এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে পেলাম স্বর্ণালী এক সন্ধ্যা। একপাশে ভূমধ্যসাগরের তিমির কালচে জল, অন্য পাশে উজ্জ্বল, উচ্ছল এক নগরী। আলো ঝলমল করছিল কসমোপলিটান শহর। মাল্টাকে বলা চলে হোটেল রেস্টুরেন্টের নগরী। পানশালা আর খাদ্যশালার রঙ্গিন আলোয় আলোকিত রাস্তাঘাট।
রাতের বেলা মালটা শহরের চার্চ এবং ক্যাথেড্রালে বাজি ফোটানো হয়। আকাশ আলোকিত করে উৎসবের নগরীতে পরিণত করে সেসব বাজি। মাল্টা তখন অনেকটা উদ্বেগহীন উৎসবের নগরী। দামি হোটেলগুলোর গ্লাস লাইটে তখন চারপাশ থাকে উজ্জ্বল। পাশের সাগরের জলে তখন খেলা করে আলোর নাচন।
সাগরের পাড়ে একটি জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামলো। ইশতি, তার স্ত্রী ইফতি আর মাহবুব ভাই (মালটা বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য) আইসক্রিম নিলেন। এখানে আইসক্রিম খুব জনপ্রিয়। দোকানীর সঙ্গে পরিচয় হলো। নাম তার নিহান। বাড়ি নারায়নগঞ্জে। এখানে এসেছেন পড়ালেখা করতে। স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং এ পড়ছেন। পাশাপাশি এক্সট্রা ইনকামের জন্য এই বিজনেস। তার সঙ্গে ছিলেন মুন্সীগঞ্জের ফারুক।
তারা জানলেন, মালটাতে অনেক বাংলাদেশি স্টুডেন্ট আছেন। হোটেল, ট্যুরিজম, শেফিং, মার্কেটিং এসব বিষয়েই বেশি ছাত্রছাত্রী এখানে। তবে বাংলাদেশিদের কোনো অ্যাসোসিয়েশন নেই।
রাতের বেলা একটা সি বিচে গিয়ে বসেছিলাম কিছুক্ষণ। বুজিব্বা জায়গাটির নাম। অ্যারাবিয়ান নাম। এক সময় আরবরা এ দ্বীপদেশ শাসন করেছেন। মালটিজ ভাষার পরেই এখানে আরবির অবস্থান। ইংরেজি এখানে তৃতীয় প্রধান ভাষা। যদিও আমি সবাইকে ইংরেজিতে কথঅ বলতেই দেখেছি।
অনেক রাত অব্দি বিচে লোকজন থাকেন। হোটেল রেস্টুরেন্টগুলো খোলা থাকে ভোর রাত পর্যন্ত। ট্যুরিস্টদের জন্য মালটা শহর স্বর্গরাজ্য।
পরদিন রবিবার। সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই দেখা গেলো আকাশ ভরা রোদ্দূর। বুজিব্বা থেকে বের হয়ে গেলাম সেন্ট জুলিয়ানস নামক একটা জায়গা। সেটি মালটার সবচেয়ে পশ এরিয়া। বাংলাদেশের গুলশানের মতো। গিয়েছিলাম একটা কলেজ প্রিমিসেস দেখার জন্য। সব কিছু গোছানো-গাছানো পরিপাটি, চমৎকার। একটা জায়গায় আটকে গেলো চোখ। সাগরের ছোট্ট একটা অংশ ঢুকে গেছে সেন্ট জুলিয়ানস শহরের ভেতরে। সেখানে অসংখ্য স্পিডবোট, ইয়ট এসব রাখা সার বেঁধে। অনেক ট্যরিস্টের আনাগোনা। পাশেই দৃষ্টিনন্দন এক বিশাল হোটেল। এটি হোটেল হিলটন।
শনিবার আর রবিবার মালটায় সাপ্তাহিক ছূটি। আমাদের দেশে ছূটির দিনে সাধারণত সবাই বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করেন। এখানে উল্টো। ছুটির দিনে সবাই বাইরে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া হৈহুল্লোড় করে। অথবা পরিবারের সবাইকে নিয়ে আউটিং করে।
সাগরের তীর ধরে দ্বীপের উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিণ পূর্বে যাচ্ছিলাম। ডান পাশে পাহাড়। বা পাশে সমুদ্র। নীল সমুদ্রের জলে তখন মৃদুমন্দ বাতাসের খেলা। হঠাৎ রাস্তা থেকে বা দিকে একটা দীপের মতো জায়গা বের হয়ে গেছে সমুদ্রের দিকে। ডান পাশের পাহাড়টাও খুব সুন্দর। ওই দ্বীপে তখন উড়ছিল অনেকগুলো ঘুড়ি। বলা চলে ছোট একটা ঘুড়ি উৎসব চলছিল।
জায়গাটির না বাহারিচা। রঙ্গিন ঘুড়ি দেখেই ছোট বেলাকার কথা মনে পড়ে গেলো। কত উড়িয়েছি! সেসব দিনগুলো এখন কেবলই স্মৃতি।
মাল্টার ঘুড়িগুলো অন্যরকম। সাগরঘেরা দ্বীপের ঘুড়িতে ফুঁটে উঠেছে স্থানীয় নিজস্ব সংষ্কৃতি। ঘুড়িগুলো বেশিরভাগই মাছের প্রতিকৃতি। ছিল বাচ্চাদের প্রিয় চরিত্র টম অ্যান্ড জেরি। কিছু ছিল সাপের মতো। অক্টোপাস, রকেট, পিঁপড়া, গোলাপ ফুল-এই রকম বহু ধরনের ঘুড়ি। তিন-চারটে ঘুড়ি ছিল লম্বা চোঙ্গার মতো, রঙ্গিন কাগজে তৈরি। সেগুলো অনবরত ঘুরছিল।
ইশতি জানালেন, ঘুড়ি উড়াতে একটা পরিমিত বাতাস লাগে। লাগে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। কম বাতাস কিম্বা বেশি বাতাসে ঘুড়ি উড়ানো যায় না। আবার বেশি শীত বা বেশি গরম হলেও মনে ঘুড়ি উড়ানোর শান্তি থাকে না। পৃথিবীর সবকিছুতেই বোধহয় এরকম পরিমিতিবোধ থাকতে হয়!
দৃষ্টিনন্দন সেসব ঘুড়ি দেখে অনেকেই গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিল, ছবি তুলছিল, ভিডিও করছিল। মানুষের মনও ঘুড়ির মতোই। রঙ্গিন স্বপ্ন দেখে! আকাশে উড়ে। দিনশেষে আবারো সেই নীড়ে!