খুব শান্ত, নিরিবিলি একটি জায়গা। গাছে গাছে পাখি ডাকছিল। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছিল। পাকুর গাছের মতো ঝাকড়া ব্ল্যাক মালবেরির পাতা দুলছিল। রোদের চিকনিতে ঝলমল খেলছিল খালের জল। স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল শুকনো পাতার নুপুর। যদিও তখন ঠাণ্ডার দেশে তপ্ত দুপুর।
বলছি, একটি গ্রামের কথা। স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরাহ শহরের বুকে যার অবস্থান। রাজধানীর বুকে এরকম অন্তঃপুরের গ্রাম হয়তো অনেকের কল্পনার বাইরে। আর সেই কল্প গ্রাম দেখতেই সেখানে প্রতিদিন ভিড় করেন সারা বিশ্বের পর্যটকরা। নাম তার ডিন ভিলেজ।
গ্রামটিকে বলা যায় ছবির মতো সুন্দর। বাংলাদেশ-ভারতের মতো গ্রাম নয়। গ্রাম বলা হলেও সেখানে নেই কোনো কাঁচা ঘরবাড়ি। সব পাকা দালান, অট্টালিকায় ভরা। তারপরও গ্রাম বলে কেন ওরা! ওদের কাছে গ্রাম এরকমই। হয়তো জায়গাটি অতি নিরিবিলি এবং পুরনো ঐতিহ্যময় বলেই তারা গ্রাম বলে। হয়তো দু’তিনশ’বছর আগে গ্রাম ছিল। তাই আদতে গ্রাম না হলেও নামের সঙ্গে ভিলেজ শব্দটা আছে।
ডিন গ্রামটি লেইথ নদীর দুই তীরে। স্থানীয়রা যাকে নদী বলছেন, আসলে সেটি স্রেফ একটা খাল বা ক্যানেল। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ওই নদী। স্রোত গিয়ে মিশেছে বড় নদী হয়ে সাগরে।
জানা গেলো, ওই গ্রামটি অনেক বিখ্যাত। কেন বিখ্যাত? ১৯ শতকের পুরনো বাড়িঘর আছে। ১৯ শতক বলতে অনেকেই বোঝেন ১৯০০ সালের পর; তা নয়, ১৮০০ সালের পর। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষ ইংরেজদের দখলে চলে গিয়েছিল। আর এই গ্রামের ইতিহাস আরও পুরনো। তখন সেটি ছিল নদীর ধারের একটি ছোট্ট গ্রাম। শহরের খুব কাছেই যার অবস্থান। আশপাশ ছিল জঙ্গলে ঢাকা।
এরকম গ্রামতো বহু আছে। তাই বলে সেখানে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ভিড় করবে? এর কিছু বিশেষত্ব আছে। ডিনের রাস্তাগুলো পুরনো ছোট ছোট পাথর বসিয়ে তৈরি। ক্রাফ্টেড পাথরের এরকম রাস্তা সচরাচর দেখা যায় না। এমন রাস্তা তৈরি করতে বহু সময় লাগে। খরচও বেশি। ঢালু রাস্তাগুলো রাখা হয়েছে আগের মতোই। বাড়িঘরসহ সব ঐতিহ্যকে সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। চাইলেও কেউ নিজের ইচ্ছেমতো বাড়িঘর বানাতে পারবেন না। এমনকি মেয়র, এমপি-মন্ত্রী হলেও না। বাড়িগুলোও বিচিত্র ডিজাইনের। খানদানি ভাব আছে।
নামে গ্রাম হলেও এলাকাটি ছিল শিল্পসমৃদ্ধ। বেশ কিছু কলকারখানা ছিল। ওই লেইথ নদীর কথা বললাম, ওই নদীর স্রোত আটকে জলবিদ্যুত করা হয়েছিল। এখন গ্রামটি পুরোপুরি আবাসিক এলাকা। সেইসঙ্গে ট্যুরিস্ট স্পটে পরিণত হয়েছে। বাড়িগুলো অ্যাপার্টমেন্ট হয়ে গেছে। সিটি সেন্টারের খুব কাছে হলেও শান্ত ও নিভৃত গ্রাম। আর ওই নিরালা গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়েছে মুখে মুখে; ইন্টারনেটের কল্যাণে অনুসন্ধিৎসু সবার কাছে। সাইবার দুনিয়ায় তাই ডিনের নাম ইচ্ছে করলেই জানতে পারছে যে কেউ।
