১৯ মে ২০২৪, রবিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

দয়িত

নুসরাত সুলতানা || ২৬ জানুয়ারী, ২০২৩, ০৫:৩১ পিএম
দয়িত


সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে  উঠে  আমের পাতা দিয়ে দাঁত মেজে, ওজু করে ফজরের নামাজ আদায় করে বিনিতা। এরপর দরুদে ইব্রাহিম পড়ে বিনিতা তেলাওয়াত করে, ‘আররাহমান, আল্লামাল কুরান, খালাকাল ইনসান, আল্লামাহুল বায়ান...। বিনিতার বাবার কানে যেন মধুরতম আওয়াজ হয়ে প্রবেশ করে তেলাওয়াত। 

মুলার ডাল দিয়ে ঠাণ্ডা ভাতটুকু খেয়ে বিনিতা স্কুলের উদ্দেশে রওয়ানা হয়।  নীল সুতি জামা,লালা পাজামা আর কমলা রঙের একটা ওড়না পরে বিনিতা। চোখে লেপ্টে বিনিতা একটু কাজল দিয়েছে, মাথার ওপরে তুলে দিয়েছে একটু ঘোমটা। আর তাতেই ডাগর চোখের, শ্যাম বর্ণের বিনিতার মুখচ্ছবিতে এক মায়াবী  টলটলে দীঘির সোম্য রূপ খেলে যায়।

বিনিতার দিনমজুর বাবা মুগ্ধ চোখে দেখে মেয়েটার স্কুলে যাওয়া। সে বিড়বিড় করে বলে চলে; গরিবের ঘরে তুমি এমন মাইয়া ক্যান দিলা গো আল্লাহ! এরে তো যত্ন করতে পারমু না! মাইয়াডা আমার যেমুন মাথা আলা তেমুন সুন্দরী।  বিনিতা এবার অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে। বার্ষিক পরীক্ষায় সে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে।

আফসার এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কাজে যায়। আজকে এলাকার সবচেয়ে বড় ধনী আজগর সাহেবের ক্ষেতে ধান কাটতে যাবে সে। মনে মনে ভাবে- আইজগো মালিকে গোসত খাওয়াইতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে  চিলতে হাসি ফুটে ওঠে  চোখে-মুখে। এরপরই বিনিতা, ইমরান আর জরিনার জন্য কষ্টও হয়। ওরা গোস্ত খেতে পারবে না তাই।

আজগর সাহেব বেশ ধনী গৃহস্থ। সংসারে দুই স্ত্রী, পাঁচ ছেলেমেয়ে, কাজের লোকজন নিয়ে প্রায় ডজন খানেক লোক।  প্রথম স্ত্রী রাহেলা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হলে, তার আপন চাচাতো বোন রমলাকে নিয়ে আসে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে। দুই বোন মিলেমিশেই বসবাস করছে এযাবৎ। 

সেদিন  দশজন দিনমজুর ধান কাটছে পাঁচবিঘা জমির। আজগর সাহেব আফসারের প্লেটে দুই টুকরো গোসত বেশি তুলে দিয়ে বলে, পোলা-মাইয়ার  খরচ না চালাইতে পারলে আমারে কবি। পর ভাবিস না আমারে। আফসার বলে আপনার দয়ার শরীর বড় সাব।

বিনিতা দুচোখ ভরে স্বপ্ন দেখে সে সায়েন্স পড়বে।বড় বড় হাসপাতালে নার্স দিদিমনিদের দেখেছে কি সুন্দর সাদা শাড়ি সাদা ক্যাপ পরে। সে ঐ রকম নার্স হবে।বাবা মাকে বলেছেও স্বপ্নের কথা। আফসার কষ্টের হাসি হেসে বলেছে ধুর পাগলী, গরিবের এত স্বপ্ন দ্যাকতে নাই।

বাসর রাতে বিনিতাকে বুকে আঁকড়ে ধরে বলে,  ‘আমি তোমার সব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করমু, মরণ অব্দি তোমার পাশে থাকমু আমার সোনার ময়না।বিনিতা সুখে করিমের বুকে ঘুমায় গভীর, সুখের ঘুম।

দিন শেষে আজগর সাহেব সবার টাকা পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে আফসারকে আলাদা ডেকে নিয়ে দুশো টাকা বেশি দিয়ে বলে, পরে একসময় কাম কইরা শোধ কইরা দিছ, আর না পারলে না দিছ। এই টাকাডা  দিয়া মাইয়া-পোলার লইগগা  বাজার লইয়া যাইছ।

