১৮ মে ২০২৪, শনিবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

কবিতার কলাকৌশল

ড. শাফিক আফতাব || ২৫ জানুয়ারী, ২০২৩, ০৫:৩১ পিএম
কবিতার কলাকৌশল


কবিতার কলাকৌশল বলতে কবিতা নির্মাণকৌশল যেমন বোঝায়, তেমনি কী কী উপায়ে কবিতা রচিত হতে পারে, তা-ও বোঝায়। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত উক্তিটি বিশ্লেষণ করলে কবি ও  কবিতার স্বরূপটি উপলব্ধিতে আসবে। তিনি বলেছেন, ‘সবাই  কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কেন কবি? এই ‘কেউ কেউ’ বলতে কাকে বুঝবো আমরা? 

‘অনিবার্য শব্দের বাণীবিন্যাস কবিতা’ কিংবা মানুষের আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশই কবিতা। এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ যদি কবিতা হতো, তবে সবাই কবি হতো। এই প্রকাশকে কিছু নিয়মনীতি, পদ্ধতি-প্রকরণ বা কিছু উপাদান দিয়ে সাজানো হয়, সেই সাজানোর প্রক্রিয়া সবার এক রকম নয়, যিনি মাল-মসলা প্রয়োগের কৌশলটা সহজে আয়ত্বে পারেন, তিনি কবি হয়ে ওঠেন। সহজভাবে বলতে গেলে মায়ের কোলে শিশুর দেহের সুবাসে কাব্যময়তা থাকলেও, কিংবা মায়ের স্নেহের আবেশে জারিত হয়ে ব্যঞ্জনা সৃজন করলেও সেটা কবিতা নয়। কবিতা প্রকৃতির অনুদান বা অবতার বলে স্বীকার করলেও আধুনিক কবিতায় থাকবে প্রকরণকৌশলের নানা নিরীক্ষা। এই নিরীক্ষা বা কবিতা উপস্থাপনের টেকনিক যার যত ভালো, তিনি তত ভালো কবি। এখন প্রশ্ন হলো, ভালো কবি কিভাবে হওয়া যায় বা কবিতার কলাকৌশল বা কী?

জীবনানন্দ দাশ আবার বলেছেন, ‘উপামাই কবিত্ব’। কোনো রচনায় যদি উপমা না থাকে, তবে তা কবিতা নয়।  উপমা ব্যবহারের চমৎকারিত্বে একজন সফল কবির বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়। গতানুগতিক শব্দ বা উপমা ব্যবহার, আটপৌরে ছন্দ ও আঙ্গিক অনুসরণ করা প্রভৃতি একজন কবিকে পিছিয়ে দেয়। কোনো কবিব মতো হওয়ার চেষ্টা, তার কাব্যের প্রকরণরীতি ব্যবহারের ইচ্ছা একজন সম্ভাবনাময় কবির কবিত্ব হত্যা করতে পারে। কবি তার অগ্রজ কবির সাহিত্য অবশ্যই নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করবেন, অগ্রজ কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্য আত্মস্থ করবেন, সেখানে স্বকীয় মেধার বুননে প্রকরণরীতিতে যেমন বৈচিত্র্য নিয়ে আসবেন, তেমনি ভাব, ভাষা ছন্দ রস ও শব্দ ব্যবহারে আনবেন অভিনবত্ব। বড় কবি হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠি নেই, গণিত পরীক্ষার মতো অঙ্কের উত্তর যথাযথ মিলে গেলে ভালো ফলের মতো পয়েন্ট অর্জন করে কবি হওয়ার যায় না।

নারী ভাবনাই কবিত্ব নয়, নারী ভাবনা শিল্পের ষোলো আনার এক আনা দিক হতে পারে পনের আনা হবে জীবন ও জগতের সর্বাঙ্গীন রূপায়ণ। যে কবি জীবন ও জগতকে অনুপুঙ্খতায় কবিতায় তুলে ধরতে পারেন, তিনিই শক্তিমান কবি। 

