২৯ জুন ২০২৪, শনিবার



পুঁজিবাজার: সিএমএসএফ কার স্বার্থ রক্ষা করছে

মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান || ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ০১:০৯ পিএম
পুঁজিবাজার: সিএমএসএফ কার স্বার্থ রক্ষা করছে


ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসএফ) থেকে ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। তবে,আইসিবি এই অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনে। তারা বলছেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে এই অর্থ কাজে লাগবে কি না, তাও সুস্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না।  এ কারণে তাদের মনে প্রশ্ন উঠছে, তাহলে সিএমএসএফ কার স্বার্থ রক্ষা করছে?

সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বলছেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নের নামে এই ফান্ডের টাকা দিয়ে নিম্নমানের শেয়ার কেনা হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবি এমনিতেই নানারকম লোনে জর্জরিত। সিএমএসএফ থেকে ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশে সুদে এফডিআর ফর্মেটে নেওয়া লোন আইসিবি আদৌ পরিশোধ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

তারা আরও বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর উচিত ছিল দীর্ঘদিন কোম্পানিগুলোতে পড়ে থাকা এই অর্থ প্রথমে চিহ্নিত করা। এরপর টাকা সিকিউরড করা। সরকারি ট্রেজারি বন্ড অথবা এফডিআর ফর্মেটে টাকা আটকে ফেলা। যেন ১০০ বছর পরে এসেও বিনিয়োগকারীদের উত্তরসুরিরা তাদের টাকাটা ফেরত পায়। কিন্তু তা না করে আইসিবির মাধ্যমে শেয়ার কেনা-বেচায় এই অর্থ ব্যয় করছে। এখন যেটা ভালো শেয়ার, আগামীকাল সেটা নিম্নমানের, আজ যেটা নিম্নমানের, আগামীকাল সেটা ভালো শেয়ার। 

সিএমএসএফ’র টাকা দিয়ে যদি শেয়ার কেনাবেচায় লোকসান হয়, তবে তার দায় কে নেবে? সিএমএসএফ যাদের দিয়ে গঠন করা হয়েছে, তাদের অনেকেই শেয়ারবাজারের লোক নন। রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র (ডিসিসিআই) বিল্ডিংয়ে প্রায় ১১ হাজার স্কয়ার ফুটের অফিসে ১৯ জন স্টাফ নিয়ে চালানো হচ্ছে সিএমএসএফের কার্যক্রম। যার পুরো খরচ চলবে এই ফান্ডের টাকায়। যার ফলে বিনিয়োগকারীদের এই টাকা কমতে শুরু করবে প্রতিনিয়ত।

তারা বলেন, বাজারের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবদান রাখতে পারেনি বিএসইসি। কমিশিন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মান উন্নয়ন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে ব্যর্থ, বাজারে তদারকি ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে কমিশন। শুধু তাই নয়, বাজার কারসাজিকরদের উল্লেখযোগ্য শাস্তি না দেওয়ায় বাজারে কারসাজি বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ ফ্লোর প্রাইজ দিয়েও বাজারকে রক্ষা করতে পারেনি কমিশন। সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে বর্তমান কমিশন। পাশাপাশি বিএসইসির কর্মকর্তাদের দুর্নীতি বন্ধ করতে পারেনি কমিশন।

পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদের সহ-সভাপতি আজাদ আহসান বাচ্চু ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘আইসিবি নিজেরই অনেক টাকা ঋণ আছে। এখন দেখা যাক সিএমএসএফ’র টাকা তারা কিভাবে শেয়ারবাজারের উন্নয়নে কাজে লাগায়।’

বিএলআই সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘প্রাথমিক অবস্থায় সিএমএসএফ-এর উদ্যোগ ভালো মনে হলেও বাজারে এর কার্যকারিতা শূন্য, দীর্ঘমেয়াদে এর উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ। দীর্ঘমেয়াদে এর উপকারিতা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্টা সন্দেহ রয়েছে। শেয়ার কেনা বেচায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কমিশন কোনোভাবেই যুক্ত থাকতে পারে না। মূলত এই ফান্ডের টাকা গুটি কয়েক মানুষের ভোগে চলে যাচ্ছে এবং যাবে।’

আইসিবি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল হোসেন ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘সিএমএসএফ’র টাকা দিয়ে আমরা ফান্ডামেন্টাল শেয়ারে বিনিয়োগ করেছি। কবে কোন শেয়ার কিনে থাকি তা কমিশনে হিসাব দেওয়া হয়। আমরা ‘জেট’ বা ‘বি’ ক্যাটাগরির শেয়ারে বিনিয়োগ করি না। ‘এ’ ক্যাটাগরির শেয়ারে বিনিয়োগ করে থাকি।’

কিন্তু তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিএমএসএফ থেকে আইসিবি ২২৫ কোটি টাকা লোন নিয়েছে। এই টাকা দিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৫৩টি কোম্পানির শেয়ার কিনেছে; যেখানে ‘বি’ ক্যাটাগরির শেয়ার রয়েছে-এবি ব্যাংক লিমিটেড, অ্যাডভেন্ট ফার্মা লিমিটেড, আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড, ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড, সিলকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।