আফসার সেদিন বাজারে গিয়ে  মুরগী, চাল,ডাল, তেল সব কিনে খুশি মনে বউকে হাঁক দেয়, কই গো বাজার আনছি লও। সেদিন  সে তার অনেক পছন্দের আকিজ বিড়িও কিনেছে বেশকিছু। কোনদিন ইমরান  চাকরি করলে সিগারেট খাবে, এমন স্বপ্ন মনের নিভৃত কোনে সযত্নে লালন করে আফসার।

জরিনা সেদিন ভাল করে তেল মসলা দিয়ে ডাল,ভাত,মুরগী রান্না করেছে। সবাই বেশ খুশি মনে খাচ্ছে আর গল্প করছে। হঠাৎ আফসারের কাশি।ইদানিং কাশি শুরু হলে আর থামতে চায় না।

শরৎ শেষে কেবল হেমন্তের আগমন। প্রকৃতিতে দুষ্ট -মিষ্টি হিমেল বাতাস  হু হু করে খেলে যায়। বিশ্বচরাচরের পরিবর্তনের সঙ্গে বিনিতার শরীর মনেও কিজানি বদলের আভাস। বিনিতা বুঝতে পারে সে আর কিশোরী নেই। এবার সে যুবতী। নিজের সম্পর্কে ধারনা আরও পরিষ্কার হয় বিনিতার। দৃঢ় হয় সংকল্প,পড়াশোনা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার।আজকাল প্রায়শই স্কুলে যাবার পথে আজগর সাহেব বলেন,বিনি মাঝে মাঝে তো তোর বড় দাদীর লগে গল্প কইরা যাইতে পারস। বিনিতা বলে আচ্ছা দাদাজান আমু হানে। হাসির আড়ালে অন্য শীতল দৃষ্টি বিনিতার সরল মন কখনও দেখতে পায়নি।

আজগর সাহেবের বাড়িতে সেদিন বিশাল  আয়োজন। নবান্ন উৎসবে তিন বোনের ছেলে-মেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি সবার দাওয়াত। এই আয়োজনে আফসারের বউ আর বিনিতাকেও আসতে বলেছে হাতে হাতে একটু সহযোগিতা করার জন্য।আফসারের কাশি ইদানিং বেশ বেড়েছে।শরীর ও অনেক দুর্বল। তাই জরিনা ভাবে যে,যেহেতু শুক্রবার বিনিতার স্কুল বন্ধ,একদিন কাজ করে যদি কিছু টাকা আসে খারাপ কী? বিনিতার দায়িত্ব পরে সামনে সবাইকে খাবার আনা নেওয়া করে দেয়া। আর সবাইকে খাবার তুলে দেবে ম্যানেজার করিম। হঠাৎ বিনিতা খেয়াল করে একজোড়া মুগ্ধ দৃষ্টি।  

পরেরদিন স্কুলে যাবার পথে করিম দাঁড়ায় বিনিতার সামনে। মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,তোমার নাম বিনিতা? তোমার লগে ইট্টু কতা বলতে চাই। বিনিতা বলে, কন কী কইতে চান? করিম বলে এখন না।তুমি এহন স্কুলে যাও। বিকালেলে আইও ইট্টু নদীর ধারে। বিনিতা বলে- আচ্ছা।

ফুলতলা নদীর তীরে বিকেলে হলুদাভ আলোয় করিম অপেক্ষা করে বিনিতার জন্য। কিছুক্ষণ পরে বিনিতা  আসে লালফিতায় চুল বেঁধে, চোখে কাজল দিয়ে।করিম মুগ্ধ চোখে দেখে সহজ, গভীর, সাবলীল সৌন্দর্য। বিনিতার হাতে একগুচ্ছ লাল কাচের চুড়ি। বিনিতা শুধায় করিমকে, ক্যান ডাকছেন আমারে?

