০৩ জানুয়ারী ২০২৫, শুক্রবার



শিল্প-সাহিত্য
প্রিন্ট

কতদিন পরে এলে

নুরুল আনোয়ার বকুল || ০৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩, ১২:০২ পিএম
কতদিন পরে এলে


বিকেলের দিকে তরু এদিকে এলে স্টেডিয়াম থেকে টাইগার পাস পর্যন্ত পথটুকু হেঁটেই যায়। কারণ চট্টগ্রাম শহরে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার মতো জায়গা খুব বেশি নেই। তাই এই জায়গাটি তার বেশ পছন্দের। এছাড়া শিরীষতলার কপোত-কপোতির বৈকালিক আড্ডা সে বেশ এনজয় করে। মাঝে মাঝে  তাকে আশির দশকে ফেরত নিয়ে যায়। আজো সে স্টেডিয়াম মার্কেটের কাজ সেরে ফুটপাত ধরে হাঁটা শুরু করলো। পাশ দিয়ে ছেলে-মেয়েরা একে অন্যের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। কী সুন্দরই না লাগছে দেখতে! 

দু'টি ছেলে মেয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটির খোঁপায় গোঁজা ফুল, ছেলেটির হাতে কয়েকটি ব্রেসলেট। কী স্বাভাবিকভাবেই না কথা বলছে। একজন অন্যজনের চোখে তাকিয়ে হাসছে। দু-একটা কী কথায় যেন মেয়েটি হেসে গড়িয়ে ছেলেটির গায়ে পড়ছে। খুব সুন্দর একটি দৃশ্য! সে অপলক চেয়ে থাকে। ওর দৃষ্টির সামনে দিয়ে সুখী জুটিটি অদৃশ্য হয়ে যায়। অনেকদূর পর্যন্ত সে চেয়ে থাকে। স্মৃতির পর্দায় নবীনগর বিস্মৃত হয়! 

হঠাৎ মনে হলো নিশান্তাকে তো প্রোডাকশনের আপডেট জানানো হয়নি! পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিশান্তাকে ফোন দেয়, ‘হ্যালো দিস ইজ তরু ফ্রম বাংলাদেশ। হাউ আর ইউ বস?’ বিদেশিরা প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া খোশগল্প একেবারেই পছন্দ করে না। তাই প্রয়োজনীয় কথা সেরে মোবাইলটা পকেটে রেখে আবার পুরানো স্মৃতিতে ডুবে যায়। 

স্কুল জীবন, দুরন্ত কৈশোর, কলেজ জীবনের ফেলে আসা দিনগুলো। কলেজের পেছনের সেই সিজনাল টং দোকান। ছেলেমেয়ে পাশাপাশি আইলে বসে চা খাওয়া। রবিশস্যের ক্ষেত মাড়িয়ে হেঁটে চলা কত কত স্মৃতি! সেই সব সহপাঠীর কে কোথায় আছে? বেশিরভাগের খবর এখন তরুর কাছে নেই। তবে স্মৃতি তো আজও অম্লান। মিজান, বাশার, বাহার, সালমা, নীলা, লতা আরও কত নাম। 

 সাধারণ অথচ অসাধারণ রমণীয় সাজে পঞ্চাশোর্ধ এক রমণী তার সামনে দাঁড়িয়ে! হাতে একটু আগে সে নিঃশেষ করতে নেওয়া আস্ত সিগারেট। নিজেকে চিমটি কেটে দেখলো। না ব্যথা তো লাগছে। 

এ যেন মান্না দে’র সেই গানটি, ‘কপি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালি বিকেলগুলো সেই।’

কলেজ ক্যান্টিনের সেই আড্ডাগুলো, আড্ডার মধ্যমণি লতার কথা। লতা ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী। আড্ডার বিষয় যাই হোক সে তার মুখ্য আলোচক। সে দিনের আড্ডার বিষয় বাংলা ভাষা! লতা ফ্লোর নিয়ে শুরু করলো এটি একটি ছন্দহীন ভাষা। এর তাল-লয় কিছুই নেই। সবাই সমস্বরে বলে উঠলো ভাষার আবার তাল-লয় হয় নাকি? লতা বললো, হয়, হয়। যেমন 

দ্য ডগ বার্কস-এর বাংলা তার কাছে—কুকুর কেউ কেউ করে। এ ব্যাপারে তার যুক্তিও আছে । কাক কা-কা করে, কোকিল করে কুহু কুহু, কুকুর কেন ঘেউ ঘেউ করতে যাবে? কুকুর কেউ কেউই করবে।  যেমন, এলেনই বা কেন, গেলেনই বা কেন। তার যুক্তি এটি হবে, এলেনই বা কেন, যেলেনই বা কেন। যেতে যেতে, খেতে খেতে বলা যাবে, কিন্তু গান গেতে গেতে বলা যাবে না কেন? কেন বলতে হবে, গান গাইতে গাইতে? চাওয়ার বেলাতেও তাই, চেতে পড়া যায় না, চাইতে হয়। এসব অযৌক্তিক ও ছন্দহীন। 

