২৯ জুন ২০২৪, শনিবার



উদয় হাকিমের কলাম
প্রিন্ট

ইংল্যান্ড: যাত্রা আস্তি না কি নাস্তি!

উদয় হাকিম, যুক্তরাজ্য থেকে || ২৪ মে, ২০২৩, ১১:০৫ এএম
ইংল্যান্ড: যাত্রা আস্তি না কি নাস্তি! ম্যানচেস্টার এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পথে লেখক


ছোট বেলায় দেখতাম পঞ্জিকাতে শুভ-অশুভ দেখা হতো। যাত্রা শুভ হলে লিখতো ‘যাত্রা আস্তি’; অশুভ হলে ‘নাস্তি’। 

ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনালের কাজ চলছে। আগের দুটো টার্মিনালে বেজায় ভিড়। দ্বিতীয় তলায় গেটের অনেক বাইরে থেকে লম্বা লাইন। ভেতরে ঢুকতেই নাকি ঘণ্টাখানেক লেগে যায়! ওদিকে বিমানের কাউন্টারে অনেক সময় লাগে বোর্ডিং পাস নিতে। এসব বাস্তবতা মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বের হলাম সকালে। 

ঢাকার ইসিবি চত্বরে বিশাল জ্যাম দেখে ভয় পেয়েছিলাম। ফ্লাইট মিস করার ভয়। সকাল ১১ টায় ফ্লাইট। শেষ অব্দি, দুঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্টে। কিন্তু কোথাও লাইন নেই। প্রথম টার্মিনাল হজযাত্রীদের জন্য বরাদ্দ। সেখানে কেউ নেই। দ্বিতীয় টার্মিনাল অন্য সবার জন্য, সেখানে দুই-তিন জন যাত্রী। 

ব্যাগ স্ক্যান করে ভেতরে ঢুকেও দেখলাম একই চিত্র। লোকজন খুব কম! হঠাৎ ফ্লাইট সংখ্যা কমে গেল কি! 

বিমানের কাউন্টারে গিয়ে আরও থ। আমার আগে মাত্র একজন। আর বিজনেস ক্লাসের কিউতে একজন। 

৩ নম্বর ইম্রিগেশনে মহাখালি! পার হয়ে গেলাম সহজেই। স্ক্রিনে দেখাচ্ছিল ৪ নম্বর গেট ওপেন। গিয়ে দেখলাম তখনো কেউ নেই। সিকিউরিটি চেক বা টিকিট চেক করার লোক তখনো আসেনি। এক আনসার সদস্য এগিয়ে এসে জানালেন, আরও দেরি হবে। 

আধাঘণ্টা পর টিকিট-পাসপোর্ট চেকিংয়ে গিয়ে দেখি আমার আগে মাত্র একজন। কৃষকায় এক তরুণ। দুজন কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। তরুণটি মালয়েশিয়ান পাসপোর্টধারী। ইংরেজি ভালো বলতে পারে না। সন্দেহ হচ্ছিল সে কেন ইংল্যান্ডে যাবে! গেলেও ঢাকা থেকে কেন?

প্রশ্ন করা হলো ঢাকায় কবে এসেছেন? 

-৩১। 
-কোন মাসের? 
আমতা আমতা করে। 
-৩১ মার্চ?
-ইয়েস। 
-টিকিটে কেটেছে কে?
-ফ্রেন্ড। 
-ফ্রেন্ডের নাম কি?

মাথা চুলকায়। বলতে পারে না। একটা মোবাইল নাম্বার দেখায় নিজের হোয়াটসঅ্যাপ কনভারসেশন থেকে। লোকটিকে একপাশে সরে যেতে বললো। আমার পাসপোর্ট টিকিট দেখে আমাকে ছেড়ে দিলো। 

ছেলেটির গতিবিধি সন্দেজনক। দেখতে মনে হলো শ্রীলঙ্কান। কিন্তু তার পাসপোর্ট মালয়েশিয়ান। ভুয়া পাসপোর্ট হতে পারে। হতে পারে কোনো দালালের মাধ্যমে ইংল্যান্ড যাচ্ছে। অনভিজ্ঞ বোকা ছেলেটাকে একা ছেড়েছে। ৩১ মার্চ ঢাকায় এলে সে এতদিন কোথায় ছিল। নাকি মানব পাচার এরকমই। 

সিকিউরিটি চেক পার হয়ে দেখলাম ছেলেটাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। পরে আর তাকে ফ্লাইটের ভেতরে দেখিনি। বেচারা!

মাগনা পেলেও সবসময় সব খেতে নেই। এই চাচাও অতিরিক্ত করলেন। এটা একটা অসভ্যতা। বোঝা উচিত অন্যের অসুবিধা হয় এমন কোনো কাজ করা অসভ্যতা। পুরো যাত্রাপথে পান চিবোতে চিবোতে, দুর্গন্ধ বিলাতে বিলাতে এলেন অভদ্র লোকটা। বিমানের উচিত ফ্লাইটের ভেতর পান খাওয়া বন্ধ করা। 


অল্প কয়েজন যাত্রী নিয়ে সময়মতো ফ্লাইট ছাড়লো। আগে যাবে সিলেট। সেখান থেকে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার। ইংল্যান্ডের প্রচুর যাত্রী সিলেটি। তবে আগে বিমানের ফ্লাইট ছিল ঢাকা-হিথরো। হিথরো খুব ব্যস্ত এয়ারপোর্ট। ওখানে ফ্লাইট ওঠানামার চার্জ অনেক বেশি। তাই ওই ফ্লাইট ট্রান্সফার করা হয়েছে ম্যানচেস্টারে। এর ফলে ভাড়া তুলনামূলক কমেছে, যাত্রী বেড়েছে। 

