২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার



ডেঙ্গু: সচেতনতাই আনতে পারে সমাধান

আশরাফ জুয়েল || ২৪ জুলাই, ২০২৩, ০৯:৩৭ এএম
ডেঙ্গু: সচেতনতাই আনতে পারে সমাধান আশরাফ জুয়েল


বাচ্চাটার বয়স সতেরো। ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। গত রাতে নন-রেকর্ডেবোল ব্লাডপ্রেসার নিয়ে আইসিইউ-তে ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন। গত রাত থেকে আজ প্রায় সারাদিন সব প্রচেষ্টার পরও ব্লাড প্রেসার মেজার করা গেলো না। সব ধরনের চেষ্টার পরও এখন পর্যন্ত একই অবস্থা, ইনফ্যাক্ট অবস্থার অবনতিই হয়েছে।

বাচ্চাটার বাবা প্রবাসী, মা উচ্চরক্তচাপের রোগী। বাচ্চাটি আর কতক্ষণ আমাদের মধ্যে থাকবে বলা মুশকিল। খুব মন খারাপ নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে আসার সময় জেনে এলাম, ‘বিছানা খালি নেই’। ডেঙ্গু আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। বিগত বছরগুলোয় প্রায় প্রতি বছর বর্ষাকালে  (জুন-জুলাই-অগাস্ট মাসে) ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। আগে ভাবা হতো ডেঙ্গু শুধু ঢাকা শহরের অসুখ, কিন্তু তা আর নেই। আজকের খবর অনুযায়ী প্রায় পঁয়ত্রিশ জেলায় এ রোগের বিস্তার ঘটেছে। 

ডেঙ্গু প্রতিরোধে ‘রাষ্ট্রের কী করণীয় বা কার ব্যর্থতা?’-এ নিয়ে কথা বলার রুচি আপাতত নেই বরং নাগরিক হিসেবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী করণীয়, ডেঙ্গু হলে কী করতে হবে বা হবে না, এসব নিয়েই এ লেখাটি। লেখাটি প্রস্তুত করতে ব্যক্তিগত পড়াশোনা সঙ্গে  ‘বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা’ এবং  ‘জাতীয় ম্যালারিয়া নির্মূল ও এডিস বাহিতরোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর’ প্রণীত গাইডলাইনের সহায়তা নেয়া হয়েছে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধযোগ্য অসুখ না হলেও কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে এ অসুখের প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমানো যেতে পারে। আমরা ইতোমধ্যে জানি কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত, তবু আবার জেনে নেই- অত্যধিক ঘনবসতিপূর্ণ বা ঘিঞ্জি এলাকা এড়িয়ে চলা, কোথাও পানি জমেতে না দেয়া, সকলের সহযোগীতা এবং প্রচেষ্টায় ড্রেন বা নর্দমাগুলোকে যতটা সম্ভব পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা, মশা নিরোধক স্প্রে/কয়েল ব্যবহার করা, বাসায় মশারী ব্যবহার করা, বাইরে যাওয়ার সময় ফুলহাতা জামা ব্যবহার করা, মোজা পরা, জানালায় নেট লাগানো, দরজা যতটা সম্ভব লাগিয়ে রাখা ইত্যাদি। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা’ ডেঙ্গু রোগের রোগীদের মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করেছে।  

গ্রুপ-এ:  ডেঙ্গু রোগ,সঙ্গে সতর্কীকরণ সংকেত অনুপস্থিত। এসব রোগী বাসায় বসেই চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন। এই রোগীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। 

গ্রুপ-বি: ডেঙ্গু রোগ,সঙ্গে সতর্কীকরণ সংকেতের উপস্থিতি। এসব রোগীকে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। 

গ্রুপ-সি: ডেঙ্গু রোগ। রোগী গুরুতর অসুস্থ। এই রোগীদের অবশ্যই হাসপাতালের ইনিটেনসিভ কেয়ারে চিকিৎসা নিতে হবে।

কমবেশি আমরা সবাই জানি ডেঙ্গু রোগের লক্ষণগুলো কী। তবু আবার জেনে নেই:

সাধারণত জ্বরের সঙ্গে বমিবমি ভাব বা বমি হওয়া, শরীরে র‍্যাশ ওঠা, শরীর ব্যথা, জয়েন্ট ব্যথা, চোখের পেছনের দিকে ব্যথা। এবারের ডেঙ্গু উল্লিখিত লক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে ডায়েরিয়া নিয়েও প্রেজেন্ট করছে।

বিপজ্জনক লক্ষণগুলোর মধ্যে- পেটে তীব্র ব্যথা, দিনে তিনবারের বেশি বমি, দিনে তিন বারের বেশি ডায়েরিয়া বা পাতলা পায়খানা, দাঁতের গোড়া থেকে রক্তপাত, অত্যধিক দুর্বলতা অনুভব করা, অস্থিরতা, পেটে পানি জমা বা পেট ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া। এসবের সঙ্গে রক্তের শ্বেতকনিকা ৫০০০ হাজারের নিচে নেমেযাওয়া বা প্লাটিলেট কাউন্ট দেড় লাখের নিচে বা রক্তের হেমাটোক্রিট (৫-১০)% বেড়ে যাওয়া।

রোগ নির্ণয়ের জন্য যে সব পরীক্ষা করা হয়, তার মধ্যে জ্বর আসার ১-৩ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু- এনএসওয়ান পজিটিভ, জ্বর আসার ৫-৭ দিন পর ডেঙ্গু আইজিএম এন্টিবডি পজিটিভ আসে।

জ্বর এলে প্যারাসিটসল, স্পঞ্জিং করে জ্বর কমানোর চেষ্টা করতে হবে। প্রচুর পানি বা লিকুইড খেতে হবে। দুই দিন পরপর রক্তের সিবিসি টেস্ট করাতে হবে। আমরা প্লাটিলেট কাউন্ট নিয়ে বেশি অস্থির হয়ে পড়ি। কিন্তু প্লাটিলেট কাউন্ট দেখার সঙ্গে-সঙ্গে  সবচেয়ে জরুরি হলো হেমাটোক্রিট।

হেমাটোক্রিট বেড়ে যাওয়া মানেই রোগীর প্লাজমা লিকেজ হচ্ছে। মানে রোগীর রক্তনালী থেকে লিকুইড অংশ বেরিয়ে পেটে বা ফুসফুসে জমা হচ্ছে। এই অবস্থাটা সবচেয়ে খারাপ। এ সময় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে প্রচুর ফ্লুইড দিতে হবে এবং সেটা ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড বা স্যালাইন।

ভয়ের কিছু নেই, বেশির ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাচ্ছেন। খুবই অল্প সংখ্যক রোগীর অবস্থা গুরুতর হচ্ছে, সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে এসব রোগীও সুস্থ হচ্ছেন।লেখাটা লিখতে লিখতেই খবর এলো, বাচ্চাটার অবস্থা আরও গুরুতর, হয়তো সে আমাদের মধ্যে আর বেশিক্ষণ নেই, ইতোমধ্যে একবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে গেছে। তবু বলি, আতঙ্ক নয় সুস্থ থাকতে প্রয়োজন সতর্কতা। সময়মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।   সুস্থ থাকুন এবং একে অন্যকে দোয়ায় রাখুন।

রচনাকাল: ২৩ জুলাই, ২০২৩

লেখক: চিকিৎসক



আরো পড়ুন