করিম বলে তুমিই তো বাধ্য করলা ডাকতে বিনি। বিনিতা বলে  কি কইবেন ঠিক কইরা কন। করিম বলে,আমি তোমারে লগে লইয়া আমার জীবনের পথ চলতে চাই। বিনিতা বলে তা অয় না। আমরা গরীব। করিম বিনিত হয়ে জানায়,আমিও খুব ধনী না।বাবার পাঁচ বিঘা জমি আছে।চার ভাইবোন। সংসারের হাল ধরতে আমি আজগর দাদুর কাছে কামে আইছি।তোমার স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব আমার।তুমি অন্য কিছু ভাইবো না। বিনিতা চুপ থাকে। করিম তার হাতে তুলে দেয় একসেট নীল থ্রিপিস। 

করিম আজকাল খুউব উৎসাহ নিয়ে কাজ করে। তার দুচোখ ভরা স্বপ্ন,ছোট ভাইটা এস এসসি পাশ করে ফেললে তাকে ইলেক্ট্রিকালের  ওপরে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে ঢোকাবে। তখন পরিবারে ও কিছুটা সাহায্য করতে পারবে। তারপর সে বিনিতাকে নিয়ে যাবে নিজের ঘরে।বিনিতাকে সে নার্সিং পড়াবে।পূরণ করবে বিনিতার স্বপ্ন। মাঝে মাঝে বিনিতাকে খাতা কলম কিনে দেয়। বিনিতা নিতে চায় না সে জোর করে দেয়।

নভেম্বর মাস। আফসার আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।ইদানিং আফসারের কাশি বিনিতাকে বেশ ভাবায়।একদিন স্কুলে যাবার সময় বিনিতা দেখে আফসারের কাশি থেকে রক্ত পড়ছে। সারাটা স্কুলের সময় বিনিতা ভেবে ভেবে অস্থির হয়েছে।বাড়ি ফিরে সে বাবাকে বলে কাইল সদর হাসপাতালে যাইও আব্বা। পরের দিন বিনিতা বাবা মাকে পাঠিয়ে দেয় হাসপাতালে।ডাক্তার সব শুনে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা দেয়। পরীক্ষাগুলো করে ডাক্তারের কাছে যেতে বলে।

সব পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে নিয়ে বিনিতা আফসারকে নিয়ে যায় ডাক্তারের কাছে। প্রতিবেদন দেখে ডাক্তার প্রথমেই বিনিতাকে জিজ্ঞেস করে সে পড়াশোনা জানে কিনা।বিনিতা বলে জ্বী আমি অষ্টম শ্রেনীতে বার্ষিক পরীক্ষা দেব।ডাক্তার তাকে বলে তুমি তো শিক্ষিত মেয়ে, তাই তোমাকে বুঝিয়ে বলি। অতঃপর ডাক্তারের কথা শুনে বিনিতার সন্দেহ সত্যি হয়। যক্ষা হয়েছে আফসারের। ডাক্তার ৬ মাসের বিশ্রাম আর এক বছরের ঔষধ দিয়েছেন। ধুমপান সম্পূর্ণ নিষেধ।

বাড়িতে এসে বিনিতা বাবা মাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে। বলে, তোমরা মোডেও চিন্তা করবা না। ইমরানের লেহাপড়া চালাইয়া নেতে অইবে। আমি বার্ষিক পরীক্ষা দিয়া কামে নামমু।সংসারের আল (হাল)ধরমু। আব্বায় সুস্ত অইলে আবার লেহাপড়া করমু।

পরেরদিন স্কুলে যাবার পথে বিনিতা করিমকে জানিয়ে যায় বিকেলে ইছামতীর তীরে সে যেন আসে। সব শুনে করিম ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভেঙে পড়লেও বিনিতাকে বুঝতে দেয় না। সে বলে, জীবনে যেই অবস্তাই আউক আমি তোমার লগে আছি বিনি। তুমি নিজেরে একলা ভাইব্বো না। তবে আপাতত তোমার আব্বার সুস্ত অইতে অইবে।

বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে সাত সমুদ্র ভাবছে বিনিতা। কী করবে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না। সব শুনে এগিয়ে এলেন আজগর সাহেব। বললেন জরিনা মসলা বাঁটা,রান্না সব কাজে সাহায্য করবে আর বিনিতা ঘর গোছাবে। প্রতিদিনের ভাত তরকারি তারা বাড়িতে নিয়ে এসে ভাগ করে খেয়ে নেবে চারজন। আর মাসে ৪ হাজার টাকা দেবে তা দিয়ে আফসারের ঔষধ আর ইমরানের পড়ালেখার খরচ চলবে।

বিনিতার চোখে আনন্দে পানি চলে আসে। সে আজগর সাহেবকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলে, দাদাজান আপনে মানুষ না, সাক্ষাৎ ফেরেশতা। 

বিনিতা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আজগর  সাহেবের বড় স্ত্রীকে ওষুধ খাইয়ে দেয়,ঘর দোর গোছায় মাঝে মাঝে আজগর সাহেব বিনিতার কাছে পান চায়। বিনিতা এগিয়ে দেয়। জরিনা মসলা বাটে, হাঁড়ি মেজে দেয়, কাপড় ধোঁয়।এভাবে চলতে থাকে দিন। আজগর সাহেব একদিন বিনিতার হাত ধরে চাপ দেয়। বিনিতার অবাক লাগে। কেমন একটু অস্বস্তি বোধ করে সে। আজগর সাহেব বলেন,নাতিন তোর লগে একটু মস্করা করলাম।আফসার আগের চেয়ে অনেকটুকু সুস্থ। করিম  সাত-পাঁচ ভাবে কী করবে!

