রাজশাহী বিখ্যাত আমের জন্য, এটা সবাই জানে। আরও বেশি যারা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন, আমের আসল জায়গা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বাস্তবে আমের রাজধানী বা মূল কেন্দ্র হলো কানসাট। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায়। সোনামসজিদ স্থল বন্দরের খুব কাছের এলাকা। অনেক দিন ধরেই ইচ্ছে ছিল আমের রাজ্যে যাব। হঠাৎ সুযোগ হয়ে গেলো। সোনামসজিদ বন্দর ও কানসাট ভ্রমণ একসঙ্গে।
নাটোর হয়ে রাত ১১ টার দিকে পৌঁছলাম রাজশাহী। সেখানে হালকা নাস্তা সেরে রওনা হলাম সোনামসজিদ বন্দরের দিকে, মহানন্দা সেতু পেরিয়ে, শিবগঞ্জের রাস্তা ধরে। পথে দেখছিলাম অসংখ্য ট্রাক। সবগুলোই আমবোঝাই। আমের ক্যারেট একটার পর একটা সাজানো।
রাত ১২ টার কিছু পর গিয়ে উপস্থিত হলাম কানসাট বাজারে। তখনো বিভিন্ন ট্রাকে আম তোলা হচ্ছিল। কোনো কোনো ট্রাক আম নিয়ে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছিল।
এত রাতে কি রেস্টুরেন্ট খোলা পাওয়া যাবে? গ্রামীণ পরিবেশে? বাস্তবতা হলো, সারারাতই রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে। আম লোডিংয়ের শ্রমিক, ট্রাক চালক-হেলপার, ব্যবাসায়ীদের আনাগোনায় রাত চারটা অবদি এলাকা সরগরম থাকে। গরম কালাই রুটি দিয়ে রাতের খাবার সারলাম।
একটা আমের ট্রাকের পাশেই কথা হলো স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়ালের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ গাড়ি (ট্রাক) আম যায় কানসাট থেকে। চাঁপাই-সোনামসজিদ বন্দর রাস্তায় সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত জ্যাম লেগে থাকে। রাস্তার দুই ধারে সব আমের আড়ৎ। রাস্তায় আম বোঝাই ট্রাক, পিক আপ, অটো, রিকশাভ্যান, ট্রলিতে এই জ্যাম। কানসাট বাজার পাড় হওয়া দুষ্কর হয় আমের মৌসুমে। পুরো আমের মৌসুম, মধ্য মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত এ অবস্থা থাকে।
এর কারণ কী? কারণ হলো দেশের আমের সিংহভাগ জোগান যায় কানসাট এলাকা থেকে। এই এলাকার প্রধান ফসল আম। শিবগঞ্জের মতো দেশের কোথাও এত আম বাগান নেই। এখানকার আমবাগানগুলো অনেক বড়। চাঁপাইয়ের পরেই আমের দ্বিতীয় জোগানভাণ্ডার এখন নওগাঁ। নওগাঁর সাপাহারে বেশি আম উৎপাদন হয়। তৃতীয় অবস্থানে রাজশাহী।
এছাড়া নাটোর, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর; এসব অঞ্চল আমের জন্য বিখ্যাত। যেমন হাঁড়িভাঙা আমের জন্য বিখ্যাত রংপুর। ল্যাংড়া, হিম সাগর পাওয়া যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী এলাকায়। যশোর-সাতক্ষীরা-চুয়াডাঙ্গা বিখ্যাত আম্রপালির জন্য; অবশ্য এ অঞ্চলে গুটি, লক্ষ্মণভোগ, চোষা; এসবও পাওয়া যায়।
আমকে বলা হয় ফলের রাজা। বাহারি নাম, গন্ধ ও স্বাদের আম রয়েছে। একেক প্রকারের স্বাদ একেক রকম। জানা গেলো, পৃথিবীতে ৩৫ প্রজাতির আম আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভ্যারাইটি সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে পাওয়া যায় সাড়ে ৩ শ’রও বেশি প্রকারের আম। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জেই পাওয়া যায় ৩০০ রকমের আম।
চাঁপাইতে পাওয়া যায় ল্যাংড়া, হিমসাগর, ফজলি, গৌড়মতি, ক্ষীরাসাপাতি, গোপালভোগ, মোহনভোগ, কল্পনা, জিলাপিভোগ, লক্ষণভোগ, মিছরিভোগ, বোম্বাই, চোষা, ক্ষীরভোগ, বৃন্দাবনী, চন্দনী, হাজিডাঙ্গ, সিঁদুরা, গিরিয়াধারী, বউভুলানী, জামাইপছন্দ, বাদশভোগ, রানীভোগ, রানীপছন্দ, দুধসর, মিছরিকান্ত, বাতাসা, মধুচুসকি, রাজভোগ, মেহেরসাগর, কালীভোগ, সুন্দরী, আম্রপালি, পানবোঁটা, দিলসাদ, কালপাহাড় ইত্যাদি।
কানসাট ভারত সীমান্তঘেঁষা একটি এলাকা। সীমান্তের ওপাড়েই ভারতের মালদা জেলা। সেখানেও প্রচুর আম হয়। বলা চলে আমের জন্য ওই এলাকার মাটি খুবই উপযোগী। এ কারণে যেদিকে তাকানো যায়, শুধু আমের বাগান।
রাতের খাবার খেয়ে হোটেলের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন ব্যবসায়ী ওবায়েদ ভাই বললেন, চলেন আম চুরি করি! সঙ্গে ছিলেন ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন আকাশ, জামাল হোসেন, স্কটল্যান্ড থেকে আসা সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর। সবাই অবাক! চুরি করবো কেন? আম তো কিনেই খেতে পারি। ওবায়েদ ভাই বললেন, আম চুরি করে খেতে মজা।
তাই বলে চুরি করতে হবে? ওবায়েদ ভাই জানালেন, চুরি আসলে নিজের বাগানেই করবো, অন্যের বাগানে নয়!
