২৬ জুন ২০২৪, বুধবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

কাননে কুসুম কলি

সাদিয়া সুলতানা || ১০ মে, ২০২৩, ০২:০৫ পিএম
কাননে কুসুম কলি


রাতে যেই গোখরাটা কাননকে ছোবল দিয়েছিল, সেটা দিনেরবেলাও ওর পিছু ছাড়ছে না। একটা জ্যান্ত প্রাণী রাতভর নড়েচড়ে ওকে লক্ষ্যবস্তু করেছে, আতঙ্কে এমনিতেই আধমরা হয়ে আছে ও। এখন ঘরের যেখানেই পা রাখছে, সেখানেই ছোবল বসাচ্ছে বিষধর সরীসৃপ।

ছোবল খেয়ে পড়ে যেতে যেতে কানন একবার জানু ফুপুকে ধরে সামলে ওঠে। ফুপু আগের মতো বলে ওঠে না, ‘কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল’। উল্টো ছোবল মারে, ‘নটিগো মতো টাল হছ ক্যান?’

ফুপুর মুখে এত বিষ জানা ছিল না কাননের। পথ হারানো প্রাণীর মতো টলতে টলতে শোবার ঘরে আসে ও। কুসুম এখনো ঘুমাচ্ছে। কুসুমের মাথা ভরা চুল। আগে চুলের খুব যত্ন করতো কুসুম। প্রতি মাসে চা পাতা, ডিমের সাদা অংশ, মেহেদির মিশ্রণ লাগাতো। এখন ওর যত্নহীন চুলের ডগা ফেটে দুই তিনটা করে মাথা বেরিয়ে থাকে। 

কানন দরজার কাছ থেকে বোনকে দেখে। লালচে এলোচুলে কুসুমের শরীরের অর্ধাংশ ঢেকে আছে। 

কানন ডাক দেয়, ‘ওঠ। কত বেলা কইরা ঘুমাস! নাস্তা খাবি না?’

কুসুম নড়ে না। ওর দুপায়ের ফাঁকে রাখা কোলবালিশটা নড়ে ওঠে। বালিশটাকে আস্ত মানুষের মতো দেখায়। সত্যি মানুষ না তো? ঘোরে পড়ে কানন একবার চিৎকার করে ওঠে, ‘কে? কে?’

কুসুমের ঘুম ভাঙে না। ভারী শ্বাস ফেলে আরও গভীরে তলিয়ে যায় ও। যেন গতকাল কী ঘটেছে, কিছুই জানে না।

কুসুম এমনই। এসএসসির রেজাল্টের দিন নিজের রোল নম্বর খুঁজে না পেয়েও বাড়ি ফিরে এক গাদা ভাত খেয়ে এমন করে কোলবালিশ আঁকড়ে ঘুমিয়েছে। বাবা বাড়ি ফিরে কৈফিয়ত তলব করলে জড়ানো কণ্ঠে বলেছে, ‘হৈ চৈ কইরো না তো, একটা ছেলে দেইখা বিয়া দিয়া দাও।’

ঝুলন্ত কাপড়ের পাশ থেকে সরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায় কানন। ভাদ্র মাসের রোদে পুড়ে ভাজা ভাজা মাটি থেকে ধুলার ঘ্রাণ আসছে। গরম হাওয়া ত্বক ছুঁয়ে দিলেই ফোসকা পড়ে যাচ্ছে। 


এরপর সত্যিই দায়সারা গোছের দাম্পত্যে ঢুকে গিয়েছিল কুসুম। চুলের যত্ন নেওয়াও ছেড়েছিল। একবার শাশুড়ির সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করায় ওর বেণীর অর্ধেকটা কেটে দিয়েছিল ওই বাড়ির লোকেরা। 

লাভ হয়নি। কদিন যেতে না যেতে সিমের লতার মতো তরতর করে বেড়ে উঠেছিল ওর চুল। 

কাননের বুকে কান্না জমে। কদিন আগেও নিজের গর্ভের শিশুর সঙ্গে দিনরাত কথা বলতো কুসুম। কী নাম রাখবে ছেলের, চুপিচুপি বলেছিল কাননকে। আর এখন তৃতীয় সন্তানটিও যে ভূমিষ্ট হওয়ার এক সপ্তাহ পরে মারা গেছে, সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই ওর।