একজন বড় কবির যেমন কিছু অখ্যাত কবিতা আছে, তেমনি একজন ছোট কবিরও কিছু কবিতায় বড় কবির কাব্যবৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়। তাই প্রকৃত ভালো কবিতাটি কখন কোন কবি প্রসব করবেন, সেটি ঐশ্বরিক ও নৈসর্গিক। প্রকৃতপক্ষে কবি সবাই, তাই যদি না হবে, শিশু জন্মের প্রথম চিৎকারে কেন থাকবে কবিতার অনুরণন। জীবনানন্দ দাশ ‘কেউ কেউ’ কবি বললেও বৃহৎ অর্থে কিন্তু সবাই কবি। এই সবাই কবি বলতে সবার মধ্যে কাব্যবোধ থাকে, কবিতা থাকে। যার বোধ সর্বজনীন ও কালপ্লাবী হবে, তিনি হবেন প্রকৃত কবি। যে কবি জীবন ও জগতের রহস্যময়তাকে ধরতে পারেন না, অতীত ও সমকালকে চিত্রিত করতে পারেন না, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে পারে না প্রজন্মকে, তিনি প্রকৃত কবি নন। কবি মানেই বহমান কালের ঠিকদার। রূপান্তরের কারিগর।

যিনি কবি নন, তিনিও কবির কবিতার মন্তব্য করেন, কবির সমালোচনায় গোষ্ঠী উদ্ধার করেন। কবিতা বুঝে হোক, বা না বুঝে হোক, যার অক্ষরজ্ঞান নেই, তিনিও কবির পাঠক। কবিতা বোঝার জন্য যেমন অনেক জ্ঞানের দরকার পড়ে না, তেমনি কবিতা না বোঝার জন্য অনেক জ্ঞানে কাজ হয় না। কবিতাকে অনেক একটা ঘোর বলেন, অনেকে রহস্যময় বলেন, কেউ আবার ঐশীবাণী বলেন, কেউ অনেক সাধনায় ঋদ্ধ অনুভব বোঝান। কবিতার সংজ্ঞায় যে যা-ই বলুন, কবিতার ফুল ফুটে ওঠে একমাত্র প্রকৃতির সান্নিধ্যে। শিশিরের সঙ্গে ঘাসের যে সম্পর্ক, কবির সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক অনুরূপ। ঘাসের ডগায় শিশির পড়ে যেমন অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের জন্ম দেয়, তেমনি শব্দগুচ্ছ কবির হৃদয়ের স্পর্শ পেয়ে মোহনীয় ও কমনীয় হয়ে কাব্য হয়। কাব্য অনুভবলদ্ধ হলেও এর বাইরের কাঠামো কবি নিজের মতো করে সেঁটে কবিতা করে তোলেন। কবিতা তাই শুধু প্রকৃতির দান নয়, কবির প্রচেষ্টা প্রয়াস আছে, মৃৎশিল্পীর শ্রম আছে, শ্রমিকের ন্যায় দেহ ধুয়ে যাওয়া ঘাম আছে।

কবিতাকে যদি ফুলের ঘ্রাণের সঙ্গে তুলনা করা হয় তবে ভুল হয় নাা। কেন না একটি ফুটন্তফুল শুঁকলে আমাদের বোধে ও উপলব্ধিতে সুবাস অনুমিত হয়, প্রাণে পুলকের কারণ হয়। এই যে ফুলের সুবাস, মেঘের ঝরঝর বারিধারা, প্রেমিকযুগের অভিসার, মায়ের কোলে শিশুর স্বর-সবই কবিতার ব্যঞ্জনা। এই ব্যঞ্জনা তা কবিতা হলেও বাক্যবিন্যাসে, অলঙ্কার প্রয়োগে, ছন্দের দোলায়, রসের আস্বাদে তা হয়ে ওঠে যথাযথ কবিতা। কবিতা তাই উপলব্ধিজাত অনুভব হলেও প্রকরণকৌশলে আছে নানা নিরীক্ষা।

কবিতার কলাকৌশল বলতে উপস্থাপনকৌশল। কোন কবি কী কৌশলে কবিতাটি উপস্থাপন করবেন, মানুষের দৈহিক ও মানসিক গঠনে যেমন বৈচিত্র্য প্রতিভাত, তেমনি মানুষের রুচিরোধ, পছন্দ, অপছন্দ, মানুষের বেশবাস; এমনি মানুষের তাবৎ কর্মকাণ্ডে আছে বৈচিত্র্যময়তা ও ভিন্নতা। এই ভিন্নতা ও স্বাতন্ত্র্যরূপ প্রতিটি কবির ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য। প্রকৃত কবি স্বকীয় হতে তাই অধ্যয়ন করেন নিবিড়ভাবে। কেউ সফল হন, কালদেবী কাউকে বর দেন, আবার কেউ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হন। তবে যে কবি চিন্তা চেতনায় সৎ, স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি আস্থাশীল, ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি মহৎ। ঈশ্বরের ধারণাটি ধর্মভেদে বিবিধ রূপ পরিগ্রহ করলেও কেউ তো নিজকে সৃষ্টি করতে পারে না, অর্থাৎ নিজের প্রাণটির স্রষ্টা তিনি নন, কেউ তাকে সৃষ্টি করেছেন, এই কেউকে আমরা সৃষ্টিকর্তা হিসেবে অভিহিত করতে পারি। ধর্মভেদে তা আল্লাহ, ভগবান, গড, যাই হোক।