মিজান ফ্লোর নেওয়ার জন্য আলোচ্য বিষয় পরিবর্তন করবে। ভাবে, ছাত্র ইউনিয়ন করা মেয়ে। তাকে তো রাজনীতি, অর্থনীতি দিয়ে আটকানো যাবে না, কোরান-হাদিস দিয়ে আটকাতে হবে। 

মিজান: বাদ দে তোর বাংলা ভাষা! আমি গেলাম  একটা গায়েবানা জানাজা আছে।
লতা: গণহারে গায়েবানা জানাজা বে-দাআত।
মিজান: তুই বললে হবে? মক্কা-মদিনায় গায়েবানা  জানাজা হয়। তুই আসছস ফতুয়া দিতে। ইস কত বড় মুফতিনি তিনি! 
লতা: শুন তাহলে। নবী করিম (স.) জীবনে একটি মাত্র গায়েবানা জানাজা পড়েছেন। জানস সেটি কার গায়েবানা জানাজা? 

মিজান কোনো কথা বলে না। 

লতা: সেটি হলো আবিসিনিয়ার (বর্তমান ইথুপিয়া) রাজা বাদশাহ নাজ্জাশির। কারণ আবিসিনিয়ায় তার জানাজা পড়ার মতো কেউ ছিল না বা পড়া হয়নি। অধিকন্তু তিনি যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন, সেটাও অন্য ধর্মালম্বীরা স্বীকার করতো না। তাই নবী করিম (স.) এই গায়েবানা জানাজার মাধ্যমে বাদশাহ নাজ্জাশিকে মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং জানাজাও আদায় করেছেন। সুতরাং শুধু যে সব মাইয়াতের জানাজা হয়নি, তাদের গায়েবানা জানাজা পড়া যাবে। যার হয়েছে তার গায়েরানা জানাজা পড়া বে-দাআত। আর মক্কা-মদিনা ইসলামের মানদণ্ড নয়। ইসলামের মানদণ্ড কোরআন হাদিস। ‘ওয়া উলিল আমরে’-এর মধ্যে সৌদি শাসকেরা পড়ে না। 

সালমা উঠে দাঁড়ালো,  চল ক্লাসে যাই।
লতা: আরে যাবো, এখনো দশ মিনিট আছে।
সালমা: না চল।

এবার লতা রেগে যায়। হৃদয়ছোঁয়া শব্দটির সঙ্গে একটি বর্ণ ও ঈ-কার যোগ করে যে হৃদয়চেরা শব্দ বললো, তা ছাপার অযোগ্য।

তরু মাঝে মাঝে ভাবে, লতা মানুষ, মেয়েমানুষ না অন্যকিছু। বাংলায় যদি চতুর্থ কোনো লিঙ্গ থাকতো, তবে লতার জন্য সেটাই যথার্থ হতো। 

কিন্তু তরু, মিজান, সালমা, লতা ও অন্যরা যখন লতাদের বাড়িতে গ্রুপ স্টাডিতে বসে, তখন লতা অন্য মানুষ। লাল পাড়ের শাড়ি পরা আদর্শ বাঙালি রমণী। চলন-বলন-কথন; সব কিছুতেই কন্যা, জায়া, জননী। তরুর মাঝে মাঝে মনে হয়, লতার ভোকাল কডও দ্বৈত কাজ করে। আজ তরুর চোখে লতা অপূর্ব সুন্দরী। তরু অপলক ছেয়ে আছে লতার দিকে। তার উপলব্ধি পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য কৃষ্ণবর্ণের মধ্যে। কিন্তু কলেজের প্রথম সারির ছাত্র নেতার তো প্রেম করা যাবে না! যদিও এ নিয়ে বন্ধু মহলে বেশ কানাঘুষা আছে। কিন্তু লতার ভয়ে কেউ মুখ খোলে না। মাঝে মধ্যে সালমাই শুধু লতাকে তরু-লতা বলে ডাকে।

তরু পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দিয়াশলাই জ্বালাবে। এমন সময় কে যেন বাজপাখির মত ছোঁ মেরে সিগারেটটি নিয়ে গেলো। আর সশব্দে উচ্চারিত হলো, ‘শালা এখনো সিগারেট চাড়ছ নাই’। তরু প্রকৃতস্থ হয়ে পাশ ফিরে যা দেখলো সেটা এক কথায় অবিশ্বাস্য। সাধারণ অথচ অসাধারণ রমণীয় সাজে পঞ্চাশোর্ধ এক রমণী তার সামনে দাঁড়িয়ে! হাতে একটু আগে সে নিঃশেষ করতে নেওয়া আস্ত সিগারেট। নিজেকে চিমটি কেটে দেখলো। না ব্যথা তো লাগছে। 

