ক্রিকেট,
ফুটবলসহ অন্য খেলাগুলো এখন আর কেবল খেলা নয়। রীতিমতো বিজ্ঞান। সেই বিজ্ঞান
নিয়ে এখন সবাই গবেষণায় ব্যস্ত। বিজ্ঞাননির্ভর খেলাতে এখন বিশষজ্ঞদের যুগ।
গোড়ায়
গলদ কেন? গাছের যেমন গোড়াটাই আসল। গোড়া থেকেই পুরো গাছের প্রাণ সঞ্চার হয়।
ক্রিকেটেও কথাটা শতভাগ প্রযোজ্য। ইনিংসের শুরুটা, মানে ব্যাটিং ভালো হলে
দল পায় লড়াই করার মতো পুঁজি। পরের ব্যাটারগণ খেলতে পারেন ইচ্ছেমতো। কিন্তু
শুরুতে উইকেট পড়ে গেলে দল চাপে পড়ে যায়। আবার বোলিংয়ে শুরুতে উইকেট পেলে
ফিল্ডিং পক্ষ এগিয়ে যায়।
এ
কারণে ব্যাটিংয়ে সব দলই বিশেষজ্ঞ ওপেনারদের পাঠায়। কিন্তু গত দু’তিনটি
সিরিজে দেখলাম, ঠিক তার উল্টো পথে বাংলাদেশ। ওপেন করানো হচ্ছে মিরাজ ও
সাব্বিরকে দিয়ে। অথচ তাদের কেউই বিশেষজ্ঞ ওপেনার নন। অন্যদিকে বসিয়ে রাখা
হচ্ছে স্বীকৃত ওপেনারদের। আর এটাকেই বলা হচ্ছে গোড়ায় গলদ।
এর
আগে কয়েকটি সিরিজে লিটন ছাড়া অন্য ওপেনারগণ রান পাননি। লিটন দুর্দান্ত
ভালো করছেন। তাহলে লিটনকে কেন ওপেনিং থেকে সরানো হচ্ছে। বিষয়টি একেবারেই
গোলমেলে। ব্যাটিং লাইন আপ নিয়ে মাহেলা জয়বর্ধনে বলেছিলেন, বাংলাদেশের উচিত
সবচেয়ে ভালো ব্যাটসম্যানকে বেশি সময় ব্যাটিং করার সুযোগ দেওয়া। তাতে দল
লাভবান হয়। সেটা মানলে লিটনকেই উদ্বোধনী ব্যাটার হিসেবে নামানো উচিত। আবার
তিনি বিশেষজ্ঞ ওপেনার, স্বীকৃত ওপেনার। ভালো ব্যাটার বলে লিটনকে যদি মিডল
অর্ডারে নামানো হয়, তার মানে গোড়াতে ইচ্ছে করেই গলদ রাখা হচ্ছে। নিজেদের
দুর্বল জায়গাকে দুর্বলই রাখা হচ্ছে।
মিরাজকে দিয়ে ওপেন করিয়ে কালেভদ্রে হয়তো সাফল্য পাওয়া যাবে, কিন্তু সেটা অনেকটা জুয়ার বাজির মতো। বাজিতে একবার জিতলেও হারতে হয় বারবার। আর সাব্বির তো পুরো ব্যর্থ।
আমার
কাছে তাই লিটন আর সৌম্য সেরা জুটি। যেটি করেছিলেন ভয়ডরহীর ক্রিকেট শেখানো
হাতুরু সিং। সৌম্যকে পছন্দ কারণ তিনি সোজা ব্যাটে খেলতে পারেন। এশিয়া কাপসহ
গত দুটি সিরিজে সাব্বিরকে মনে হলো আত্মবিশ্বাসহীন এলোমেলো সৈন্য। আরব
আমিরাতের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে মিরাজ রান পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেটাও ওই
এলোমেলো খেলেই। অথচ এই মিরাজকেই কতটা সতেজ চটপটে মনে হয়েছে বোলিং এবং
ফিল্ডিংয়ে। তাই টেলএন্ডার হিসেবেই আসল মিরাজকে পাওয়া যাবে। জোর করে কাউকে
যুদ্ধে ঠেলে দেয়া ঠিক নয়।