প্রকৃত কবিতার স্বরের উদ্যোক্তা সেই ঈশ্বর। যিনি নির্জনে বসে খেলছেন। সেই খেলার কৌশলটি যে কবি যত ভালোভাবে ধরতে পারেন,  তিনি তত বড় কবি। কারণ রসাত্মক বাক্যই যদি কবিতা হয়, তবে সেই রসের উদ্ভাবক সেই নিরাকার ঈশ্বর। যার ভেতরের ঈশ্বর যত প্রগাঢ়, তার কবিতা তত মহৎ। কারণ কবিতা ঈশ্বরেরই দান। কবিতা আত্মস্থ্য করা মানে ঈশ্বরকে পাাওয়া। কবিতা কাব্যদেবীর কালকেলী। 

প্রকৃত কবি তাই সেই রসজ্ঞ,  যে রসে কাব্যদেবী মুগ্ধ, বিমোাহিত হন। কাব্যদেবী কবির বিমুখ হলে কবিতা অসম্ভব, প্রেমিকা গোস্‌সা করে বিরূপ শয়নে গেলে প্রেম যেমন হরতাল ডাকে, তেমনি কাব্যদেবীর বিমুখতায় কবিতা হয় পদ্য। পদ্য ও কবিতা এক জিনিস নয়। গহীন পুকুরে শ্যাওলার সঙ্গে স্বচ্ছজলের যে সম্পর্ক, পদ্যের সঙ্গে কবিতা সেই সম্পর্ক বললে অত্যুক্তি হয় না। পদ্য স্বরের বাহ্যিক মিল, কবিতা গহীন ব্যঞ্জনার ধ্বনি। এই ধ্বনি কাব্যের আত্মা।

কবিতা কবির অনুভূতির প্রকাশ। কিসের সে অনুভূতি। কবির অনুভূতি ছাড়া অন্যসব মানুষের অনুভূতিগুলো কি কবিতা নয়? শুধু কবির অনুভূতিই কেন কবিতা হবে? এ প্রশ্নের উত্তর এভাবে দেয়া যায়, কবি অনুভূতি সাধারণের চেয়ে ভিন্নতর এবং অভিনব। কবি যা বলেন, সাধারণ কথাটি অসাধারণভাবে বলেন। সেই অসাধারণ বলাটি কবিতা হয়। এই অসাধারণত্ব সেটি আর কবির একার থাকে না। সবার হয়ে ওঠে, সার্বজনীন হয়ে ওঠে। প্রকৃত কবি নিজের অনুভূতিকে সাবর্জনীন করতে জানেন, সবার হৃদয়ের কথা হিসেবে চিত্রিত করতে পারেন । মূলত কবিতা থাকে সবার হৃদয়ে। সবার কথাগুলো কবি যখন নিজের করে প্রকাশ করেন, তখনই কবিতা হয়। তাহলে আমরা ধরে নিচ্ছি, কবিতা হচ্ছে সার্বজননীন স্বর।

 এই সর্বজনীনতা সংজ্ঞা আমাদের জানতে হবে। কবি হচ্ছেন, সময় ও সমাজের প্রতিনিধি, ঐতিহ্যের ধারক, সকল মানুষের কণ্ঠস্বর। ঈশ্বরের ঐশীবাণীর শ্রোতা। জীবন ও জগতের রহস্য, অতীতের স্মৃতির মন্দির খননকারী, বর্তমানের রূপকার ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন। যে কবি সময় ও সমাজকে চেনেন না, পূর্বপুরুষের জীবনধারাকে অনুসন্ধান করেন না, বর্তমানের সঙ্গে যার যোগ নেই এবং যিনি স্বপ্ন দেখাতে পারেন না, তিনি পদ্যকার হলেও কবি নন। কবিকে তাঁর জাতিসত্তার গহীনতলকে যেমন খনন করতে হয়, তেমনি সমকালকে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে হয়, তেমনি প্রজন্মের জন্য গড়াতে হয়, নিরাপদ আলয়, স্বপ্ন দেখার বীজমন্ত্র। 

