২৬ জুন ২০২৪, বুধবার



‘টাঙ্গাইল শাড়ি’র স্বত্ব হারানোয় ফুঁসছে সচেতন মহল

আব্দুল্লাহ আল নোমান, টাঙ্গাইল || ০৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ১২:০২ পিএম
‘টাঙ্গাইল শাড়ি’র স্বত্ব হারানোয় ফুঁসছে সচেতন মহল


পৃথিবীব্যপী টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ির রয়েছে আলাদা কদর। নানা রঙ ও ডিজাইনের শাড়ি হওয়ায় নারীদের পছন্দের তালিকার প্রথম দিকে থাকে টাঙ্গাইলের শাড়ির নাম। প্রায় দুই শত বছর ধরে এই শিল্পের বিকাশ ঘটেছে জেলায়। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের শাড়িকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জিআই স্বত্ব আদায় করে নেয়। এতে ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে জেলাবাসী। তাদের দাবি, দ্রুত ভারতের জিআই বাতিল করে বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’কে জিআই স্বীকৃতি দিতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে  দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক। 

ভারতের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) করা একটি পোস্টে বলা হয়, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত, একটি ঐতিহ্যবাহী হাতেবোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রঙ এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। টাঙ্গাইলের প্রতিটি শাড়ি ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সৌন্দর্য্যরে মেলবন্ধনে দক্ষ কারুকার্যের নিদর্শন।’ 

এরপর থেকে টাঙ্গাইলসহ সারাদেশে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। জেলা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। টাঙ্গাইলের সচেতন মহল ইতোমধ্যে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। 

টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গে যুক্ত জানান, প্রায় ২০০ বছর ধরে ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক-বাহক টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি। যা নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুনাম কুড়িয়েছে। এছাড়া ‘নদী-চর খাল-বিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন’-এই স্লোগানের আলোকেই টাঙ্গাইলের মানুষের জীবনাচরণ চলমান। টাঙ্গাইল শাড়ি সদর উপজেলার বাজিতপুর, কৃষ্ণপুর, দেলদুয়ারের পাথরাইল, কালিহাতীর বল্লা, রামপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হয়। তবে দেলদুয়ারের পাথরাইল টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী হিসেবে খ্যাত।

বল্লা এলাকা সুতা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোস্তফা আশরাফী ও সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান হাসান ভারতের কড়া সমালোচনা করে বলেন, ‘প্রায় আড়াই শত বছরের ঐতিহ্য টাঙ্গাইল শাড়ি। এ শাড়ি টাঙ্গাইলেই অসাধারণ কারুকার্য ও সুক্ষ্ম নিপুণতায় অত্যন্ত দরদ দিয়ে তৈরি করা হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব শুধু টাঙ্গাইলের তাঁতিদের। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার টাঙ্গাইল শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক(জিআই) স্বীকৃতি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব ছিনতাই করার দুঃসাহস দেখিয়েছে।’

টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী খ্যাত পাথরাইলের শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি বলতে টাঙ্গাইলকেই বোঝায়। টাঙ্গাইলের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ভিন্ন মান ও ভিন্ন দক্ষতায় টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি হয়। এই দক্ষতায় অন্য জায়গায় শাড়ি তৈরি হলেও সেটা টাঙ্গাইল শাড়ি নয়। অন্যরা টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজের দাবি করে জিআই ট্যাগ নেওয়া, এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক।’ তিনি এর প্রতিবাদ জানিয়ে  সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। 

টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগারের সাধারণ সম্পাদক ও কবি মাহমুদ কামাল বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা টাঙ্গাইল। কয়েকশ’ বছর আগে থেকে টাঙ্গাইল শাড়ি পৃথিবী বিখ্যাত। এ শাড়ি অন্য কোনো দেশ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকারী নয়। ওই দেশের জিআই স্বীকৃতি বাতিল করে বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।’ 

টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ আর্টিজেন্স ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেযের সভাপতি মোফাখখারুল বলেন, ‘‘প্রাচীনকাল থেকে টাঙ্গাইল শাড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাঁতিদের সুক্ষ্ম দক্ষতায় সঙ্গে তৈরি হচ্ছে। ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালে দেশভাগের পর টাঙ্গাইলের তাঁতিদের কেউ কেউ ভারতে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে। সেখানেই তারা আদি পেশা ‘তাঁত শিল্পের’ কাজ করছে। তাই বলে টাঙ্গাইল শাড়ি কখনোই সে-দেশের হতে পারে না। দীর্ঘ সময়ের প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের জোরে টাঙ্গাইল শাড়ি দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে। যারা ওই দেশে রয়েছে, তারাও শাড়ি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে; এটা যেমন সত্য, তেমনি টাঙ্গাইল শাড়ি টাঙ্গাইলেরই সম্পত্তি; এটাও ধ্রুব সত্য।’’ তিনি ওই দেশের জিআই স্বীকৃতি বাতিল করে বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানান।  

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি, মধুপুরের আনারস ও জামুর্কির সন্দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এটা যে এখানকার অর্জন, সেটার ৫০ বছরের সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতা দিতে হয়। অথচ টাঙ্গাইলের তাঁতশাড়ি আড়াই শ বছরের পুরাতন। টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রাখে। এছাড়া ২০১৭ সালে টাঙ্গাইল শাড়ি সরকার কর্তৃক ব্র্যান্ডিং হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারত যে ঘটনাটা ঘটিয়েছে, তারা ডকুমেন্টেশনে উল্লেখ করেছে, পাথরাইলের বসাক পরিবারের আদি পুরুষরা সেখানে গিয়ে তাঁত শাড়ির পাড়ের ডিজাইন চেঞ্জ করে একটা ভিন্ন প্রকার উদ্ভাবন করেছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে স্টাডি করা শুরু হয়েছে। মন্ত্রণালয় টু মন্ত্রণালয় কথা বলে এ বিষয়ে কিভাবে আবেদন করা যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া, আপিল করার সুযোগ থাকলে সে বিষয়েও কথা বলা হবে।’




আরো পড়ুন