১৮ মে ২০২৪, শনিবার



শিশু শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের যোগাযোগ: কয়েকটি প্রস্তাব

শারমিন রহমান || ০৯ জানুয়ারী, ২০২৩, ০৬:৩১ পিএম
শিশু শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের যোগাযোগ: কয়েকটি প্রস্তাব


শিক্ষার্থীর সঙ্গে একজন শিক্ষকের প্রতিটি মিথস্ক্রিয়াই যোগাযোগের একটি রূপ। একজন শিক্ষকের কথা বলা,চাহনি,কণ্ঠস্বর,হাসি,আলিঙ্গন, প্রশংসা, হাসিমুখ বা রাগান্বিত মুখ; সব কিছুই শিক্ষার্থীকে কিছু না কিছু বার্তা দেয়। আর তার প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থীর জীবনে। শিক্ষার্থীর সঙ্গে করা শিক্ষকের আচরণ শিক্ষার্থীর আচরণের বিকাশ ঘটায়। কিভাবে তারা অন্য মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করবে, তা শিক্ষা দেয়। পরবর্তী জীবনে এর গভীর প্রভাব পড়ে।

একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। শিক্ষকের কণ্ঠস্বর বা কথা বলার মাধ্যমে, মুখের অভিব্যক্তির মাধ্যমে, চোখে চোখে ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে ও হাসির মাধ্যমে। 

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝখানে যে ভয়ের দেয়াল রয়েছে, সেটা ভেঙে ফেলা  জরুরি। ভয় নয়, ভালোবাসা থেকে শিক্ষার্থী যেন শ্রদ্ধা করতে পারে শিক্ষককে, সেটাই কাম্য। শিক্ষককে হয়ে উঠতে হবে শিক্ষার্থীর নির্ভরতার জায়গা,ভরসার জায়গা। শিক্ষার্থী যেন শিক্ষককে বন্ধু ভেবে সব কথা শেয়ার করতে পারে, সেদিকে যত্নবান হতে হবে। শিক্ষকের আচরণে শিক্ষার্থী যেন নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করে, সেদিকে খেয়াল রাখা খুবই জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে একজন মানুষের তৈরি হওয়ার সময়। এ সময়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শিখলে শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস বাড়বে; যা তার পরবর্তী জীবনে তাকে হতাশামুক্ত রাখতে সাহায্য করবে। আত্মবিশ্বাসী মানুষ নিজের ওপর ভরসা করে যেকোনো পরিস্থিতি সামলে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেবে। এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে শিক্ষার্থীর জীবনকে সুন্দর করতে অবদান রাখতে পারেন। 

মনোযোগ দেওয়া
শিক্ষার্থী যখন কোনো কথা বলে, তখন শিক্ষকের মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত। হাসিমুখ বা উৎসাহিত করার মতো অঙ্গভঙ্গি করা বা সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে একজন শিক্ষক দেখাতে পারেন শিক্ষার্থী যা বলছে বা যে কাজটি করছে, তা তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। শিক্ষার্থীর সব বিষয়ে তিনি যত্নশীল। শিক্ষার্থী তখন শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে নিরাপদ বোধ করবে। আত্মবিশ্বাস বাড়বে তার৷ এছাড়া একজন শিক্ষক ‘কী,কেন ও কিভাবে’- এসব প্রশ্ন করেও শিক্ষার্থীর প্রতি তার মনোযোগ প্রদর্শন করতে পারেন। 

স্পষ্ট, সুন্দর ও ইতিবাচক কথা বলা
বিদ্যালয়ে বা শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি সময় কাটায়। তাই শিক্ষার্থীর কথা বলা,আচরণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের পরিবেশ ও শিক্ষকের আচরণ, কথা বলা ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাই একজন শিক্ষকের উচিত সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা, স্পষ্ট ও সুন্দর ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার করা। সহানুভূতিশীল ভাষা শিক্ষার্থীর মধ্যে ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করবে। শিক্ষার্থী নিজেকে সম্মানিত বোধ করবে। গ্রামের শিক্ষার্থীরা পরিবার ও চারপাশের পরিবেশ থেকে সুন্দর শব্দের পরিবর্তে নেতিবাচক শব্দ ও গালি বেশি শুনে থাকে। যার প্রভাব শিক্ষার্থীর আচরণে লক্ষ করা যায়। তাই শিক্ষার্থীর আচরণের স্থায়ী পরিবর্তন করার জন্য সুন্দর ব্যবহার ও ইতিবাচক শব্দের ব্যবহারের বিকল্প নেই শিক্ষকের কাছে।  শিক্ষককে শিক্ষার্থীরা অনুকরণ করে সবচেয়ে বেশি। শিক্ষকের স্পষ্ট, সুন্দর, ইতিবাচক ভাষা ব্যবহারে শিক্ষার্থী নিজেকে মূল্যবান ভাবতে শুরু করে। তাদের মধ্যে ইতিবাচকতা ছড়িয়ে যায়। 

প্রশংসা করা
শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীর ছোট ছোট ভালো কাজের প্রশংসা করা। প্রতিটি শিশুর মাঝে দক্ষতা রয়েছে।  একেক শিক্ষার্থী একেক বিষয়ে পারদর্শী। কেউ গণিত বিষয়ে ভালো, কেউ ভালো ইংরেজিতে। কোনো শিক্ষার্থী লেখাপড়ায় একটু পিছিয়ে থাকলেও ফুটবল খেলায় সে সেরা, কেউ খুব ভালো ছবি আঁকে। শিশু যে কাজটা ভালো পারে, তাকে সে কাজের জন্য প্রশংসা করা উচিত। অন্য বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীকে গুরুত্ব দিতে হবে, সেটা বিভিন্নভাবে বোঝানো উচিত। প্রশংসা করলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে সম্পর্ক ভালো হয়,শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস বাড়ে। 