কবিকে যদি অবতার বলি, তবে খুব ভুল হয় না। কেন না, কবিতা তাই, যা বিশুদ্ধ ও সত্য। ঈশ্বর তো সেই শুদ্ধ ও সত্যের প্রতীক। কবিতা অন্যায় ও অসত্যকে মানে না, কবিতা স্বার্থের সঙ্গে আপোষ করে না। কবিতা একান্তই প্রকৃতির জিনিস। গভীর অরণ্যে অনেক সুবাস নিয়ে বনফুল যেভাবে ফোটে, তেমনি অজস্র লোকের মধ্যে কবিতা শুধু কবির কণ্ঠ দিয়েই নিঃসৃত হয়। সেই নিঃসরণটি মেঘের ঝরে বিশুদ্ধ বৃষ্টির জল, সেই নিঃসরণটি মায়ের জরায়ূ ছিঁড়ে পৃথিবীকে আসা পরিত্র শিশু। কবিতা তো কবির সেই নবজাতকের জন্মের মতোন কষ্টের ও বিশুদ্ধের। যে কবি বিশুদ্ধতার চেষ্টা করেন না, যে কবি শুধু নারীভাবনায় মশগুল থাকেন, তাঁকে হয়তো অনেকেই কবি বলেন, কিন্তু তিনি প্রকৃত কবি নন। নারী ভাবনাই কবিত্ব নয়, নারী ভাবনা শিল্পের ষোলো আনার এক আনা দিক হতে পারে পনের আনা হবে জীবন ও জগতের সর্বাঙ্গীন রূপায়ণ। যে কবি জীবন ও জগতকে অনুপুঙ্খতায় কবিতায় তুলে ধরতে পারেন, তিনিই শক্তিমান কবি।

এই প্রক্রিয়াটি কবির কাছে প্রেম।  কবিরা প্রেমিক হয়। সস্তাদরের কবি যেমন সেটি বোঝেন না, তেমনি ঈষৎ বুদ্ধিজীবী পাঠকও।

কবির একান্ত ব্যক্তিগত কামনা-বাসনার শৈল্পিক রূপও কবিতা। কিন্ত কবির ব্যক্তিগত কামনা বাসনা বলে কিছু নেই। কারণ কবি হলেন কালের সন্তান--কালের কূজনও। কবির কামনা বাসনা মানে কোনো জনগোষ্ঠী ও জনধারার কামনা বাসনা। কারণ কবি তো নিজের কথা এমনভাবে বলেন, সেটি সার্বজনীন হয়ে ওঠে। পাঠক নিজের জগতটাকে দেখতে চায় কবিতায়। মনে করে এ তো আমার নিজের কথা। পাঠক ও প্রজন্ম মনের মুকুরে দেখতে চায় তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বপ্নের জগত। কবি আনন্দের দেবতা, সুন্দরের পুজারী। মানুষকে আনন্দ দেওয়াই তার কাজ, সুন্দরের চিত্র আঁকাই তো নেশা। তবে কবি দুঃখের রূপকার নন, কবির কি বেদনা নেই। কবির দুঃখ ও বেদনা কাব্যকলায় কষ্টের কারণ হয় না। আনন্দ ও পুলকের পশরা হয় অনুভবের জগতে। ফলে প্রকৃত কবির কাছে পাই জীবন নামক তয়োধীর অমিয় সুধার স্বর। 