এইবারও পেটে বাচ্চা আসার খবর শুনে কুসুমের চোখমুখ খুশিতে চকচক করে উঠেছিল। তেঁতুলগোলা দিয়ে বাটি ভর্তি চটপটি খেতে খেতে কাননকে বলেছিল, ‘তোর দুলাভাই বলছে এইবার ডেলিভারির আগে ঢাকায় নিয়া যাইবো। আর শাশুড়ি আম্মা বলছে এই বাচ্চা না টিকলে ঘরে রাখবো না। আমি বলছি দুইটাই সই।’

জরায়ু ফাঁকা হতে না হতেই ভরে ওঠে কুসুমের। কিন্তু বাচ্চা প্রসব হলেও টেকে না। ওর প্রথম বাচ্চাটার ছিল ডাউন সিনড্রোম। ফোলা ফোলা চোখ, অস্বাভাবিক বোঁচা নাকের মেয়েটা একমাসও বাঁচেনি। দ্বিতীয়টা রক্তে ইনফেকশন হয়ে জন্মের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই মারা গেছে। আর এই দফার বাচ্চাটা মারা গেছে শ্বাসকষ্টে। কুসুমের স্বামী লুৎফরের ধারণা কুসুম নিজেই সন্তানদের হত্যা করছে। ওর শরীর দোষে ভরা। সুস্থ সন্তান প্রসবে সক্ষমই না সে। 

শেষ সন্তান প্রসবের পর ডাক্তার সাহেব দম্পতিকে জন্মনিয়ন্ত্রণের কার্যকর পন্থাগুলো শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবু বাচ্চার আকাঙ্ক্ষায় ওরা ব্যতিব্যস্ত হলে পরীক্ষানিরীক্ষার পর ডাক্তার জানিয়েছেন, কুসুমের আর বাচ্চা হবে না। টিউবের মুখ ব্লক হয়ে গেছে।

জেলা জজ আদালতের সেরেস্তা সহকারী লুৎফর অশিক্ষিত নয়। স্মার্টফোনে গুগোলে সার্চ করে সে জেনেছে, এবার কোনো হোমিও বা এলোপ্যাথিতে কাজ হবে না, তার বীর্য জমিনে পড়লেও বীজ অঙ্কুরিত হবে না। এ জমিন এখন বন্ধ্যা। তবে কুসুমকে অতটুকু দয়া করেছে সে, গতকাল নিজে স্ত্রীকে বাপের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে। যথাসময়ে তালাকের নোটিশ পেয়ে যাবে বলে নিশ্চিন্তও করেছে।

এভাবে কাননের স্বামী মাজহারও একদিন ওকে এ বাড়িতে পৌঁছে দিছে গেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে কানন বা তার গর্ভ অভিযুক্ত হয়নি। যে মানুষটার গর্ভে কাননের জন্ম সে-ই আসামির কাঠগড়ায় ছিল। 

মানুষটার কথা মনে হতেই কাননকে ফের সাপে কাটে। এবার আর তাল হারিয়ে টালমাটাল হয় না ও। শরীরে বিষ সয়ে গেছে। বারান্দার দরজায় দাঁড়ানো ফুপু তবু বলে না, ‘কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল’। ফুপু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার মোড়ে সিগারেট ফুঁকতে থাকা ছেলেছোকরার কাছ থেকে পরপুরুষের হাত ধরে বেগে যাওয়া মায়ের বেলেল্লাপনার কাহিনি শোনে।

কলিকে আরবি পড়াতে আসা ওস্তাদজির সঙ্গে পালিয়েছে কানন, কুসুম, কলির মা। সেদিন ওদের বাবা ফারুক বাড়িতে ছিল না। জমি বর্গা দেওয়ার টাকা আনতে লৌহজং গিয়েছিল। গ্রামের ওই কয় গণ্ডা সম্পত্তি ছাড়া কাননের বাবার আয়ের আরেক উৎস হচ্ছে কালি বাজারের ছাট কাপড়ের দোকান। আগে ফারুক স্ত্রী আর তিন মেয়ের জন্য প্রায় প্রতিমাসেই নিজের দোকানের কাটপিস কাপড় এনে দিতো। সেলাই মেশিনে সে নিজের হাতে স্ত্রীর জন্য ব্লাউজ, মেয়েদের জন্য কামিজ, সালোয়ার সেলাই করতো। 

