১৯ মে ২০২৪, রবিবার



পানিশূন্য তাহিরপুরের ৩ টিলা, ভোগান্তিতে বাসিন্দারা

তানভীর আহমেদ: তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) || ০২ জুন, ২০২৩, ০১:০৬ পিএম
পানিশূন্য তাহিরপুরের ৩ টিলা, ভোগান্তিতে বাসিন্দারা


সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার তিন টিলায় বিশুদ্ধ পানীয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। টিলাগুলো হলো বারেকটিলা, মাঝের টিলা ও চানপুর টিলা। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, দুর্গম এসব পাহাড়ি টিলার পল্লীতে ঝর্ণা ও নদীতে পানি থাকলেও সবসময় সেখানে পর্যাপ্ত সুপেয় ও নিরাপদ পানি পাওয়া যায় না। ফলে, ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। এছাড়া, বিভিন্ন রকম পানিবাহিত রোগ দেখা দেয় ওই সব এলাকায়।  

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার বড়দল (উ.) ইউনিয়নের বারেকটিলা, মাঝের টিলা, চানপুর টিলায় ৩ শতাধিক পরিবার বসবাস করে। তাদের খাওয়ার পানি সংগ্রহ করার একমাত্র মাধ্যম সীমান্তের ছড়া, তবে সীমান্ত সড়কে ছড়ার মুখ বন্ধ। ফোঁটা ফোঁটা পানি যা আসে তা দিয়ে একটি কলস ভরতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে। ফলে ভুক্তভোগীরা বিশুদ্ধ পানি সংকটে থাকার বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের লোকজনকে অবহিত করেন। তবে কোনো সুফল পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সমতল থেকে চানপুর টিলার উচ্চতা প্রায় ৪০০ ফুট। ১৯৪০ সাল থেকে ভারত সীমান্ত লাগোয়া ওই টিলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বসবাস শুরু হয়। বর্তমানে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ ওই টিলায় ৩৬ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারের ২৭০ জন লোক বাস করে। একসময় ঘন জঙ্গলে ভর্তি ছিল গ্রামের চারপাশ।

২০০৮ সালে রোমান ক্যাথলিক চার্চে একটি নলকূপ স্থাপন করলেও পানি না আসায় প্রথম থেকেই অকেজো হয়ে আছে। টিলায় বসবারত গ্রামগুলোতে তীব্র পানি সংকট থাকায় বাসিন্দারা হেঁটে দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে পানি সংগ্রহ করে। বেশির ভাগ পানিই তারা পাহাড়ি টিলার ঝিরি ঝর্ণা থেকে সংগ্রহ করে। গ্রীষ্মকালে কাছের ঝিরি, ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যাওয়াতে পানির জন্য তাদের দূরের পথ পাড়ি দিতে হয়। নিরাপদ পানির আশায় জীবন ঝুঁকি নিয়ে পানি সংকট মোকাবিলা করতে বোতল জাত পানি কিনতে হয়। না হলে এক কলস পানি ২০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। আর এক ড্রাম (৩৫ লিটার) পানির জন্য খরচ হচ্ছে ১০০ টাকা। এ অবস্থা চললেও টিলাবাসীর পানির সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।

তারা আরও জানান, টাংগুয়ার হাওর, সীমান্তে শহীদ সিরাজ লেক, এশিয়ার বৃহত্তর শিমুল বাগান, বারেকটিলার জন্য পর্যটন স্পষ্ট হিসেবেও তাহিরপুর উপজেলা অত্যন্ত সুপরিচিত। আর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নে অবস্থিত সীমান্তঘেঁষা পর্যটন স্পষ্ট খ্যাত বারেকটিলা (বারিক্কা টিলা), মাঝের টিলা, চানপুর টিলার সৌন্দর্য দেখতে আসা দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটকদেরও বিশুদ্ধ পানির অভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

বারেকটিলায় বসবাসরত আদিবাসী নেতা পুলক আজিম বলেন, ‘টিলায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। শুধু বারেকটিলা নয়, সীমান্তে বেশ কয়েকটি টিলার ওপর বসবাসরত মানুষের বিশুদ্ধ পানি খাওয়ার ব্যাবস্থা নেই। কর্তৃপক্ষকে বারবার জানার পরও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।’



তমাল দাশ নামক এক ব্যক্তি বলেন, ‘উপজেলার সীমান্ত এলাকার পাহাড়ি অঞ্চলে বারেকটিলা, মাঝের টিলা, চানপুর টিলাসহ সীমান্তের বেশ কয়েকটি এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘‘তাহিরপুর উপজেলার বারেকটিলায় বসবাসরত আনন্দপুর গ্রামের আদিবাসী নেতা ও ট্রাইব্যাল চেয়ারম্যান পুলক আজিম জানায়, তাদের এলাকায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। শুকনো মৌসুমে পাহাড়ি জাদুকাটা নদীর পানির ওপর নির্ভর করে গ্রামের মানুষ পানির চাহিদা পূরণ করে। বর্ষাকালে নদীর পানি ঘোলা হয়ে গেলে তাদের খাবার পানির সংকট বেড়ে যায়। শুধু বারেকটিলা নয়! সীমান্তে বেশ কয়েকটি টিলার ওপর বসবাসরত গ্রামগুলোর মানুষরা এখন পর্যন্ত ‘পানির অপর নাম জীবন’- এ শব্দটির সঙ্গে লড়াই করে চলছে।’’

শিউলি সাংমা (৫২) বলেন, ‘খুব ভোরে উঠে ছোট গর্তে জমে থাকা পানি সংগ্রহ করে বাগানে লাগানো ৫০০ পানগাছের মাটি ভিজিয়ে দিয়েছি। এখন গরু আর নিজেদের খাবারের পানি সংগ্রহ করছি। ছড়ার পানি দিয়ে পানগাছ, গরু আর নিজেদের জীবনটা কোনো রকমে বাঁচাই।’ তিনি বলেন, ‘ছড়া থেকে পানি সংগ্রহ করেন স্থানীয় চানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী হিলারি রেমা। সে বড় পাথরের ভাঁজে থাকা একটি গর্ত থেকে ছোট একটি বাটিতে করে অল্প অল্প পানি নিয়ে আরেকটি বাটিতে ভরছে। কয়েক মিনিটের চেষ্টায় বাটি পানিতে ভরে গেলে তা ছেঁকে কলসিতে ঢালে। সে জানায়, পরিবারের একজনকে পালা করে সারা দিন পানি সংগ্রহে থাকতে হয়।’

গ্রামের প্রবীণ নারী রঞ্জনা মারাক (৮০) বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকেই আমরা এই গ্রামে আছি। এখন ভাতের কষ্ট কমলেও পানির অনেক কষ্ট বাপু।’

তাহিরপুর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আল আমিন বলেন, ‘শিগগিরই গ্রামটি পরিদর্শন করে সূপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে।’

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে টিলার বাসিন্দাদের পানিসংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

ঢাকা বিজনেস/এনই/ 



আরো পড়ুন