কবিকে ইতিহাস জানতে হয়। তার পূর্বপুরুষের ইতিহাস, তার জাতিসত্তার ইতিহাস। তার বেড়ে ওঠা, তার ভৌগোলিক পরিচিতি, তার সংগ্রাম, তার যুদ্ধের ইতিহাস। যে কবি তার ইতিহাসবিমুখ সে আর যা-ই হোক, কবি হতে পারবে না। কবিকে ইতিহাসের গহ্বরে প্রবেশ করতে হয়, তার শেকড়কে খুঁজতে হয়। যে কবি তার শেকড়বিচ্ছিন্ন, তাঁর ইতিহাসে অজ্ঞ, সে কবি শুধু নারী পুরুষের মধ্যকার চৌম্বকাবেশের কয়েকটি পঙ্‌ক্তি রচনা করতে পারবে। কবিকে যেমন ইতহাসকে জানতে হয়, তেমনি ইতিহাস সৃষ্টিও করতে হয়, তেমনি দেখতে হয় ভবিষ্যতের স্বপ্ন। যে কবি স্বপ্ন দেখতে জানে না ও দেখাতে জানে না সে কী করে কবি হবে? কবির কাজই স্বপ্ন দেখানো।  কবি প্রজন্মকে আকাশের মতোন বড় হওয়া শেখাবে। কবি রক্তাক্ত হওয়া শেখাবে। যে কবি রক্তপাতের ইতিহাস জানে না, রক্তপাতের জন্য যে কবি ভীত, রক্তের শ্লোগানে যে রাজপথে নামে না, সে কবি নয় পদ্যকার। পদ্যকারের কাজ স্বরসঙ্গতি রক্ষা করা, মানুষের কানের তৃষ্ণা মেটানো। কিন্ত কবির কাজ হৃদয়ে গহীনে পুলকের সঞ্চার করা, দেশ ও জাতির জন্য নিজেকে নিবেদিত হওয়া।

কবি কখনো দুর্নীতিবাজ হন না। কবি কখনো ফৌজদারি আদালতে হাজিরা দেন না। কবি হবেন রাজবন্দি। কারণ কবির কাজ রাজার সিংহান কিংবা রাজ মুকুট। যুগে যুগে কবিরা রাজকবি হয়ে আসছে। কবিকে কেন দুর্নীতি করতে হবে। কবিকে তো রাজা মহাশয় সাদরে নিমন্ত্রণ দেন। যে কবি উদরপুর্তির জন্য মানুষের টাকা মেরে খায়, অন্যের জমির মালিকানা দাবী করে, যে কবি শুধু হিংসের আগুনে জ¦লে, সে কোনো প্রকৃত কবি নন। প্রকৃত কবি প্রকৃতির মতোন উদার ও সহজ-সাবলীল। কবিরা তাই স্বার্থবাদী নন, তিনি সবকিছু বিলিয়ে দেন প্রভাতের আলোর মতোন সহজ ও স্বাভাবিকতায়।

যা হারিয়ে যায়, কবি তা নিয়ে ক্ষেদ করেন না। কারণ কবিমাত্র রাজাধিরাজ। কুঁড়েঘর থেকে সে রাজার আলয়ের স্বপ্ন দেখেন। মুহূর্তেই সে রাজা কিংবা ফকির। কবির ধর্মই হচ্ছে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া। কবি ইচ্ছে করে কিছু হারান না। প্রাকৃতিকভাবেই অনিবার্য নিয়তি তাকে নিঃস্ব করে। এই নিঃস্বতা পূরণের জন্য কবি কঠিন সাধনায় নামেন, সত্য সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে লিপ্ত হন। এই নিঃস্বতা, এই সত্য সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করতে কবি ক্ষতবিক্ষত হন, রক্তাক্ত হন। এই ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত ইতিহাসই কবিকে আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা করে। ফলে আমরা দেখি কবিত্বের সাধনা কঠিন সাধনা।

অনেকে মনে করেন নারীর দেহ হলো কবিদের প্রিয় ভোজন। বাঁচতে হলে সবাইকে ভোজন করতে হয়। নইলে সে বাঁচবে কী করে। এই ভোজন এটি হলো নারী দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবচ্ছেদ করে সেটি উপজাত দ্রব্য যা আছে সেটি খাদ্যগুণ বিচার করে তা ভক্ষণ করা। এই ভক্ষণ প্রক্রিয়াটি সবার একা নয়, বিশেষ করে কবিরা এই ভোজনটি শৈল্পিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয় সম্পন্ন করে। এককথায় বলায় সেটি নান্দনিক উপায়ে উপস্থাপন করে সুধাপাত্রে নির্গমন করে। এই নির্গমন প্রক্রিয়াটি কবিদের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়াটি কবির কাছে প্রেম।  কবিরা প্রেমিক হয়। সস্তাদরের কবি যেমন সেটি বোঝেন না, তেমনি ঈষৎ বুদ্ধিজীবী পাঠকও।



আরো পড়ুন