কাননের বাবার কাটিং, ফিনিশিং পছন্দ হতো না ওর মায়ের। কানন খেয়াল করতো, মা বাইরে গেলে সাধারণত বাবার সেলাই করা কাপড় পরতো না, হাজী মার্কেটের দ্য নিউ দর্জি হাউজে গিয়ে হাল ফ্যাশনের ব্লাউজ, লেইস দেওয়া পেটিকোট সেলাই করে আনতো। 

অনেকদিন হয় কানন, কুসুম, কলির বাবা সেলাই মেশিন নিয়ে বসে না। কলি নতুন জামার বায়না করলেও না। 

কলি সেদিন কাননকে বলেছে, মা চলে যাবার আগের দিনগুলোতে বাবা কেবল মায়ের ঝুল ফিতার আড়ালের প্রায় উন্মুক্ত পিঠের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। 

বাবার এ চাহনি চেনে কানন।

বাবার বিপন্ন চেহারার দিকে তাকালে মায়া জাগে ওর। বিষধর গোখরাটা বুঝি বাবাকেও দংশন করে। গোপন যন্ত্রণায় কাতরে বাবা হয়তো তাই শোধ তোলার কথা ভাবে। 

কাননের মা নিরুদ্দেশ হওয়ার পনেরো দিন পর থেকে ওর বাবাও নিরুদ্দেশ হয়েছে। আব্বাসের মস্তক হাতে নিয়ে বাড়িতে ঢুকবে প্রতিজ্ঞা করে ফারুক ঘর ছেড়েছে। ঘর ছাড়ার আগেরদিন পর্যন্ত প্রতি বেলায় সে খাওয়ার টেবিলে কুড়মুড় করে ব্রয়লার মুরগির হাড় চিবাতে চিবাতে খুন করার সম্ভাব্য প্রক্রিয়াটা বর্ণনা করেছে।

কাননের মা বাড়ির কাউকে এই হাড়গোড় চিবুতে দিতো না। বলতো, টিভির সংবাদে দেখায় এই হাড়ের মজ্জার বিষ। বিষে ভরা হাড় চিবোনো শেষ করেও ওর বাবা খাবার টেবিল ছেড়ে উঠতো না। সিগারেট ধরিয়ে, দমকে দমকে ধোঁয়া ছাড়তো। 

জানালাহীন ঘর ছেড়ে বাড়ির সম্মুখ বারান্দায় দাঁড়ায় কানন। কুসুম কাপড় শুকাতে দিয়েছে। আধ শুকনো অন্তর্বাস, কামিজ, সালোয়ার থেকে তেল চিটচিটে গন্ধ আসছে। ঝুলন্ত কাপড়ের পাশ থেকে সরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায় কানন। ভাদ্র মাসের রোদে পুড়ে ভাজা ভাজা মাটি থেকে ধুলার ঘ্রাণ আসছে। গরম হাওয়া ত্বক ছুঁয়ে দিলেই ফোসকা পড়ে যাচ্ছে। 

কানন দেখে, টাটকা রক্ত লাগানো ছোরা হাতে রোদের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে ওর বাবা। স্বপ্নের ভেতরে রাতভর যেমন করে গোখরা কামড়েছে, তেমনি এসব স্বপ্নের ভেতরেই ঘটছে, নিজেকে প্রবোধ দিতে দিতে কানন এবার গেয়ে ওঠে, ‘কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল’!


কানন ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে জানু ফুপু এসে দাঁড়িয়েছে। 

‘তোর বাপে যদি সত্যিই খুন করে? জেল, ফাঁসি হইবো না?’