পুরস্কার দেওয়া
শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীকে তার ভালো কাজের জন্য পুরস্কার দেওয়া। হতে পারে তা একটি কলম, ফুল বা হাতে বানানো কোনো কার্ড ও ছবি। শিক্ষক পুরস্কার হিসেবে শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষের দলনেতা বানাতে পারেন। মোটকথা ভালো কাজের জন্য বা শিক্ষার্থীর দক্ষতার জন্য পুরস্কৃত করা জরুরি। এতে শিক্ষার্থীর আবেগ বিকশিত হয়। ভালো কাজের আগ্রহ বাড়ে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে সম্পর্ক দৃঢ় হয়। 

শিক্ষার্থীর কাজকে নির্দিষ্ট করে ব্যাখ্যা করা 
একজন শিক্ষক যখন কোনো শিক্ষার্থীর বিশেষ কোনো কাজকে নির্দিষ্ট করে বলেন বা ব্যাখ্যা করেন, তখন শিক্ষার্থী ভীষণ খুশি হয়। সে ভালোবাসা অনুভব করে, নিজেকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ভাবতে শুরু করে।  ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। যেমন, শিক্ষক যদি বলেন, ‘সামিয়া তোমার আজকের লেখাটা ভীষণ সুন্দর হয়েছে। তানিয়ার উচ্চারণ খুব সুন্দর, জাহিন খুব পরিপাটি হয়ে বিদ্যালয়ে আসে। আমার ভীষণ ভালো লাগে’,  তখন শিক্ষার্থীর সম্পর্ক মজবুত হয়। 

একসঙ্গে আনন্দ করা
শিক্ষক শুধু শ্রেণিকক্ষে পড়াবেন, এমন নয়। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনন্দ করবেন। জন্মদিন পালন, বিভিন্ন দিবসে গান,কবিতা, নাচ বা পিকনিকের আয়োজনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী একসঙ্গে আনন্দ করতে পারেন। এতে সম্পর্ক ভালো হয়। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছাকাছি আসার সুযোগ পায়। 

পাঠকে আনন্দদায়ক করা
শিক্ষার্থীর সামনে শিক্ষক বইয়ের পাঠকে আনন্দদায়ক করে উপস্থাপন করলে একঘেয়েমিতা দূর হয়। শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা তৈরি হয়। তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন হয়। শিক্ষার্থী  শিক্ষকের সঙ্গে সব বিষয়ে মন খুলে আলোচনা করতে পারে। 

শিক্ষার্থীর আচরণের দিকে মনোযোগ দেওয়া 
শিক্ষার্থীদের সব আচরণের দিকে খেয়াল রাখা খুব জরুরি। কোনো শিক্ষার্থী ভুল কাজ বা আচরণ করে ফেললে তাকে সবার সামনে শাস্তি না দিয়ে বলা যেতে পারে এভাবে, ‘তোমরা এমন আচরণ করো অনেকে, যেটা আমার খুব অপছন্দ। আমাকে খুব কষ্ট দেয় এমন আচরণ।’ শিক্ষার্থী অনুতপ্ত হবে ও তার আচরণের পরিবর্তন ঘটবে। পাশাপাশি শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস, ভরসা বাড়বে।

শিক্ষার্থীর নাম ধরে ডাকা ও তুমি করে বলা
শিক্ষার্থীর নাম ধরে ডাকলে ভীষণ খুশি হয় ওরা। কারণ শিশুর মাঝে নিজের পরিচয় নিয়ে একটা ভাবনা চলতে থাকে। নাম ধরে ডাকার মধ্য দিয়ে শিশু নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করে। এছাড়া, তুমি করে বললেও শিক্ষার্থী সম্মানিত বোধ করে। তুই করে বলা অনেক শিক্ষার্থী পছন্দ করেনা। তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে তাকে এমন ভাবনা কাজ করতে পারে। তবে শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক অনুযায়ী অনেক সময় ভালোবেসে শিক্ষক তুই বলতে পারেন। সেটা নির্ভর করে শিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্কের ওপর। 

নেতৃত্ব দৃষ্টান্ত তৈরি করা
শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের কাছে সত্যিকারের হিরো। তাই শিক্ষককে বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে হবে। এর ফলে শিক্ষার্থী নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধন বা যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবসময় সহানুভূতি এবং ভালোবাসার সঙ্গে নেতৃত্ব দিতে হবে।  

শিক্ষক মানসিক বা শারিরীক শাস্তি দেবেন, শিক্ষার্থী শিক্ষককে ভয় পেলেই মানুষ হবে,ভালো ফল করবে; এসব  ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের। শিক্ষার্থীর আনন্দদায়ক পাঠদানের পাশাপাশি একজন শিক্ষককে বন্ধু হয়ে উঠতে হবে। তাহলেই সুস্থ, সুন্দরভাবে শিশুর বেড়ে ওঠা সম্ভব হবে। কারণ, শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো মানসিক স্বাস্থ্য জরুরি। যা আমাদের দেশে এখনো অবহেলিত।  

লেখক: শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক



আরো পড়ুন