লতা: কী দেখস?
তরু: লতা! তুই কোথা থেকে? কেমন আছস? কই যাস?
লতা: থাম। থাম।

‘সুরে সুরভীতে নাহয় ভরিতো বেলা/ মোর এলোচুল লয়ে বাতাস করিতো খেলা/ ব্যাকুল কত না বকুলের কুঁড়ি রয়ে রয়ে যেতো ঝরে/ ওগো, না হয় রহিতে কাছে।’


লতার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করবে, না জড়িয়ে ধরবে, না বগলদাবা করে উসাইন বোল্ডের সঙ্গে পাল্লা দেবে, কিছুই তরুর মাথায় আসছে না। 

লতা: এসেছিলাম রেলওয়ে অফিসে হীরার (তার স্বামী) পেনশনের কাজে। হীরা দুই বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। 

পরিবেশটা একটু ভারী হয়ে ওঠে। এক দুই মিনিট দু'জনে নীরব থেকে তরুই কথা শুরু করে, চট্টগ্রাম কখন আসলি?

লতা: আজ তিন দিন। পেনশনের কোনো কুল কিনারা করতে পারিনি আজও। এদিকে আমার ছুটি শেষ। কাল কিছু করতে না পারলে আবার ২/৩ মাসের জন্য পিছিয়ে যাবো। আচ্ছা চল চা খাবো।

দু'জনে হাঁটতে হাঁটতে কালু মামার টং দোকানে আসে। কালু মামা আরেক সমঝদার।  আচার আচরণে কিছুটা কাটখোট্টা হলেও হৃদয়টা ‘মিত আল-বাহার’। বাংলা, হিন্দি, আরবি আলাতুল বলতে পারে। তরুকে দেখে কালু মামা স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে ‘মামুজি আইয়িয়ে’ বলে দু'টি চেয়ার পরিষ্কার করে দিলো। কালু মামার দোকানটা কোনো ট্রেডিশনাল চা দোকান নয়। 

এখানে সিলেক্টিভ লোক আসে। তারা বৈকালিক ও সান্ধ্যকালীন আড্ডা দেয়। গান শোনে। যেই সেই গান নয়, পুরনো দিনের মেলোডিয়াস গান। তরু, লতাকে কালু মামা শোনালেন, ‘কতদিন পরে এলে একটু বসো/ তোমায় অনেক কথা বলার ছিল যদি শোনো।’ 

মুখোমুখি চেয়ারে দু'জন বসে আছে। কথা হচ্ছে কম। নীরবতাই বেশি। কিন্তু সেই নীরবতা যে কত কথার সমষ্টি, তা যে যার মতো বুঝে নিচ্ছে।

তরু: উঠ, রাত হয়েছে, তুই আবার একা একা যাবি। 
লতা: একা কেন? তুই আছস না?

তরু বুঝতে পারলো সময়টা অনেক গড়িয়ে গেলেও তরুর প্রতি লতার আস্তা-বিশ্বাস ঠিক আগের জায়গায় আছে। ততক্ষণে কালু মামা বাজাচ্ছেন, ‘জিন্দিগি অর কুছ বি নেহি, তেরা মেরা কাহানি হে।’

তরু আরও দু'কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠলো। ছেলে-মেয়ে কে কোথায় আছে, কী করে ইত্যাদি, ইত্যাদি। 

এবার যাওয়ার পালা দু'জনেই উঠলো। তরু বিল দিতে গেলো। কালু মামার আরজি, ‘মেম ছাহাব থোরা বঠিয়ে’। এবার কালু মামা শোনালেন, ‘তুমি না হয় রহিতে পাশে/ আরও কিছুক্ষণ না হয় রহিতে পাশে/ আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে।’

একটা সিএনজি ডেকে দুই জন উঠে বসে। পেছনে সন্ধ্যা মুখার্জীর কণ্ঠে বাজছে কিংবদন্তী জুটি উত্তম-সুচিত্রার ‘পথে হলো দেরি’ ছবির সেই গান, ‘সুরে সুরভীতে নাহয় ভরিতো বেলা/ মোর এলোচুল লয়ে বাতাস করিতো খেলা/ ব্যাকুল কত না বকুলের কুঁড়ি রয়ে রয়ে যেতো ঝরে/ ওগো, না হয় রহিতে কাছে।’



আরো পড়ুন