করিম মনে মনে ভাবে বিনিতাকে বিয়ে করে ফেললে কেমন অয়? সে যতটুকু পারে সাহায্য করবে আর বিনিতা স্কুলে যাওয়ার আগে পরে আজগর দাদুর বাসায় কাজ করবে। এভাবে এসএসসি পাস করে বিনিতাকে বাড়ি নিয়ে ওদের এলাকার কলেজে ভর্তি করে দেবে। বিনিতা ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে টুকটাক টাকা রোজগার করবে। করিমের ছোট ভাই সংসারের কিছুটা খরচ জোগাবে।

আজগর সাহেবের কাছ থেকে একদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের অনুমতি নিয়ে আসে করিম।কথা বলে আজগর সাহেবের সঙ্গেও। আজগর সাহেব এক কথায় রাজি হয়ে যায়।আফসারের সঙ্গে কথা বলে আজগর সাহেব নিজেই বিয়ের ব্যবস্থা করে।হয়ে যায় করিম আর বিনিতার বিয়ে। বাসর রাতে বিনিতাকে বুকে আঁকড়ে ধরে বলে,  ‘আমি তোমার সব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করমু, মরণ অব্দি তোমার পাশে থাকমু আমার সোনার ময়না।বিনিতা সুখে করিমের বুকে ঘুমায় গভীর, সুখের ঘুম।

নদী সাঁতরে বাসে উঠে যায় তারা। ততক্ষণে পুবাকাশে উঠেছে লাল রক্তিম একটা সূর্য।  রাস্তা সংলগ্ন ধানক্ষেতে এক ঘাস ফড়িং দম্পতি   গর্ভজাত ধানের শীষে  লুকোচুরি খেলছে

বিয়ের একদিন পর বিনিতা কাজে এলে রসিকতা করে আজগর সাহেব বলেন,‘কিগো নাতিন! কেমন সুখ দিলো করিমে?’ বিনিতা লজ্জিত হয়ে দৌড়ে পালায়।বিয়ের পর বিনিতার রূপ লাবণ্য স্বঘোষিত স্বাধীনতায় জ্বলল্বল করছে। গায়ের রঙ আরও ফুটে বেরিয়েছে। শরীরে একটু গোসত লাগতে শুরু করেছে। একটা পরিপূর্ণ নারীর রূপ ধারণ করতে শুরু করেছে বিনিতা।

একদিন আজগর সাহেব বিনিতার কাছে পান চায়। বিনিতা পান নিয়ে গেলে আজগর সাহেব বলেন,‘মনের মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিলাম,আমারে এবার কী দিয়ে খুশি করবি?  বিনিতা বলে কী চান, দাদাজান বলেন? আজগর সাহেব উত্তর দেন, যা চামু দিবি? বিনিতা বলে সামর্থ্য অইলে দিমু না ক্যান! আজগর সাহেবের মুখে কুটিল হাসি।