কথা হলো রাজিবুল হাকিম সাগরের সঙ্গে। তিনি মাউন্টেইন ক্লাব ট্যুরস-এর ডিএমডি। যাবেন লন্ডন। ব্যবসা কেমন? জবাব দিলেন, চলছে ভালোই। 

২২ মিনিটে সিলেট। এবার বিমানে আর কোনো সিট খালি নেই। ফুল বুকড। কিন্তু কপাল খারাপ আমার। ভাবছিলাম পাশে একজন সুন্দরী তরুণী বসবেন। হলো তার উল্টো। এক বুড়া চাচা বসলেন। শুরুতেই তিনি ঝগড়া লাগিয়ে দিলেন। জানালার পাশের সিট নাকি তার। অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে তাকে তার নিজ সিটে বসানো গেলো। গরমের মধ্যে তিনি চার স্তরের জামা কাপড় পরেছেন। লম্বা দাড়ি। পাঞ্জাবির পকেট ভরা পান। উৎকট গন্ধ আসছিল মুখ থেকে। কথা বলার সময় পচা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। 

একটা কম্বল চেয়ে নিলাম বিমান বালার কাছে। সেটা দিয়ে নাক বন্ধ করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর এক ক্র্রুকে বললাম অসুবিধার কথা। জানালেন, সিট খালি থাকলে আমাকে অন্যত্র সরিয়ে নেবেন। যদিও সিট খালি ছিল না। 

সাবেক ক্রিকেটার সানোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আমার ভালো খাতির। তিনি বিমানে কাজ করেন। আগের রাতে ফোন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ওই ফ্লাইটে এলিন ম্যাডাম থাকবেন। তিনি টেক কেয়ার করবেন। কিন্তু ফ্লাইটের ভেতরে পরিচয় হলো টিম লিডার আকাশ ভাই, আরিফ ভাই, এলিন ম্যাডাম সবার সঙ্গে। তাদের আন্তরিক সেবায় মুগ্ধ। ইন্টারন্যাশনাল মানের সেবা। 

কিন্তু সব সেবা ‘হেবা’ দিলো ভূরিওয়ালা বুড়া চাচা। আঙুল মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে ডাস্টবিনের ভেতর থেকে পচন দ্রব্য বের করে আনছিলেন। আমার সিটের পকেট থেকে কম্বলের পলিথিন নিয়ে তার ভেতরে পান-সুপারি-খয়ের-জর্দার পঁচা মিশ্রণ ফেলছিলন। ডাস্টবিনের গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। পানে সুগন্ধ থাকার কথা, অথচ এখানে দুর্গন্ধ! 

১২ ঘণ্টার জার্নি আমার বিষময় করে দিলেন চাচা। তিনি যখন ঘুমাচ্ছিলেন, তখন নাক ডাকছিল। কিন্তু তার মুখ বন্ধ ছিল না। মুখ দিয়েও সমান তালে বাতাস যাওয়া আসা করছিল। একটু পর ঘেমে চাচা মোটা কাপড়গুলো খুলতে লাগলেন।  এরপর পান বের করে একটার পর একটা মুখে দিতে লাগলেন! ফল দুর্গন্ধ অন, স্বস্তি গন। 

একটা বিষয় ভাবছিলাম। এয়ারক্রাফ্টে পান খাওয়া বন্ধ করা হয় না কেন। বিড়ি বন্ধ, অথচ পান চালু! শুনেছিলাম দুবাইতে পান খাওয়া বন্ধ। এখনো বন্ধ আছে কি না জানি না। পানের পিক ফেলে সব জায়গা নোংরা করে ফেলা হয়। এজন্য কিছুদিন সেখানে পান আমদানি বন্ধ ছিল। এমিরেটস-এর ফ্লাইটে মদ সরবরাহ করা হয়, কিন্তু পান-বিড়ি বন্ধ। 

মদ নিয়ে একটা কাহিনি না বললেই নয়। গত বছরের জানুয়ারিতে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন একটি করপোরেট হাউজের কয়েকজন কর্মকর্তা। এর মধ্যে একজন দুবাই থেকে ফ্লাইট ছাড়ার পর মদ চাইলেন। বিমান বালা হাসিমুখে এনে দিলেন। একটার পর একটা মদ গিলছিলেন। গুনে দেখলাম ছোট ছোট ১২ বোতল মদ নিলেন তিনি। এরমধ্যে ৬ বোতল খাওয়ার পর শুরু হলো বমি। ফ্লাইটের কম্বল ভাসিয়ে দিলেন। 

কোনো কিছুই অতিরিক্ত ভালো না। মাগনা পেলেও সবসময় সব খেতে নেই। এই চাচাও অতিরিক্ত করলেন। এটা একটা অসভ্যতা। বোঝা উচিত অন্যের অসুবিধা হয় এমন কোনো কাজ করা অসভ্যতা। পুরো যাত্রাপথে পান চিবোতে চিবোতে, দুর্গন্ধ বিলাতে বিলাতে এলেন অভদ্র লোকটা। বিমানের উচিত ফ্লাইটের ভেতর পান খাওয়া বন্ধ করা। 

ম্যানচেস্টারের আকাশে এসে বাইরে তাকালাম। নিচে গ্রীষ্মের সুন্দর প্রকৃতি। সাজানো মাঠ। ফুলের গাছ। ফসলের মাঠ। ছবির মতো ঘর-বাড়ি। 

ফ্লাইট থেকে নেমে খানিকটা বাঁচলাম। 

খুব সহজেই ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম। পা রাখলাম ইংল্যান্ডে। 

 



আরো পড়ুন