রাতে ছিলাম পর্যটনের একটি মোটেলে। সোনামসজিদ বন্দরের খুব কাছে। রাতের বেলা ভালো বোঝা যায়নি। দিনের আলো ফুটতেই দেখা গেলো, চারপাশে অসংখ্য আমের বাগান। তাতে থোকা থোকা আম ধরে আছে। রাস্তা দিয়ে লোকজন লাইন ধরে আম নিয়ে যাচ্ছেন কানসাট বাজারের দিকে। আড়তে অথবা মহাজনদের কাছে বিক্রি হবে। সেগুলো ট্রাকে করে চলে যাবে বিভিন্ন জায়গায়।
সারাদিন চড়া রোদ ছিল। জুনের শেষে মধ্যদুপুরে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তাপ মাথায় নিয়ে বাগানে যাওয়ার সাহস হয়নি। বিকেলে হঠাৎ আকাশ মেঘলা হওয়ায় তাপ কমে গিয়েছিল। তখনই আমরা ছুটলাম বাগানের দিকে।
যাওয়ার পথে দেখলাম কিছু বাগানে ব্যাগিং সিস্টেমে আম প্যাকেটে মোড়ানো। রপ্তানির জন্য এখন আমের ব্যাগিং শুরু হয়েছে। আমে যেন পোকার আক্রমণ না হয়, যেন ভাইরাস আক্রান্ত না হয়, বাইরের রোদ-বাতাস না লাগে।
এরকম কাগজের ব্যাগে ভরা আমের টেস্ট কেমন? টেস্ট বা স্বাদ সাধারণ আমের চেয়ে কম। কারণ আলো-বাতাস না লাগলে সেটা ন্যাচারাল টেস্ট দেবে না।
সোনামসজিদবন্দর সংলগ্ন জামাল হোসেন ভাইয়ের বাগানে ঢুকলাম। যদিও তার বাগানের সব আম তখনো পাকেনি। তিনি ফোন করলেন তার মামা আব্দুল জলিলকে। মামার বাগানে তখন হারভেস্টিং বা আম পাড়া হচ্ছিল। প্রাইভেট কার আর মাইক্রোবাস নিয়ে একদল লোক ঢুকে গেলাম বাগানের প্রায় এক কিলো ভেতরে। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটছিলাম। বাগানের ভেতর দুই নারীকে দেখলাম আমের রস জাল দিচ্ছেন, আমসত্ব বানাচ্ছিলেন তারা।
বাগানের মাঝখানে বেশ কয়েকটি পুকুর। আছে রাতে থাকার মতো ঝুঁপড়িঘর। এই পুকুর থেকে আম গাছে পানি দেওয়া হয়। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে আম পাড়া হচ্ছিল। নিচে পড়ে ছিল কাঁচা পাকা আম। কাঁচি দিয়ে মাথা কেটে খোসা ছাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলাম রসালো পাকা আম। গাছপাকা ল্যাংড়ার টেস্ট, আহ, অনন্য!
সবাই আম খাওয়ার প্রতিযোগিতায়। জামাল ভাই, ওবায়েদ ভাই আম বাছাই করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু তিন-চারটার বেশি কেউ খেতে পারলাম না। আরও কিছুটা দক্ষিণে গিয়ে আরেকটা গাছের আম টেস্ট করলাম। বাগানে বসে রসালো-সুস্বাদু আমের টেস্ট, পৃথিবীতে এর চেয়ে সুখকর বোধহয় আর কিছু নেই।
আম খাওয়া শেষে পাশের পুকুর থেকে তোলা পানিতে হাত ধুয়ে নিলাম। বাগানে উপস্থিত সবাইকে ডেকে একটা গ্রুপ ছবি তুললাম।
আব্দুল জলিল জানালেন, তার বাগানটা অনেক বড়। এখানে বিভিন্ন রকমের আম আছে। মৌসুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আম থাকে তার বাগানে। বলা চলে, বছরে এই একটা ফসলই তাদের। প্রশ্ন করলাম, গাছের ফাঁকে হলুদ, আদা এসবের চাষ করতে পারেন। জানালেন, তাতে আমের ক্ষতি হয়।
পরের দিন সকালে ঢাকা ফেরার পালা। রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম আরেক দৃশ্য। রাস্তার যত ভ্যান, অটো, পিকআপ, ট্রাক যাচ্ছিল, সবগুলোতেই শুধু আম আর আম। সবাই যাচ্ছিল কানসাট বাজারের দিকে।
কানসাট বাজারের আগেই জ্যামে পড়লাম। জ্যামে বসে দেখছিলাম আম রাজ্যের দৃশ্যাবলী। যেদিকে তাকাই শুধু আম আর আম। আম ছাড়া চারদিকে আর কিছুই নেই। আমের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়!
ঢাকা বিজনেস/এনই