তবে রাস্তাগুলো ঢালু ও সরু। পাহাড়ের ওপরের বাড়িগুলোতে গাড়ি যাওয়ার জো নেই। সাইকেল চালায় কেউ কেউ। বাকিরা পায়ে হেঁটেও যাতায়াত করেন। যদিও ওপরে ওঠার রাস্তা ছিল অন্যদিক দিয়ে। যে পথে ট্যুরিস্টরা খুব একটা যাতায়াত করেন না। ভ্রমণ পিপাসুরা গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পছন্দ করেন। দেখতে থাকেন লেইথ নদীর দু’ধারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। নদীর দু’পাশে ফুলের বাগান। লেইথ নদীর দুই তীরে পুরনো নকশায় তৈরি বাড়িঘর। নদীর ওপর স্টিল-কাঠের ব্রিজ। ব্রিজ পাড় হয়ে জঙ্গলা নদীর ধার ধরে পথ হারিয়ে গিয়েছিল দূর অজানায়। কিছু প্রেমিক যুগলকে দেখলাম অন্য পাড়ের পথ দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল বনবিহারে।
ওই যে ব্রিজটির কথা বললাম, ওটা নাকি ১৯ শতকে তৈরি। ডিজাইন করেছিলেন থমাস টেলফোর্ড। স্কটিশরা ঐতিহ্যের মর্ম বোঝেন। এজন্য ওই বিজ্রটিকে আধুনিকায়নের নামে নষ্ট করেননি।
মোদ্দা কথা, ডিন ভিলেজ হচ্ছে একটি শান্তিপূর্ণ মনোমুগ্ধকর শহর। রাস্তা, নদী, ফুল, পুরনো বাড়ি আর ব্ল্যাক মালবেরি গাছের পাতা দিয়ে সাজানো একটি গ্রাম। যে কারণে ওই গ্রামে গিয়ে হাঁটতে বা কিছু সময় কাটাতে পছন্দ করে সবাই।
সকালে নটিংহ্যাম থেকে ট্রেনে চেপেছিলাম এডিনবরাহর উদ্দেশে। চ্যানেল আইয়ের স্কটল্যান্ড প্রতিনিধি হাস্যোজ্জ্বল হুমায়ুন কবীর ভাই এডিনবরাহ ট্রেন স্টেশনে এসেছিলেন রিসিভ করতে। এর আগেও একবার গিয়েছিলাম স্কটল্যান্ডে। করোনা সংক্রমণের আগে। সেবার অবশ্য আরেক সাংবাদিক বন্ধু সোয়েব কবীর আমাকে রেফার করেছিলেন হুমায়ুন কবীর ভাইয়ের কথা। ওই দুজনই অমায়িক মানুষ। নিজেওরা ঘুরতে খুব পছন্দ করেন। আতিথেয়তায় সেরা। দিলখোলা মানুষ। সব সময় কবীর ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটেই থাকে। এমনিতেই বিনয়ী। ইংলিশ বা স্কটিশদের সঙ্গে থেকে বিনয়বতার।
হালকা লাঞ্চ সেরে ভাবছিলাম কোথায় যাওয়া যায়। আগেরবার যেসব জায়গায় গিয়েছিলাম সেসব নয়। কবির ভাই জানেন, আমি গ্রাম খুব পছন্দ করি। তাই শহরের বুকে জেগে থাকা ডিনের নামই চলে এল সবার আগে।
স্কটল্যান্ড খুব ঠাণ্ডার দেশ। যদিও এখন গরমকাল। স্থানীয়রা হাফপ্যান্ট পাতলা টি শার্ট পরলেও আমার গায়ে কয়েক পুরৎ গরম কাপর। তার ওপরে ব্লেজার। শীত করলেও যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল স্কটল্যান্ডের অপার সৌন্দর্যে। গ্রীষ্ম বলেই কিনা, রাস্তা আর বাগানগুলো নানা রকমের ফুলে ভরা। মনে হচ্ছিল এ যেন স্বর্গধাম।
ডিন গ্রামে প্রবেশের রাস্তা একটি কালভার্ট দিয়ে শুরু। লেইথ নদীর ওপর। ওখানে দাঁড়ালেই জায়গাটির তাৎপর্য বোঝা যায়। পুরনো স্থাপনা। বিশাল ব্ল্যাকবেরি ঠাঁই দাঁড়িয়ে যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। বিভিন্ন দেশের লোকজন গ্রাম দেখতে এসেছিল। ডানদিকে একটি উঁচু সরু পথ পেরিয়ে সামনে এগোচ্ছিলাম। দেখলাম, নদীর ধারে জলের কাছে বসে ছবি আঁকছিল একজন। ব্রিজের ওপর উঠে ছবি তুললাম।
সেখান থেকে আবার ফিরলাম বাম দিকে। ওদিকটায় গাড়ি প্রবেশ নিষেধ। কল কল পানির শব্দ হচ্ছিল জঙ্গলের ভেতর। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, পানি পড়ছিল ওপর থেকে অনেক নিচে। আরেকটা বড় নদীতে (বড় খালে)। ওখানে জল আটকে তৈরি হতো জলবিদ্যুৎ। বামের পথটা ডানে বাঁক নিয়েছিল। ওপরে বিশাল একটা হাইওয়ে ব্রিজ। তার নিচ দিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে হাঁটার পথ।
পথের কোনো শেষ নাই, পথ মাপা বৃথা তাই। তবে এই পথে-পথেই যত বিচিত্র অভিজ্ঞতা। পৃথিবীকে দেখতে হলে ওই অজানা পথেই যেতে হয়। পথ যাকে হাতছানি দেয়, ডাকে; কে আটকাবে তাকে। যে ক’টা দিন মনের কোণে পথের স্বপ্ন আঁকি, এই পথেই যেন থাকি।