আরব আমিরাত সিরিজে সাকিব ছিলেন না বলে লিটন ওয়ান ডাইনে খেলেছেন। সাকিব যখন খেলবেন তখন? চার নম্বরে? টিম ম্যানেজমেন্ট হয়তো সেটাই ভাবছে। তবে লিটনকে ওপেনিংয়ে দিয়ে চারে আফিফ, পাঁচে সৈকত, ছয়ে সোহান, সাতে মিরাজকে ভাবলেই মনে হয় ভালো ফল দেবে। এদের কেউ খারাপ করলে অথবা ইনজুরিতে পড়লে ইয়াসির, সাব্বির, শান্ত ব্যাকআপ হিসেবেন থাকছেন ব্যাটিং লাইন আপে।
এবার
আসা যাক বোলিং বিষয়ে। মোস্তাফিজ এখনো স্ট্রাগল করছেন। ছন্দে ফিরতে
পারেননি। যদিও তিনি অটোচয়েজ। সাইফুদ্দিন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন; ছন্দে নাই,
ফিল্ডিংয়েও তার হতশ্রী অবস্থা। তাসকিন ভালোই করছেন, তবে রান আটকানোর পথ
খুঁজতে হবে তাকে। আরও কিপটে বোলিংয়ের পরিকল্পনা করে মাঠে নামতে হবে। তৃতীয়
সিমার অবশ্যই শরিফুল। পেস বোলারদের ক্ষিপ্রতা একমাত্র তার বলেই আছে, যেটা
নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় কাজে দেবে। বোলিংয়ে সবচেয়ে বড় বিপদ হলো
টাইগারদের ইয়র্কার বোলার নেই। এমনকি প্রতিপক্ষের ইয়র্কার বল ফেস করে রান
তোলার ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে।
স্পিনে
সাকিবের সঙ্গে অলরাউন্ডার হিসেবে মিরাজ থাকছেন অবশ্যই। তৃতীয় কাউকে দরকার
হলে কেবল তখনই নাসুম। আরব আমিরাতের সঙ্গে নাসুম ছিলেন ভীষণ খরচে। তবে
সময়মতো সৈকতের বোলিং হতে পারে অধিনায়কের ট্রাম্পকার্ড।
বিষয়গুলো
ভালো করে পরখ করার জন্য আরব আমিরাতের সঙ্গে হয়ে যাওয়া শেষ দুটি ম্যাচ খুব
মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। বাংলাদেশকে টাইগারভক্তরা বিশ্বক্রিকেটের পরাশক্তি
হিসেবেই ভাবেন। এজন্য দলকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন। অনেক আবেগ। অফুরন্ত
ভালোবাসা। কিন্তু সেই আবেগের প্রতিদান তারা বেশ কিছুদিন ধরে পাচ্ছেন না।
বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি এবং টেস্ট ফরমেটে শ্রীহীন অবস্থা। আমিরাত সিরিজেও
তাই।
আমিরাতের
সঙ্গে ব্যাটিংয়ে প্রথম ম্যাচে ৪র্থ ওভারে মাত্র ৩ রান এলো। তবু ওয়াইড থেকে
১ রান। তার মানে ফিল্ডিং রেসস্ট্রিকশনের ফায়দা নিতে পারছি না আমরা। মেরে
কেটে খেলার মানসিকতা নেই। সেটা নেই হাতুরু যাওয়ার পর থেকেই।
দ্বিতীয়
ওভারে সাব্বির নেই। ০ রানে বিদায়। তৃতীয় ওভারে লিটন নেই। ৮ বলে ১৩ রান করে
আউট। মিরাজ তখন ১১ বলে ৭ মাত্র রানে। ১৩ বলে ১২ রান করে মিরাজ আউট।
