বুদ্ধদেব গুহ বলেছিলেন, ‘যার বিবেক বেঁচে থাকে তার সুখ মরে যায়’। তেমনি কিছু মানুষের সুখ মরে গিয়েছিল সেদিন থেকে। তাদের রক্তে লেগেছিল আগুন।
১৭ জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের টিএসসি সংলগ্ন এলাকা। ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত বহিরাগত সন্ত্রাসীরা সেদিন ছাত্রীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিল। পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিল ছাত্রছাত্রী তথা কোটা আন্দোলনকারীদের। গুলি করে মেরেছে আন্দোলনকারীদের।
ওই ছবি আলোর দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বের প্রতিটি কোণায়। সে-সব রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশীদের।
মিডিয়ার কল্যাণে দ্রুত সেসব ছবি, ভিডিও মানুষের হৃদয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সংবেদনশীল মানুষের সুখ কেড়ে নেয় সেসব দৃশ্য।
দিন দিন বাড়তে থাকে সহিংসতা। গুলি, হত্যা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন চলতে থাকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন। সেসব ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মতো উইরোপের ছোট্ট দ্বীপ দেশ মালটাতেও। কিছু তরুণ-যুবক উদ্যোগ নেন প্রতিবাদ কর্মসূচির।
মালটায় এসে দুই সন্ধ্যায় সেসব নিয়ে কথা হলো তাদের সঙ্গে। তাদের একজন নাইম। এয়ারক্রাফ্ট মেইনটেন্সে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন লুফথানজা এয়ার লাইন্সে। বাড়ি ঢাকার হাজারীবাগে। তিনি আয়ারল্যান্ডে ছিলেন ৪ বছর। এরপর মালটায় আছেন ৬ বছর ধরে। তিনি জানান, প্রতিদিন এসব অন্যায় দেখতে দেখতে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারিনি। বিবেকের তাড়নায় যোগ দিয়েছিলাম প্রতিবাদী মানববন্ধন ও সমাবেশে।
মালটায় এই আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন আইনজীবী নাজমুল ইশতিয়াক। তিনি জানান, মালটায় প্রায় ১২ হাজারের মতো বাংলাদেশি আছেন। তারা বলছিলেন, কিছু একটা করা দরকার। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জোনালো প্রতিবাদ হচ্ছিল।
কথা হচ্ছিল, আমরাও চুপ করে বসে থাকব না।
২৬ জুলাই মালটায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন বাংলাদেশিরা। সেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তারা।
তারা প্রথমে মালটা পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন চিঠি দিয়ে। মালটা পার্লামেন্টের সামনে তারা সমাবেশ করতে চেয়েছিলেন। সেদিন ওখানে সরকারি একটি অনুষ্ঠান থাকায় পাশেই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সামনে তাদের প্রতিবাদ সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়। মালটা পার্লামেন্ট আয়োজকদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য চেয়েছিল। ইউরোপীয় পার্লামেন্টেও তারা বাংলাদেশ সরকারের ওপর স্যাংশন দেয়ার জন্য দাবি জানিয়েছিলেন। গণহত্যা বন্ধ ও স্বৈরাচারী আচরণের বিচার দাবিতে তারা প্রতিবাদলিপি দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।
আইনজীবী ইশতিয়াক বলেন, ‘দেশপ্রেমিক হিসেবে অন্যায় অবিচারের বিচার চেয়েছি আমরা। নীরব থাকতে পারিনি। বিভিন্ন বাহিনী দিয়ে দেশের মানুষকে যেভাবে মারছে সেটা মেনে নিতে পারিনি। নিজেও রাস্তায় নেমেছি। দেশপ্রেমিকদের নামার আহবান জানিয়েছি।’ তিনি জানান, এই প্রতিবাদ সমাবেশ করায় জামালপুরে তার গ্রামের বাড়িতে ৪ আগস্ট আগুন দিতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। কিন্তু বিধির কি নির্মম পরিহাস, ঠিক পরের দিন দেখা গেলো এলাকার সাধারণ মানুষ ক্ষেপে গিয়ে ওেই সন্ত্রাসীদের বাড়িতেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
নাইম বলেন, ‘রক্তের টানে, দেশের টানে ওই সমাবেশে গিয়েছি মাথঅয় জাতীয় পাতাকা বেঁধে। অনেক ভয় ছিলো, বাঁধা ছিল। বিবেকের তাড়নায় প্রতিবাদে নেমেছিলাম। সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা না বলতে পারলে কিসের মানুষ?’
প্রথম সন্ধ্যায় আরও ছিলেন মালয়েশিয়ার পড়ালেখা করা আফসানা প্রিয়া, আয়ারল্যান্ডে পড়ালেখা শেষ করা সানজিদা। দ্বিতীয় সন্ধ্যায় ঠিক ওই ক’জনের সঙ্গে আরো ছিলেন বুলগেরিয়ার নাগরিব স্টিভেন। তিনিও ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে টুকটাক খোঁজ খবর রাখেন। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি পত্রিকার মাধ্যমে। তোমাদের ছাত্রদের অনেক সাহস। তারা খুব ভালো কাজ করেছে’।
মালটা’র প্রধান সংবাদপত্র টাইমস অব মালটাতে খবরটি বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়েছিল। এএফপিতেও ফলাও করে ছবিসহ প্রকাশিত হয়েছে সে খবর।
ইশতিয়াক একটি গল্প শোনালেন। এক রাজার অনেক যুদ্ধের ঘোড়া ছিল। ছিল গাধাও। রাজার কাছের লোকজন রাজাকে বুদ্ধি দিলেন, যুদ্ধের ঘোড়াগুলো পালতে প্রচুর র্অথ ব্যয় হয়। যুদ্ধ ছাড়া এগুলো তো কোনো কাজে আসে না। শুধু শুধু অর্থের অপচয়। কবে যুদ্ধ হবে তার জন্য এত অর্থক্ষয় গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলো বিক্রি করে দিলে রাজ্যের লাভ হবে।
রাজার মনে ধরলো যুক্তিগুলো। ঘোড়াগুলো পাশের দেশের কাছে বিক্রি করা হলো। পাশের দেশের রাজা অবাক! এত সহজে এতগুলো প্রশিক্ষিত ঘোড়া কিনতে পেরে সে মহাখুশি। ঘোড়াগুলো কিনেই তিনি ওই রাজ্য দখলের জন্য আক্রমণ করলেন।
আক্রমণের শিকার রাজা শুধু গাঁধা দিয়ে আক্রমণ ঠেকাতে পারেনি। শেষে রাজ্য, রাজত্ব সব হারাতে হলো।
ইশতিয়াকের মতে, সে-রকম শেখ হাসিনাও তার আশপাশে লোভী, অমানুষ, নির্বোধ গাধাগুলোকে পুষেছেন। মন্ত্রী, এমপি আর দলীয় পদ বিক্রি করেছেন। ঘোড়াগুলোকে শত্রু মনে করে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। সেজন্যই তার এমন পতন!
লেখক: সম্পাদক, ঢাকা বিজনেস