কাননের বলতে ইচ্ছে করে, ‘বাবা তো কুরবানির ইদের সময়ই পশুর গলায় ছুরি চালাইতে পারে না ফুপু। গরু, খাসির কান্না শুইনা ঘরে দরজা দিয়া বইসা থাকে।’

বলে না কানন। ও নিজেও ভাবতে থাকে বাবা আব্বাস ওস্তাদজীকে খুন করে ফিরবে। 

বাবার এক হাতে রক্তাক্ত ছুরি আরেক হাতে আব্বাসের ধড়হীন মস্তক, দৃশ্যটা দেখে গলির মোড়ের চায়ের দোকানে সিগারেট ফুঁকতে থাকা ছেলেগুলো বিস্ময়ধ্বনি তুলবে। জানু ফুপু কলিজা কামড় দেওয়া তীক্ষ্মতায় চেঁচিয়ে উঠবে, লা হাওলা ওয়ালা কুওওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ...

ভাবতে ভাবতে রাস্তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কানন আকাশ দেখতে চায়। আকাশ নেই। রোদ আকাশটাকে হাঁ করে গিলে খেয়েছে, চাইলেও দৃষ্টি ঝাঁঝালো রোদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না।

দুচোখ কচলে দুহাত নামাজের নিয়তের ভঙ্গিতে বুকের ওপরে রাখে কানন।

নামাজের নিয়ম সহি করে দেবে বলে আব্বাস ওস্তাদজী একদিন ডেকেছিল ওকে। কিভাবে নিয়ত বাঁধতে হবে দেখাতে গিয়ে হিজাবের ওপর দিয়ে ওর স্তনে চাপ দিয়েছে। এসব স্পর্শের ধরন চেনা আছে কাননের। সাহস করে হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে না পালালে আর কোথায় কোথায় দিতো কে জানে।

কলিকে জেরা করতেই সব বেরিয়ে পড়েছিল। কান্না গিলতে গিলতে কলি জানিয়েছিল, বালেগ-বালেগা হওয়ার লক্ষণ, হায়েজ নেফাসের বিষয়-আশয় সময় নিয়ে পড়ান ওস্তাদজী আর...আর...আগেরদিনও পায়জামার ভেতর দিয়ে হাত ঢোকানোর জন্য ধস্তাধস্তি করেছে...সেদিন, তার আগের দিন, তারও আগেরদিন দুই হাতে দুই স্তন...। 

কথা শেষ না করে কলি ফোঁপাচ্ছিল। 

কাননের স্তনজোড়া ফোঁড়ার বিষের মতো টাটিয়ে উঠেছিল। বিষ বেদনা ঠেলে কলিকে চড় দেবে বলে ও হাত ওঠানোর আগেই ‘মাকে এসব বলিস না’ বলে ছুটে পালিয়েছিল কলি। 

পরেরদিন পালিয়েছিল মা। মা অন্য কারও সঙ্গে পালালে এত শোক জমতো না কাননের বুকের ভেতরে। মায়ের কলঙ্কে স্বামী যে ওকে বাবার বাড়িতে ফেলে রেখে গেছে তবুও না।

আব্বাসের নোংরা হাত মায়ের শরীর ঘাঁটছে ভাবলেই সাপের দংশন লাগে কাননের শরীরে। 

কলি এসে দাঁড়ায়। 

‘দুই মাস হইল আমার হায়েজ হয় না।’

‘কার সাথে কী করছোস? আব্বাস না তো?’

‘না।’

কলির না শুনেও ঘেন্না ঘেন্না চোখে তাকায় কানন। ওর গা গোলায়। তাহলে কে, প্রশ্নটাও আর করতে ইচ্ছে হয় না। বিষের নীলে একটা জন্মচিৎকার দিতে ইচ্ছে করে।

হঠাৎ চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে কাননের। ওর ছলছলিয়ে ওঠা চোখ শুকিয়ে যায় মুহূর্তেই। 

কানন দেখে, টাটকা রক্ত লাগানো ছোরা হাতে রোদের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে ওর বাবা। স্বপ্নের ভেতরে রাতভর যেমন করে গোখরা কামড়েছে, তেমনি এসব স্বপ্নের ভেতরেই ঘটছে, নিজেকে প্রবোধ দিতে দিতে কানন এবার গেয়ে ওঠে, ‘কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল’!



আরো পড়ুন