মিরাজকে প্রথম ম্যাচে আনাড়ি ব্যাটসম্যান মনে হয়েছে। নার্ভাস, ফুটওয়ার্ক
নেই, এলোমেলো ব্যাট নাড়াচাড়া। ফল ৪.৪ ওভারে ৩৫ রানে তিন উইকেট নেই। ৬ ওভারে
সংগ্রহ মাত্র ৪২/৩।
এরপর ৬ বলে ৪ রান করে ইয়াসির আউট। দলের প্রয়োজন যখন ছিল, ঠিক তখনই তিনি প্রস্থান করলেন। এখানে টিকে থাকা, বুক চিতিয়ে লড়াই করা দরকার ছিল। অফ স্ট্যাম্পের ওপরের বল ক্রস খেলতে গিয়ে আউট। ক্রস প্রবলেম বাংলাদেশে দলের একটি রোগ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবাই ওই রোগে আক্রান্ত। একমাত্র সৌম্যকে সোজা ব্যাটে খেলতে দেখা যায়। যদিও স্পিনে কিছুটা দুর্বল তিনি।
১১তম
ওভারের শেষ বলে ৮ বল খেলে ৩ রান করে স্ট্যাম্পড মোসাদ্দেক। স্লগ ওভারের
ব্যাটিং টেকনিক তিনি নিয়ে এলেন ইনিংসের মাঝপথে, যেখানে দরকার ছিল উইকেটে
টিকে থাকা। ১৩ ওভার শেষে দলের রান ৮৯, ততক্ষণে নেই টপ আর মিডল অর্ডার। ১৪তম
ওভারে রান আসে মাত্র ৩টি। সোহানকে মনে হচ্ছিল উদভ্রান্ত। কী করবেন, বুঝতে
পারছিলেন না। প্রথম ১০ বলে তার রান মাত্র ৫। বলে ব্যাটই লাগাতে পারছিলেন
না। ১৫ ওভারে বাংলাদেশ ১০৩/৫। প্রথম ৫২ বলে এলো ৫০! যদিও শেষপর্যন্ত সোহান
৩৫ (২৫) করেছেন। তবে আফিফ একাই দলতে দিয়েছেন জেতার ভিত। করেছেন অপরাজিত ৭৭
(৫৫)।
ওই
ম্যাচের বোলিংয়ে আসি। সাইফুদ্দিনের বলে গতি নেই। লাইন নেই, লেন্থ নেই। সব
এলোমেলো। আনফিট মনে হচ্ছিল। ৪ ওভারে দিলেন ৪০রান। ফিজ তার নিজের ছায়া হয়ে
ছিলেন। বলে পুরনো ধার নেই। অন্যদিকে শরিফুলকে মনে হলো প্রাণোচ্ছ্বল। জেতার
ক্ষুধা ছিল, ছিল অ্যাগ্রেসিভনেস, যেটা যুদ্ধ ও খেলার মাঠে দরকার।
যে
মিরাজকে ব্যাটিংয়ে মনে হচ্ছিল একেবারেই অগোছালো। সেই মিরাজ বোলিংয়ে ছিলেন
দারুন সফল। উইকেট পেয়েছেন। প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছেন।
তার মধ্যেও ছিল তারুণ্য, উচ্ছ্বলতা, আক্রমণাত্বক ভাব। ফিল্ডিংয়ে লিটনকে
সিরিয়াস মনে হয়নি। নাসুমকে মনে হলো খুব অর্ডিনারি বোলার। খরচে বোলার।
১৯.২ ওভারে সাইফুদ্দিন এমন সহজ এক ক্যাচ ছাড়লেন যে, ধারাভাষ্যকার অবাক হয়ে গেলেন! এমন ক্যাচও ছাড়া যায়! সাব্বিরকে শুধু ব্যাটিংয়েই নয়, ফিল্ডিংয়েও খুব দুর্বল মনে হলো। দীর্ঘদিন পর দলে এসে তার জড়তা এখনো কাটেনি।
এবার
আসা যাক দ্বিতীয় ম্যাচ প্রসঙ্গে। প্রথম ৬ ওভারে আসে ৪৮/১। বাউন্ডারি
সীমানা ছোট করে ফেলা মাঠে আমিরাতের মতো দুর্বল প্রতিপক্ষের সঙ্গেও ফিল্ডিং
রেস্ট্রিকশনের ফায়দা নিতে পারেনি বাংলাদেশ। তাহলে বিশ্বেকাপে? কিংবা
