মালটা। শব্দটি মাথায় এলেই কমলা লেবুর মতো দেখতে রসালো ফলের ইমেজ ভেসে ওঠে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের দেশ মালটা’র রূপের গল্প মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। ছোটবেলায় রূপকথার গল্পে যেমন রাজা-রানির গল্প শুনেছি, সে-রকম শুনেছি দ্বীপদেশ মালটার কথাও। ক্লাস নাইনে ভূগোল বিষয়ে রাজধানীর নাম মুখস্থ করেছি; মালটা-ভেলেটা।
শুনেছি ভূমধ্যসাগরের একটি দ্বীপ মালটা। সেখানকার আবহাওয়া বাংলাদেশের কক্সবাজার-কুয়াকাটার মতো। কিন্তু দেখতে নয়নাভিরাম সুন্দর, অনিন্দ্য সুন্দর। অনিন্দ্য শব্দটাই যথোপযুক্ত, যার নিন্দা করার কিছু নেই।
একে তো ইউরোপের দেশ, তাতে আবার শেনজেনভুক্ত। অর্থাৎ মালটায় প্রবেশ করে ২৭টি দেশ বেড়ানো যায়। এখানে কাজের পারমিশন থাকলে ২৭ দেশের যে কোনোটাতে স্থানান্তর হওয়া যায়। এখানে ওয়ার্ক পারমিট ও ভিসা পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। পাঁচ বছর বসবাস করলে মেলে নাগরিকত্ব। শুনেছি ট্যাক্স রিলাক্স কান্ট্রি হিসেবে দেশটির সুনাম রয়েছে।
আরও জেনেছি, মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবেররা এখানে আস্তানা গেঁড়েছেন। লিবিয়ার গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর সেখানকার অনেক মানুষ মালটায় এসেছেন। ইউরোপের নাগরিকরাও মালটায় থাকতে পছন্দ করেন। আগামীতে নাকি মালটা হতে যাচ্ছে উইরোপের হাব। তবে অতি সম্প্রতি মালটার পরিচয় ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি এবং বেড়ানো চমৎকার জায়গা হিসেবে।
আরও একটা আকর্ষণীয় তথ্য আছে। চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত বলে এর আবহাওয়া সমভাবাপন্ন। মানে নাতিশীতোষ্ণ। না শীত, না গরম। ফলে ইউরোপের শীতে কাবু হওয়া লোকজন এখানে আসেন গায়ের চামড়া বার্ন করাতে বা পোড়াতে। মধ্যপ্রাচ্যের লোকজন আসেন অতিগরম থেকে বাঁচতে। আবার এশিয়ার লোকজন পছন্দ করেন তাদের দেশের মতো আবহাওয়ার একটি উইরোপীয় দেশ হিসেবে।
বাংলাদেশের মানুষ আমরা। সাধ, সাধ্য কখনো মেলাতে পারি না। যখন হাতে টাকা পয়সা থাকে তখন হয়তো ভাবি মালটা যাব ভিসা পাব কেমনে। কারণ ইউরোপের ভিসা পাওয়া বাংলাদেশীদের জন্য সহজ কিছু নয়। আবার ভিসা মিললেও অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। থাকা, খাওয়া ইত্যাদি। আবার পরিচিত কেউ না থাকলেও এক ধরনের শাইনেজ তাজ করে।
বছর দশেক আগে আয়ারল্যান্ডে গিয়ে এক তরুণের সাথে পরিচয় হয়েছিল। নাম তার নাজমুল ইশতিয়াক। ইশতি বলে ডাকতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনেদ পড়ালেখা করে ইউকে তে পড়েছেন কিছুদিন। ইমিগ্রেশন ল পড়েছেন আয়ারল্যান্ডে। এরপর মালটাতে গিয়ে পড়েছেন মেরিটাইম ল। থিতু হয়েছেন সেখানেই।
ইশতির সাথে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। এরমধ্যে বাংলাদেশে গিয়েও তিনি দু’বার দেখা করেছেন আমার সঙ্গে। বার বার মালটা যেতে বলেছেন। মালটার অনেকে প্রশংসা করেছেন। কিন্তু সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
কিছুদিন আগে আবার ইশতির নিমন্ত্রণ। তিনি এখানে ‘মালটা বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংস্থার রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন। সেই অ্যাসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে আমাকে ইনভাইট করছেন। ভিসা পাব কেমনে?
