১৮ মে ২০২৪, শনিবার



নরসিংদীতে ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া উৎসব

এইচ মাহমুদ নরসিংদী, নরসিংদী || ০৩ মার্চ, ২০২৩, ০২:৩৩ এএম
নরসিংদীতে ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া উৎসব


নরসিংদীতে হয়ে গেলো গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া উৎসব। আর এ উৎসবে অংশ নিতে বিভিন্ন স্থান থেকে পলো নিয়ে মাছ শিকারে নেমেছিলেন শত শত শিকারী। তাদের সঙ্গে নামেন স্থানীয়রাও। উৎসবে কিশোর থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্বরাও ছিলেন। 

বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) দিনব্যাপী এই উৎসব শেষে অনেকেই পেয়েছেন ছোট বড় শোল, গজার বোয়ালসহ নানা প্রজাতির মাছ। আবার অনেকেই ফিরেছেন শূন্য হাতে। তবে মাছ না পেলেও এমন মিলন মেলায় যোগ দিতে পেরে খুশি সবাই।

মাছ শিকারীরা জানান, প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে খাল-বিল, হাওরে পানি কমে গেলে তারা পলো নিয়ে মাছ ধরা উৎসব করেন রায়পুরা উপজেলার পলাশতলি ইউনিয়নের খলিলাবাদ বিলে। এতে অংশ নেন কয়েকশ মানুষ। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শীতের শেষে বসন্তের দুপুরে ঝলমলে রোদে নরসিংদী জেলাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কয়েকশ মাছ শিকারী দলে দলে পলো নিয়ে কচুরিপানা সরিয়ে মাছ ধরতে নামেন ওই বিলে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলের দুই পাড়ে শৌখিন মাছ শিকারিদের সঙ্গে উৎসুক দর্শকদের ভিড় জমতে দেখা যায়। সবাই একসঙ্গে লাইন ধরে লুঙ্গি বেঁধে নান্দনিক ছন্দে পলো দিয়ে মাছ ধরেন। সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যান, অনেকের মাথায় গামছা বাঁধা থাকে। দেশীয় নানা প্রজাতির মাছের মধ্যে শোল, বোয়াল, চিতল, নলা ইত্যাদি মাছ তাদের পলোতে আটকা পড়ে। পলোর ভেতরে কোনো মাছ আটকা পড়েছে বুঝতে পারলেই ভালোভাবে চাপ দিয়ে ধরে রাখেন, যাতে নিচের কোনো দিকে ফাঁকা না থাকে। এরপর উপরের খোলা মুখ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মনের আনন্দে ধরে আনেন সেই মাছ। উৎসবে অংশ নেওয়া অনেকেই এসব মাছ ধরতে পেরে আনন্দে আত্মহারা। 

 এদিকে দর্শকরাও উৎসবের আমেজে মাছ ধরার আনন্দ উদযাপন করেন। কোনো শিকারীর পলোতে যখন মাছ আটকা পড়ে, তখনই শুরু হয় হৈ-হুল্লোর। আর মাছের আকার যদি বেশ বড় হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এত এত মানুষের সম্মিলিত উদযাপন, এ যেন আবহমান গ্রাম বাংলার চিরায়ত এক উৎসব। এসময় এ উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন আশপাশের গ্রাম ও দূরদূরান্ত থেকে আসা শত শত নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর।

খলিলাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ও বিলের পাশের কৃষি জমির মালিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা ছোট বেলায় দেখতাম বসন্তের এ সময়টাতে আমার দাদারা এ বিল থেকে বড় বড় রুই, কাতল, মৃগেল, শোল, বোয়াল, পুঁটিসহ প্রায় অর্ধশত প্রজাতির মাছ ধরতেন। এ বিলের মাছ অনেক সুস্বাদু। তাই তো এখন পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী ৫-৬টি জেলার হাজারো মানুষ এ বিলে মাছ ধরতে আসেন। কেউ মাছ পান, আবার কেউ পান না। তবে সবাই আনন্দের সঙ্গে হাসিমুখে এ উৎসবে অংশ নেন। 

শিকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উৎসবের সপ্তাহ খানেক আগে পলো বাওয়া উৎসবে অংশ নেওয়া কোনো একজনের দায়িত্বে পার্শ্ববর্তী গ্রামেগঞ্জে প্রতি বাজারে ১০০ টাকার বিনিময়ে তেলের টিন বাজিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় উৎসবের তারিখ। এমন খবর জানার পর লোকজন পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে পুরনো পলোগুলো ধুয়ে মুছে উৎসবে যাওয়ার জন্য তৈরি করে রাখেন। আর যাদের পলো নষ্ট হয়ে গেছে, তারা বাজার থেকে নতুন পলো ক্রয় করে উৎসবে অংশ নেন।

উৎসবের দিন সকালে নিজ নিজ পলো, হাতাজাল, উড়ালজাল ও লাঠিজালসহ নানা ধরনের মাছ ধরার জিনিসপত্র নিয়ে বিলের পাড়ে গিয়ে সমবেত হন হাজারো শিকারী। ঘড়ির কাটায় নির্ধারিত সময় বেজে উঠলেই সবাই মিলে একসঙ্গে পলো নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সবাই মাতেন পলো বাওয়া উৎসবে। 

গাজিপুরের কালীগঞ্জ থেকে মোবারক হোসেন নামে আরেক মাছ শিকারি বলেন, আমি একটি বড় বোয়ালসহ ছোট মাছ পেয়েছি। এতেই আমি খুশি। টাকা দিলেও এই মাছ আমি কিনতে পারবো না। এটা শখের জিনিস। আমি বাড়ি নিয়ে পরিবারকে নিয়ে মজা করে খাবো।

বেলাবো উপজেলা থেকে ওয়াজিদ নামে এক মৎস্য শিকারী বলেন, আমরা ২০-২৫ জন এসেছি। আমরা এখানে প্রতিবছরই আসি। এবার এসে বিভিন্ন জাতের মাছ পেয়েছি। খুবই ভালো লাগছে।

পলাশতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া বলেন, এই বিল সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রতি বছরই এই বিলে উৎসবমুখর পরিবেশে পলো-বাওয়া উৎসব হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এবছর তা পালন করা হয়, এতে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মৎস্য শিকারীরা অংশ নেন।

ঢাকা বিজনেস/এম



আরো পড়ুন