তথ্য অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৭ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করে সিএমএসএফ গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া গোল্ডেন জুবিলি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের স্পন্সর হিসেবে সিএমএসএফ ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। সেখান থেকেও ৪৮ লাখ টাকা লভ্যাংশ পেয়েছে বলে সিএমএসএফ থেকে জানানো হয়েছে। আগামীতে বিনিয়োগকারীদের সেকেন্ডারি মার্কেটের জন্য মার্জিন লোন দেওয়া হবে এই তহবিল থেকে। তহবিলটির অফিসে কর্মরত স্টাফদের বেতন সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া বোর্ড অব গভরনর্সে মোট সিএমএসএফের চেয়ারম্যানসহ ১১ জন রয়েছেন। প্রতি মাসে দুটি বোর্ড মিটিং, একটি অডিট কমিটির মিটিং, একটি রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির মিটিং, একটি অপারেশনাল কমিটির মিটিং এবং একটি এইচআর কমিটির মিটিং হয়ে থাকে। এসব মিটিংয়ে উপস্থিত স্বাধীন পরিচালকরা ৮ হাজার টাকা করে রেমুনারেশন পেয়ে থাকেন।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘সিএমএসএফ থেকে লোন নিয়ে আইসিবি বাজারে বিনিয়োগ করছে। কিন্তু আইসিবি পুঁজিবাজারে এই টাকা বিনিয়োগ করে আদৌ লাভবান হবে কি না, সেটা বছর শেষে বোঝা যাবে।’

এদিকে এই তহবিল গঠনের আগে বিএসইসি থেকে বলা হয়েছিল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগকারীদের অদাবিকৃত লভ্যাংশ (ক্যাশ ও স্টক ডিভিডেন্ড) ২০ হাজার থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই তহবিলে কোম্পানিগুলো থেকে বিনিয়োগকারীদের অদাবির লভ্যাংশ মাত্র  ১ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা জমা হয়েছে। এরমধ্যে ৫৬৪ কোটি টাকা ক্যাশ ও ৯৫৪ কোটি টাকার সমপরিমাণের স্টক-বোনাস শেয়ার রয়েছে।

এ ব্যাপারে সিএমএসএফ-এর চিফ অব অপারেশন (সিওও) মো. মনোয়ার হোসেন ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘বিএসইসি তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও সিকিউরিটিজগুলোর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে দেখেছে যে, কোম্পানিগুলোর সাসপেন্ড অ্যাকাউন্টে মোট ২১ হাজার থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যের অদাবির আনসেটেল্ড ডিভিডেন্ড রয়েছে। আইপিও’র যে সাবস্ক্রিশন মানি; যেগুলো আনডিস্ট্রিবিউট রয়েছে। অথবা কোম্পানিগুলো রাইট অফার করেছিল কিন্তু ইস্যু করেনি, কোম্পানির হাতে রয়েছে। এই অর্থগুলো সিএমএসএফ জমা দিতে বলা হয়েছিল কোম্পানিগুলোকে। এটার মূল উদ্দেশ্য যখনই কোনো বিনিয়োগকারী সঠিক ডকুমেন্টসহ তার অর্থ দাবি করবে, তখন সিএমএসএফ তাকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে দিয়ে দেবে। টাকা হলে তার অ্যাকাউন্টে এবং স্টক-বোনাস শেয়ার হলে তার বিওতে পাঠাবে।’

মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কমিশন যখন এই সার্কুলার জারি করে, তখন অনেক কোম্পানি হয়তো তাদের অনেক বিনিয়োগকারীকে খুঁজে পেয়েছে।  দীর্ঘদিন পড়ে থাকা এই অর্থ থেকে তাদের মাঝে ডিস্ট্রিবিউট করেছে। যে কারণে সিএমএসএফের তহবিলে কমিশনের হিসাব অনুযায়ী অর্থ জমা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোম্পানিগুলোকে অডিট করার উদ্যোগ নিয়েছে সিএমএসএফ। তারা কী পরিমাণ অদাবির অর্থ বিনিয়োগকারীদের মাঝে বিতরণ করেছে, তা অডিটের মাধ্যমে জানা যাবে। প্রথম পর্যায়ে ৫০ কোম্পানি অডিট করা হবে। পর্যায়ক্রমে সব কোম্পানি অডিট করা হবে।’

সিএমএসএফ-এর সিওও আরও বলেন, ‘অডিটের পর বোঝা যাবে কোম্পানিগুলোর সাসপেন্ড অ্যাকাউন্টে বিনিয়োগকারীদের অদাবির  কত টাকা বা স্টক শেয়ার রয়েছে। কোম্পানিগুলো সঠিক জায়গায় বিতরণ করেছে কি না, তাও বোঝা যাবে।’

বিএসইসি’র মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘সিএমএসএফে বিনিয়োগকারীদের যে অদাবির অর্থ জমা রয়েছে বা থাকবে, সেই অর্থ দীর্ঘদিন পরেও যদি সঠিক ডকুমেন্ট সাবমিট করেন তারা দাবি করে, তাহলে তারা পাবেন। তবে তহবিলের টাকা থেকে সিএমএসএফ যে বেনিফিট পাবে, সেই টাকা বিনিয়োগকারীরা পাবেন না। বেনিফিটের টাকা দিয়ে তহবিলের কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে ও বাকি অর্থ তহবিলে জমা হবে।’

ঢাকা বিজনেস/এনই



আরো পড়ুন