প্রায় প্রতি রাতে করিম আর বিনিতা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ভাবে, ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির চিত্র আঁকায় মগ্ন থাকে। কোনো কোনো রাতে সারারাত বুনে যায় সোহাগের লাল-নীল চাদর।হঠাৎ আজগর সাহেব করিমকে একদিন ডেকে বলেন, করিমকে নদীর ওপারের গঞ্জের দোকানে দুই দিন গিয়া থাকতে অবে। ওখানের হিসাব-নিকাশ করে বুঝাইয়া দেওন লাগবে। করিম যাওয়ার পরেরদিন আজগর সাহেব ছোট বিবিকে চালের রুটি,হাঁস আর সেমাই পিঠার আয়োজন করতে বলে। সেই দিন বিনিতার বাড়ি যেতে রাত দশটা বেজে যায়।আজগর সাহেব বলেন, চল বিনি আমি তোরে  আউগাইয়া দিয়া আই।কাচারি ঘরের কাছে আসতেই আজগর সাহেব বিনিতাকে জোর করে জড়িয়ে ধরে বলে, বিনি আমি তোর আগুনে অনেক পুড়ছি, এইবার আমারে ঠাণ্ডা কর! আইজ করিম নাই, আইজকা রাত্তিরটা আমারে দে! কেউ জানবে না। তোর মতো একটা ডাগর মাগী খাওয়ার আমার খুব শখ! আমি তোরে করিমের চাইক্কা বেশি সুখ দিমু। বিনিতা আজগর সাহেবের হাতে-পায়ে ধরে অনুনয় বিনয় করে বলে,‘দাদাজান আমারে ছাইড়া দেন, আমার স্বামী আছে।’ আজগর সাহেব কুটিল হাসি দিয়ে বলেন, এইলইগা তো আরও সুবিধা।সপ্তাহে চাইর রাত্তির করিমের,তিন রাত্তির আমার আর এক রাত্তির তোর বিশ্রাম। তোর টাকা পয়সা কোনো কিছুর অভাব অইবো না বিনি। আমারে ঠাণ্ডা কর। বিনিতা উপায় না দেখে আজগর সাহেবের হাতে কামড় দেয় আর নিম্নাংগে লাথি দিয়ে দৌড়ে পালায়।

ক্ষুধার্ত বাঘের শিকার ছুটে গেলে যতটা হিংস্র হয়,আজগর সাহেব এই মুহূর্তে ততটাই হিংস্র। শাহেদ তার অকাজের ডানহাত। আগেই দাঁড় করিয়ে রেখেছিল পাহারায়। ভেবেছিল শাহেদকে পাহারায় রেখে বিনিতাকে নিয়ে কাচারি ঘরে ঢুকবে।বিনিতা দৌড়ে পালালে,শাহেদকে ডেকে আজগর সাহেব বলেন,যা বিনিতার ঘরে ঢোক। ঘরে ঢুকে অরে জড়াইয়া ধইরা চিক্কাইর করবি। বাকিটা আমি দেখমু আনে ,যা। শাহেদ কথামতো বিনিতার ঘরে ঢুকে বিনিতাকে জড়িয়ে ধরে বলে,‘আমারে ছাইড়া দে,তর না স্বামী আছে!’ আমি ভাবলাম তুই এমনি বড় ভাইয়ের মতো দেখবি। পেছন থেকে আজগর সাহেব এসে বলেন,‘ব্যাভিচারিনী। স্বামী একদিন নাই আর অন্য পুরুষ ঘরে ঢুকাইছিস? তোর খায়েস মেটে না? এই বেশ্যা মাগীরে বাইন্ধা ফালা। খানকির বিচার করবে মাওলানা সাব। আজগর পাহারায় রাখে পাঁচজন চ্যালা-চামুণ্ডা।

অন্ধকার ঘরে বসে বিনিতা ভাবতে থাকে মাওলানা সাহেব তাকে একশ দোররা মারার রায় দিলে সে কি আর বাঁচবে! মনে পড়ে করিমের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার ক্ষণটি, প্রথম চুম্বন আরও কত কী! প্রতি রাতে করিম তার মাথা টিপে দিতো। আর কি সে করিম কে দেখতে পাবে না!  এই প্রথম বিনিতার চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়লো। এক সমুদ্র অন্ধকার চোখে নিয়ে বিনিতা যখন জীবনের সব আশা হারিয়ে ফেলেছে, হঠাৎ তখন পরিচিত স্পর্শ! করিম! করিম বিনিতার মুখ চেপে ধরে বলে আস্তে! কথা বলো না। আকমল ভাই আমারে মোবাইল করছে।

নদী সাঁতরে বাসে উঠে যায় তারা। ততক্ষণে পুবাকাশে উঠেছে লাল রক্তিম একটা সূর্য।  রাস্তা সংলগ্ন ধানক্ষেতে এক ঘাস ফড়িং দম্পতি   গর্ভজাত ধানের শীষে  লুকোচুরি খেলছে। সোম্য-শান্ত সকাল যেন এই পৃথিবীর প্রতিটি আত্মাই ভীষণ তৃপ্ত। এই গ্রহের কোথাও ক্ষুধা নেই, মৃত্যু নেই, যন্ত্রণা নেই। বিনিতা করিমের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। করিম একগাল মুচকি হেসে বলে, ‘পাগলি একটা!’ 



আরো পড়ুন