নিউজিল্যান্ডে? দ্বিতীয় ম্যাচেরও পুরোটা জুড়েই শঙ্কিত পদযাত্রা। মিরাজ আর
সোহান ছাড়া আর কেউ বলার মতো রান পাননি। তবু এ দুজনের ব্যাটিং সাবলীল ছিল
না। স্লগ ওভারে দুর্বল ব্যাটিং। ইয়াসিরকে মনে হলো হালভাঙা নাবিক। অন্যদের
অবস্থাও অনেকটা সেরকমই। দ্বিতীয় ম্যাচে রান সামান্য বেশি হয়েছে, জয়ের
ব্যবধানও কিছু বেশি। কিন্তু তাতেও দলের ‘হ য ব র ল’ অবস্থা লক্ষণীয়।
আমাদের
যা আছে তার মধ্যে লিটন, আফিফ, সৈকতের ব্যাটিং স্টাইল দুর্দান্ত। অন্যদের
সঙ্গে মাঠে তাদের পার্থক্য সবাই বুঝতে পারেন। এজন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন
পড়ে না।
এখন কথা হলো, ভক্তদের বলায় কিছু যায়-আসে না। ওপেনিং বা ব্যাটিং লাইন আপ ঠিক করার ডিসিশন টিম ম্যানেজমেন্টের।
ফেসবুকে
দেখলাম এক ভক্ত লিখেছেন, লিটনকে কোনো একটা জায়গায় শ্রীধরণ ফিক্স করবেন বলে
মনে হয় না। তার আশঙ্কা, লিটনের মতো মেধা না শেষে নষ্ট হয়ে যায়! তিনি দাবি
করেছেন, লিটনকে ওপেনিংয়ে ফিরিয়ে আনা হোক।
আবার
আমিরাত সিরিজ শেষে প্রেস মিটে দলের চিফ কনসালটেন্ট শ্রীরাম শ্রীধরণ
বলেছেন, ‘আমি তাদের উন্নতি করতে বলেছিলাম, সেটা তারা করে দেখিয়েছে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ছেলেদের অবশ্যই ক্রেডিট দিতে হবে।’ এই যদি হয়ে
থাকে তার পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন, তাহলে তার কাছে আর চাইবার কিছু নেই। তার
পরিকল্পনা বোঝা হয়ে গেছে! তার এক্সপেকটেশন ভক্তদের লেভেলে নেই। এই
পারফরমেন্সে যদি খুশি হন, তাহলে বলবো, বাংলাদেশ দলের সামর্থ্য নিয়ে তার
ধারণার কমতি আছে। কারণ বাংলাদেশের সামর্থ্য তার ধারণার চেয়েও বেশি। সেটি
দেখা আর তা ‘চাগানো’র ক্ষমতা শ্রীধরণের আছে কি না, সন্দেহ সেটাই।
যাই-হোক, সমালোচকদের কাজ সমালোচনা করা। টিম ম্যানেজমেন্টের কাজ দলকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়া, দিন শেষে রেজাল্ট আনা। ভক্তরা আশায় আছে, নিউজিল্যান্ডে ও অস্ট্রেলিয়ায় দল ভালো করুক। ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশ। ধারাবাহিক জয়ে ফিরুক টাইগাররা। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং, টেকনিক, আত্মবিশ্বাস, ফুটওয়ার্ক, ব্যাট লিফটিং পারফেক্ট হোক। রানক্ষুধা, উইকেট ক্ষুধা, সর্বপরি জয়ের নেশায় উদ্বেল হোক টিম টাইগার।
লেখক: করপোরেট ব্যক্তিত্ব ও সম্পাদক, ঢাকা বিজনেস