়। 

মাল্টার পাশের একটি ছোট দ্বীপ গোজো। মালটা থেকে সেখানে যেতে হয় ফেরিতে। ধনীরা নিজস্ব ইয়ট বা হেলিকপ্টারে করেও যান সেখানে। সেখানে খ্রীষ্ট জন্মের সাড়ে তিন হাজার বছর আগের গগন্তিজার মন্দির রয়েছে। আছে চমৎকার প্রিন্সটিন বিচ। রয়েছে প্রাকৃতিক চুনাপাথরের খিলানযুক্ত আজুরে উইন্ডো।  যা গোজোর পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। দ্বীপ জুড়ে মধ্যযুগের অনেক নিদর্শন রয়েছে। শান্ত, নিরিবিলি ছুটি কাটানোর জন্য অনেকেই এই দ্বীপটিকে পছন্দ করেন। গোজো বিচে সাঁতার কাটা, সার্ফিং করা অনেকেই খুব জনপ্রিয়। 

কোমিনো দ্বীপকে বলা হয় ব্লু লেগুন। মালটায় অসংখ্য বিচ থাকলেও কোমিনো বেশ জনপ্রিয়। কোমিনো এবং কমিনটোটো দ্বীপের মাঝে এই নীল লেগুন অবস্থিত। লেগুনের চারদিকে শিলাবেষ্টিত থাকায় দেখতে মনে হয় যেন একটির প্রাকৃতিক সুইমিং পুল। আর এই কারণেই দশনার্থীদের ভিড় এখানে লেগেই থাকে। বালুময় বিচ আর স্বচ্ছ নীল জলের সমুদ্র সৈকতে সার্ফিং এবং স্কুবা ডাইভিং করার এক আদর্শ স্থান এটি। এখানে আছে পাখিদের অভয়ারণ্য। প্রকৃতির সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য এ অঞ্চলটিকে ন্যাচারাল রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করা হয়েছে। এই দ্বীপে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা নেই। সব হজায়গায় যেতে হয় পায়ে হেঁটে। 

কোমিনো দ্বীপের আরও একটি আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে চুনাপাথরের এক পাহাড়, যার নাম ব্লু গ্রাটো। হলুদ মাখানো সাদা পাথরের পাহড়ে হালকা নীল সমু্দ্রের জল আছড়ে পড়ে। অনন্তকাল ধরে জলের ঢেউয়ে নরম চুনাপাথর ক্ষয় হয়ে পাহাড়ের মধ্যে তৈরি করেছে বেশ কয়েকটি ছোট বড় গুহা। 

এখানকার চার্চ অব সেন্ট মেরি খুব বিখ্যাত। এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গম্বুজওয়ালা গির্জা। এটি নিয়ে একটি কিংবদন্তি বেশ প্রচলিত। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই গির্জার ওপর তিনটি বোমা বর্ষণ করা হয়। তার মধ্যে দুটো গম্বুজের ওপর পড়ে অন্যদিকে ছিটকে যায়। আর তৃতীয় বোমাটি যখন পড়ে তখন গির্জার মধ্যে ৩০০ যাজক উপস্থিত ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বোমাটি গম্বুজের ওপর পড়লেও তাতে বিস্ফোরণ ঘটেনি। গির্জার বাইরের একটি ঘরে বোমাটির একটি প্রতিকৃতি তৈরি করে রাখা আছে। সবার ধারণা ঈশ্বর এই গির্জা এবং যাজকদের রক্ষা করেছেন। 

আদতে মালটা আয়তনে ছোট হলেও গুরুত্বের দিক থেকে অনেক অর্থবহ। মালটা এখন বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দের্যে ভরপুর। সারা বিশ্বের অগনিত পর্যটক এখানে আসেন ছুটি কাটাতে, মালটার আবহাওয়া উপভোগ করতে। ট্র্যাক্স রিলাক্সড কান্ট্রি হিসেবেও এর পরিচিতি রয়েছে। ক্রিপ্টো কারেন্সির জন্য মালটা বিখ্যাত। এখানকার মাথাপিছু আয় বেশি বলে চাকরি এবং বসবাসের জন্য অনেকে্ই মালটাকে বেছে নিচ্ছেন। শেনজেনভুক্ত দেশ হওয়ায় ইউরোপীয় উইনিয়নের সব সুযোগ সুবিধা এখানে বিদ্যমান। সবচেয়ে বড় কথা মালটার ভিসা, রেসিডেন্ট পারমিট বা নাগরিকত্ব থাকলে ভ্রমণ, কাজ বা বসবাসের সুযোগ রয়েছে ইউপোরে ২৭ দেশে!



আরো পড়ুন