-ভিসার বিষয় আমি দেখব, আপনি শুধু আসার নিয়ত করেন; ইশতির উত্তর।
বাংলাদেশের ইটালি দূতাবাসের ভিএফএস সেন্টারে আবেদন জমা দিলাম। যথাসময়ে ভিসা হয়ে গেলো। টিকিট কেটে প্রস্তুতি নিলাম।
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি মালটার ফ্লাইট নেই। এমিরেটস এবং টারকিশ এয়ারলাইনস এ দুটিতে বেশি প্যাসেঞ্জার মালটা আসেন। আমি টারকিশ এয়ারলাইন্সের টিকিট নিলাম। কারন ইসতাম্বুল হয়ে আসলে ট্রানজিট টাইম কম লাগে।
মুশকিল হলো টারকিশ এয়ারের বাংলাদেশ ফ্লাইট খুব অড টাইমে। ভোর ৬টা ২০ মিনিটে ফ্লাইট। ৪ টার মধ্যে এয়ারপোর্টে থাকতে হয়। তারও আগে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হতে হয়। মানে রাতে আর ঘূমানোর সুযোগ নেই।
এয়ারপোর্টে এসে দেখা হলো ড. আবুল হোসেন তুহিনের সঙ্গে। চাচাতো ভাই। বয়সে আমার ছোট। পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেন। যৌথ নদী কমিশনের সদস্য। ফ্রান্সে যাচ্ছে একটি সেমিনারে অংশ নিতে। দুই ভাই আলাপে আলাপে সময় কাটল। এর মধ্যে এয়ারপোর্ট থেকে কিছু চা কিনলাম গিফ্ট হিসেবে আনার জন্য। ক্রেডিট কার্ডের ফরেইন পার্ট ওপেন করে নিলাম।
শুনলাম ফ্লাইট এক ঘণ্টা দেরিতে ছাড়বে। আহ! এটা আগে জানলে ঘুমিয়ে আসা যেতো। শেষ মেষ প্রায় ২ ঘণ্টা দেরিতে ফ্লাইট উড়লো আকাশে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক যাত্রীর হাই প্রেসার শুরু হয়ে গেলো। যেমন তুহিনের ট্রানজিট টাইম ৪৫ মিনিট। সে কি পরের ফ্লাইট ধরতে পারবে? অনেকের এক থেকে ২ ঘণ্টা ট্রানজিট টাইম ছিল তাদেরই বা কি হবে!
সব যাত্রী ঘুমোচ্ছিল। একটা শিশু অনবরত কেঁদে যাচ্ছিলো। আর আমার চোখে ঘুম নেই। যানবাহনে ঘুম হয়না আমার।
জোরে চালিয়ে ঘণ্টাখানেক কাভার করেছিলেন পাইলট। এক ঘণ্টা দেরিতে ল্যান্ড করলো ইস্তাম্বুলে। আমার টেনশন কম, ট্রানজিট টাইম ছিল ৪ ঘণ্টা। সেটা কমে নেমে এলো ৩ ঘণ্টায়। তবে ইস্তাম্বুল থেকে মালটার ফ্লাইটও প্রায় এক ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ল। ফাইনালি ৩০ মিনিট লেটে মালটা ল্যান্ড করলাম। তবে তুহিনের কি হলো এখনো জানতে পারিনি।
একবার মালদ্বীপ গিয়ে খুব ভয় পেয়েছিলাম। জানালার পাশে সিট ছিল। দেখলাম সাগরের মধ্যে ফ্রাইট ল্যান্ড করছে! ঘটনা কি। ভয়ে শরীর শক্ত হয়ে গেলো। দেখা গেলো বিমানের চাকা মাটিতেই পড়লো। ওদিকে আবার দৌড়াতে দৌড়াতে ফ্লাইট সাগরে গিয়ে পড়ে কি না সেই ভয়ও ছিল। শেষ অব্দি সাগরের পাড়ে গিয়ে এয়ারক্রাফ্ট থেমে গিয়েছিল। বন্দরের নাম হুলোমালে।
মালটাতেও মনে হচ্ছিলো সাগরের মধ্যে ল্যান্ডিং হচ্ছে! না, এখানে অবশ্য এয়ারপোর্ট ছোট, কিন্তু মালদ্বীপের মতো এতো ছোট না। এয়ারপোর্টের পাশে কিছু চাষাবাদের জমিও দেখা গেলো। এক তলা এয়ারপোর্ট। নেমে দ্রুত চলে গেলাম ইমিগ্রেশনে।
এখানে বাংলাদেশীরা আসেন সব কাজ করতে। ভিজিটর খুব কম। এজন্য ইমিগ্রেশনে যদি শুনে বেড়াতে এসেছে- সেটাই বরং তারা সন্দেহ করে। যা হোক, কি জন্য এসেছি? ফিরব কবে, হোটেল বুকিং কই?- এ কয়টা প্রশ্নই করলো। তারপওর ভালো করে দেখল পাসপোর্ট। পুরনো পাসপোর্টগুলোও ভালো করে দেখল। হয়তো ভাবলো লোকটার যেহেতু অনেক দেশ ঘুরার রেকর্ড আছে তাহলে জেনুইন ভিজিটর হতে পারে। সিল মেরে দিয়ে দিল পাসপোর্ট।
এক্সিট পয়েন্টে গিয়ে দেখি ইশতি দাঁড়িয়ে। সঙ্গে তার স্ত্রী ইফতি। ছিলেন বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন এর লোকজনও। ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন তারা। এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়ি পার্ক করা ছিল। সরাসরি হোটেলে না গিয়ে সমুদ্রের পাড় ধরে গাড়ি এগোতো থাকলো। স্থানীয় সময় তখন সন্ধ্যা ৭ টা। সমুদ্রের হাওয়া আর পরম আতিথিয়েতায় সব ক্লান্তি উবে গেলো। ডুবে গেলাম মালটার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে।