১১ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার



ইউক্রেন যুদ্ধে নতুন মোড়, চাপে জেলেনস্কি

আফরিদা ইফরাত || ০২ মার্চ, ২০২৫, ০২:০৩ এএম
ইউক্রেন যুদ্ধে নতুন মোড়, চাপে জেলেনস্কি


২০১৯ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ভলোদিমির জেলেনস্কি। নির্বাচনের পরই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থণ আদায়ের সক্ষমতা দেখাতে পারেন তিনি। ট্রাম্পের সঙ্গে তার প্রথমবার ফোনে আলাপের সময় সেটিকে তিনি একটি ‘আদর্শ কূটনৈতিক আলোচনা’ বলেই অভিহিত করেছিলেন বলে অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়। জেলেনস্কি ট্রাম্পকে তার কূটনৈতিক প্রজ্ঞার জন্য প্রশংসাও করেন। যুদ্ধ বন্ধ করার বিষয়ে তিনি ট্রাম্পকে শিক্ষক সমতুল্যও বলেছিলেন। সেটি আজ থেকে ছয় বছর আগের কথা। এর মাঝে ট্রাম্প ক্ষমতা হারিয়েছেন এবং ক্ষমতায় ছিল ডেমোক্র্যাটরা। ছয় বছর পর জেলেনস্কি এমন সময়ে ট্রাম্পের মুখোমুখি হচ্ছেন যখন দ্বান্দ্বিকতা তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারছেন না। বরং তার জন্য এখন সংকট বেড়েই চলেছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন সামলাতে গিয়ে বিগত বছরগুলোতে ডেমোক্র্যাট প্রশাসন জেলেনস্কিকে নানাভাবে সহায়তা করেছে। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পর যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো নীতির বড় পরিবর্তন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংরক্ষণের পাশাপাশি বাইরে থেকে সম্পদ আহরণের বাণিজ্যিক কূটনীতি ও পরাশক্তির ক্ষমতার ব্যবহার বাড়িয়েছে। আর এমন সময়ে জেলেনস্কি সম্ভবত একটি বিষয় মাথায় রাখতে পারেননি। তিনি হয়ত ভুলে গেছেন, ট্রাম্পের সঙ্গে একটি সমঝোতা কিংবা চুক্তি ব্যতীত কোনোভাবেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পাবেন না। অন্তত ট্রাম্পের সঙ্গে কূটনীতির ক্ষেত্রে তাকে যথাসম্ভব কেতাদুরস্তভাবে প্রশংসা করতে হবে এবং সংবাদ সম্মেলনে সামান্য অসন্তোষও তাকে বেকায়দায় ফেলে দেবে।

এমনটিই ঘটেছে। পহেলা মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনলাইন সংস্করণের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আশা করেছিলেন, শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইতিবাচকভাবে আলোচনা শেষ করতে পারবেন। তারপর সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে তিনি হোয়াইট হাউস ছাড়বেন। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি; বরং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সামনে খুব বাজেভাবে নাজেহাল হয়েছেন জেলেনস্কি। বৈঠক চলাকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে তাঁর ব্যাপক বাগ্বিতণ্ডা হয়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে জেলেনস্কির আরও বেশি করে কাজ করা উচিত বলে ট্রাম্প ও ভ্যান্স পরামর্শ দিলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট তাতে সায় দেননি। এতে ট্রাম্প ও ভ্যান্স ক্ষেপে গিয়ে বলেন, জেলেনস্কি তাঁদের অসম্মান করছেন। এক পর্যায়ে জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউস থেকে চলে যেতে বলা হয়। বৈঠক শেষে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির যৌথ সম্মেলন করার কথা থাকলেও তা বাতিল করা হয়। দুপক্ষের মধ্যে খনিজ সম্পদ চুক্তিটিও স্বাক্ষর হয়নি। জেলেনস্কি গাড়িতে করে হোয়াইট হাউস থেকে চলে যাওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত হলে ফিরে আসবেন।’

এদিকে জেলেনস্কি এ বৈঠকের পরও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগীতার বিষয়টিকে জোর দিয়েছেন। তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প এ যুদ্ধ বন্ধ করতে আগ্রহী। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি চান যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে আরও দৃঢ়ভাবে দাঁড়াক। ট্রাম্পের সঙ্গে ওই বৈঠককে ‘কঠিন সংলাপ’ বলে বর্ণনা করেছেন জেলেনস্কি। তিনি বলেন, ইউক্রেইন খনিজ চুক্তি সই করতে প্রস্তুত। তবে এর বিনিময়ে তিনি এখনও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া যুদ্ধবিরতি করা ইউক্রেইনের জন্য বিপজ্জনক বলে তিনি উল্লেখ করেন। অর্থাৎ জেলেনস্কি প্রথমে যদিও কোনোভাবেই মূল্যবান খনিজ দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না। এখন তাকে ইউরোপের রাজনীতির মেরূকরণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়ার প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখানোর প্রবণতা দেখে বাধ্য হয়ে রাজি হতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিরিখে এমনটি যে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপকে কোণঠাসা করার নজির, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

যদি সহজ ভাষায় বলি, ২০১৯ সালে ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির যে পরিস্থিতি ছিল, পরিবর্তিত সময়ে তাকে আরেক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। রাশিয়া তার দেশ দখল করেছে, সেখানে গণহত্যা পরিচালনা করেছে, অনেক সুন্দর শহর গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং ইউক্রেনের শিশুদের পাঁচার করে দিয়েছে। ট্রাম্পের সঙ্গে ওভাল অফিসে তিনি ১ মার্চ যা বলেছেন তার কোনোটিই কিন্তু ভুল ছিল না। কারণ রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণেই এ যুদ্ধ, ইউক্রেনের কারণে এ যুদ্ধ নয়। দীর্ঘ ছয় বছরে ট্রাম্পের সন্দেহপ্রবণ ও চুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ার মানসিকতায় একটুও বদল আসেনি। আমরা দেখছি, তিনি এ যুদ্ধের জন্য জেলেনস্কিকেই দায়ি করছেন। এ জন্যই ট্রাম্প ও জেডি ভান্স জেলেনস্কিকে ওভাল অফিসে কোণঠাসা করেছেন। জেলেনস্কি ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি চান যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পক্ষে থাকুক। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়লে তা দেশটির জন্য ক্ষতিকর হবে। একই সময়ে জেলেনস্কিকে বুঝতে হবে, ওয়াশিংটনের বাস্তবতা বদলে গেছে। এ নতুন বাস্তবতার আলোকেই তাকে আলোচনা চালাতে হবে এবং সমর্থণ আদায় করে নিতে হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির বৈঠকের মেরূকরণের দিকটি মূলত কোথায়? এখানে পশ্চিমা বিশ্বের বদলে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগীতা আদায়ের অভ্যন্তরীণ মানসিকতাকে ইতিবাচক করাটাই এ বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু জেলেনস্কি যতই সঠিক কথা বলুক না কেন, ট্রাম্প ও জেডি ভান্সের প্রতিক্রিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে তার যে চিত্রায়ন হয়েছে, তা দেশটির জনগণের মনে জেলেনস্কি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। আমরা দেখছি, ইউক্রেনের পাড় সমর্থকরাও এখন জেলেনস্কিকে সমালোচনা করছে। অর্থাৎ যুদ্ধে সহযোগীতার ক্ষেত্রে ইউক্রেন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।

এবার আসা যাক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ছিঁটেফোটা কিছু তথ্যে। এসব তথ্য মেলালে এ বৈঠকের পরবর্তী প্রভাবটি বোঝা সহজ হবে। ওভাল অফিসে মাত্র দশ মিনিটের বৈঠকে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে তার দায় কি জেলেনস্কির ওপর বর্তায়? অন্তত তা মনে হচ্ছে না। কারণ এর আগেও ট্রাম্প ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছিলেন, এ যুদ্ধের জন্য জেলেনস্কিই দায়ি এবং পুতিন যুদ্ধবিরতিতে রাজি; সেক্ষেত্রে একটি ভালো চুক্তি তিনি দাবি করেন। সংগত কারণেই সন্দেহ জাগে, ওভাল অফিসে জেলেনস্কিকে উত্তেজিত করাটি সম্ভবত ট্রাম্পের একটি ফাঁদ। এ বিষয়ে অবশ্য নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ একেবারেই কম। এভাবেই ট্রাম্প ও ভান্স ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্রের মৈত্রী অনেকটা দূর্বল করে ফেললেন। কারণ কোনো ধরণের স্বাভাবিক চুক্তি ব্যতীত ট্রাম্প এখন কোনো সহযোগীতাই দিতে রাজি হবেন না। বৈশ্বিক যুদ্ধ হোক কিংবা কোনো সংকট—ট্রাম্প চাইবেন কোনো না কোনো ভাবে অর্থনৈতিক কোনো ফায়দা আদায়ের। সম্প্রতি জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনা অন্তত এমনটিই ইঙ্গিত করছে।

ট্রাম্প ইতোমধ্যে তার অর্থনৈতিক ফায়দা আদায়ের ক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র ১ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ট্রাম্পের নিয়োগ করা মাইনিং দল ইতোমধ্যে ইউক্রেনের সঙ্গে সব সমন্বয়মূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা এ সপ্তাহেই এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সাক্ষরের কথা জানিয়েছেন। বিষয়টি প্রশাসনিকভাবেই করে ফেলা যায়। কিন্তু এখানেও ট্রাম্পের কিছু চমক রয়েছে। মনে হচ্ছে, ট্রাম্প এ সমঝোতা সাক্ষরকে তার একটি বড় সফলতা হিসেবে দেখাতে চাচ্ছেন। এজন্য লাইভে তিনি এর আয়োজন করবেন। এমনটি এক হিসেবে জেলেনস্কিকে মানসিকভাবে ভেঙেই ফেলবে। কারণ ইউরোপ জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনকে লোন দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও কোনো আর্থিক লাভ ছাড়া তাদের সহযোগীতা করবে না। অর্থাৎ ইউক্রেনের এতদিনের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বড় কূটনৈতিক ধাক্কা চলে এসেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, জেলেনস্কি এখন কী করবেন? তিনি কি সমঝোতা স্মারক সাক্ষর করবেন? কিন্তু এর বিপরীতে তার রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি কতটা গুরুত্ব পেয়েছে? এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছু জানায়নি। ওভাল অফিসে জেলেনস্কির এবারের অভিজ্ঞতা তাকে কিছুটা হলেও দ্বিধাগ্রস্ত এবং সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগাবে। তার দীর্ঘদিনের সমর্থক রাষ্ট্র কোনো কারণে নমনীয় অবস্থানে চলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র এতটাই নমনীয় অবস্থায় রয়েছে যে, ইউক্রেনকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দেওয়া শর্ত মোতাবেক যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এতটা নমনীয় হলেও যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্যপদ দেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে (বাস্তবে আসলে কতটা বাস্তবায়িত হবে জানা নেই)।

ইউক্রেন এখন কেন নমনীয় অবস্থানে যেতে বাধ্য তা বোঝা কঠিন কিছু নয়। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা একটি বড় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তাদের সবচেয়ে বড় আর্থিক ও সামরিক সহায়তাকারী রাষ্ট্রই এখন তাদের সবচেয়ে শত্রুর সঙ্গে সমঝোতার জন্য চাপ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে ন্যাটো সদস্যপদ দেওয়ার ফাঁপা কিছু আশ্বস্তিও দেওয়া হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, তারা কোনো ভুল করছে না। বরং তারা এক্ষেত্রে যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছে। উলটো তারা জেলেনস্কিকে যুদ্ধ জারি রাখার মূল কারণ হিসেবে উপস্থাপন করছে। কদিন আগে জেলেনস্কি জানিয়েছেন, ট্রাম্প পুতিনের মিথ্যে তথ্য বিশ্বাস করছেন। অর্থাৎ সব পক্ষের মধ্যে একটি সুষ্ঠ আলোচনার মঞ্চ গড়ে ওঠেনি।

শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স জানিয়েছেন, কূটনীতিই সব সমস্যার সমাধান। এর বিপরীতে জেলেনস্কি এই কূটনীতির স্বরূপ জানতে চেয়েছেন। কারণ আগেও পুতিন অনেক চুক্তির বাইরে গিয়েছেন। এ বিষয়টিকে ভান্স কেন অসহযোগিতা হিসেবে দেখলেন, তা বোঝা কঠিন। এখন জেলেনস্কি আর তার প্রশাসন ভাঙা খণ্ডটুকু জোড়া লাগানোর কাজে হিমশিম খাচ্ছে। এ যুদ্ধের মেরুকরণ নানাভাবে ইউক্রেনের বিপক্ষেই যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এমনকি ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্কেও কিছুটা অভিঘাত লাগবে। জেলেনস্কি এ ঘটনার পর ফক্স নিউজে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। ট্রাম্পের সাফ কথা, শান্তি প্রতিষ্ঠার মানসিকতা গড়লে জেলেনস্কি আবার আসবেন। তবে এসবের মানে একটিই, ট্রাম্প ইউক্রেনের কাছে একটি চুক্তি চান। এমন চুক্তি যান যা যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করবে। 

লেখক: সংবাদকর্মী




আরো পড়ুন