২৯ জুন ২০২৪, শনিবার



বিশেষ প্রতিবেদন
প্রিন্ট

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশ, ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’

মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান || ১০ জানুয়ারী, ২০২৩, ১২:৩১ এএম
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশ, ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’


বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশে ভোক্তা-সাধারণের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, যেখানে দৈনন্দিন খরচ চালাতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বিদ্যুতের দাম বাড়লে তা হবে, ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। সোমবার (৯ জানুয়ারি) দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ঢাকা বিজনেসের কাছে এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

এর আগে, রবিবার, (৮ জানুয়ারি) রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনের শহীদ এ কে এম শামসুল হক খান অডিটরিয়ামে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এই শুনানিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করে। বিইআরসি’র কারিগরি কমিটি প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ১ টাকা ১০ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করে। সেই হিসাবে খুচরা বিদ্যুতের মূল্য গড়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ২৩ পয়সা করার সুপারিশ করা হয়। এতে গড়ে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে ১৫ দশমিক ৪৩ ভাগ। শুনানিতে পিডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতি টন কয়লার দাম ২৩০ ডলার এবং প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম ৭০ টাকা হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার ক্ষেত্রে ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন হবে। কিন্তু বিইআরসি পাইকারি মূল্য বৃদ্ধিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কাজেই এই মূল্য কাঠামো ধরে দাম বাড়ানো হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হবে না। 

এর আগে, গত ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ায় বিইআরসি। এরপর বিদ্যুতের খুচরা দাম বাড়ানোর আবেদন করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান রাজধানীর ডেমরার বাসিন্দা মুহাম্মদ মারুফ বিন ওয়ালি। তিনি রাজধানীর উত্তরায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ঢাকা বিজনেসকে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের সাহায্যে বাসা-বাড়িতে ফ্রিজ, ওভেন, এয়ার কন্ডিশন (এসি), ফ্যান, টিভিসহ নানারকম ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য ব্যবহার হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের দাম বাড়লে আগামীতে বর্তমানের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে। কারণ ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের ব্যবহার তো তেমন একটা কমে না। সব সময় প্রায় একই রকম থাকে। কেউ যদি এসি ব্যবহার করে সেক্ষেত্রে শীত মৌসুমে এর ব্যবহার কম হয়। গরমে আবার ঠিকই বেড়ে যায়। এই বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে আমাদের দৈনন্দিন খরচের ওপর নেগেটিভ প্রভাব পড়ে।’ 

মুহাম্মদ মারুফ আরও বলেন, ‘সরকার বিদ্যুতের মূল্য বাড়াতে পারে। তবে সেটা ২/৩ বছর পর পর নয়। কমপক্ষে ৫ বছর পরপর বাড়াতে পারে। আর তাও ২ থেকে ৩ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।’

আরএসএস গ্রিনটেক্স লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) মুহাম্মদ আবু জাফর বলেন, ‘সরকার বিদ্যুতের মূল্য বাড়ালে আমাদের খরচ বাড়বে। প্রতি মাসে আমার অফিস বিদ্যুৎ বিল দেয় প্রায় ১৭ লাখ টাকা। এখন কিলোওয়াট প্রতি ১৫.৪৩ টাকা বাড়লে আমাকে অতিরিক্ত ২ লাখ ৬২ হাজার ৩১০ টাকা প্রতিমাসে দিতে হবে। এখানে ভ্যাটও বাড়বে। বছরে বাড়বে ৩১ লাখ টাকার ওপরে। এখন যে কম্পিটিশন মার্কেট। আমাকে বায়াররা এই বাড়তি টাকাটা দেবে না। আমাকে মার্জিন থেকে বা প্রফিট থেকে এই টাকাটা দিতে হবে। এতে আমার মুনাফা কমে যাবে। স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের পণ্য উৎপাদনে এর নেগেটিভ প্রভাব পড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু তাই নয়, বিদ্যুতের বিল বাড়ালেও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারবে না কোম্পানিগুলো। তখন আমাকে জেনারেটর, ডিজেল দিয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। ফলে দুই দিকেই আমার খরচ বেড়ে যাবে। শুধু উৎপাদনেই নয়, এর নেগেটিভ প্রভাব চতুর্দিকেই পড়বে।’

কনজিউমার অ্যাসোসিয়শন অব বাংলাদেশকে (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা প্রফেসর ড. এম সামুসল আলম বলেন, ‘বর্তমানে জ্বালানি, গ্যাস, তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যমূল্যও বেড়েছে। ফলে ভোক্তাদের ভোগব্যয় চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ওপর আবার যদি বিদ্যুতের দাম বেড়ে যায়, তবে সেটিকে চরমভাবে উসকে দেওয়া হবে। ২০২৩ সালে যেখানে বলা হচ্ছে সারাবিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে, সেখানে বিদ্যুতের মূল্য দাম বাড়লে ভোক্তার ভোগব্যয়ে প্রভাব পড়বে। ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণেও এর নেগেটিভ প্রভাব পড়বে। সরকারের প্রবৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়বে। ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য না বাড়িয়ে ঘাটতি মেটাতে নানা কৌশল আমরা দেখিয়েছি। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভতুর্কি কমানো, ঘাটতি সমন্বয় একটি ভুল পদক্ষেপ। অযৌক্তিক ব্যয়, অদক্ষতা, দুর্নীতির কারণে সরকারের ব্যয় বেড়েছে। এসব ঠিক না করে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো আত্মঘাতী।’

ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)-এর এসঅ্যান্ডডি অপারেশন (নর্থ জোন) প্রকৌশলী মো. মফিজুল ইসলাম ভূঞা বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ কিনে তা বিক্রি করি। সরকার কোনো ভর্তুকি দেয় না। কেনা-বেচাতে আমরা যতটুকু মার্জিন পাই, তা দিয়েই আমাদের বেতন-ভাতা, অপারেশনাল এক্সপেন্সসহ যাবতীয় খরচ মেটাতে হয়। এখন বিদ্যুতের বাল্ক রেট যদি বেড়ে যায়, তবে বিদ্যুতের মূল্য না বাড়ালে আমাদের মতো কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো প্রয়োজন। এখন কতুটুকু বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা প্রয়োজন সেটি আমি বলতে পারবো না।’

বিইআরসি’র সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ বজলুর রহমান ঢাকা বিজনেসকে বলেন, ‘খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের না বাড়ালে কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদ্যুতের দাম বাড়বে। তবে কত শতাংশ বাড়বে, তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। আমরা  ক্যাব বলেছি।  ১৫ জানুয়ারির মধ্যে তাদের যদি এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য থাকে, কোথায় কোন উদ্যোগ নিলে ভালো হয়, তা সাবমিট করতে পারবেন। তাদের বিষয়টি মাথায় রেখে, সব কিছু এনালাইসিস করেই বিদ্যুতের দাম ফাইনাল অর্ডার ইস্যু করবে বিইআরসি।’

ঢাকা বিজনেস/এনই/



আরো পড়ুন