২৬ জুন ২০২৪, বুধবার



নরসিংদীতে লটকনে ৩৫০ কোটি টাকা আয়ের প্রত্যাশা

এইচ মাহমুদ, নরসিংদী || ১২ আগস্ট, ২০২৩, ১০:০৮ এএম
নরসিংদীতে লটকনে ৩৫০ কোটি টাকা আয়ের প্রত্যাশা


নরসিংদীতে লটকনে ভাগ্য বদলেছে হাজারো চাষির। জেলায় এক সময়ে জংলি ফল হিসেবে পরিচিত লটকন এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে এই ফলের নতুন নতুন বাগানের সংখ্যা। চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে লটনকনের বাগান করা হয়েছে। হেক্টর প্রতি প্রায় ১৭ মেট্রিক টন হারে ৩২ হাজার মেট্রিক টন লটকনের ফলন পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী কৃষি বিভাগ। যার বাজার মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, বিগত বছরের তুলনায় এ বছর লটকনের ফলন বেশ ভালো হয়েছে। তবে সারাদেশে লটকনের ব্যাপক চাহিদা ও বাজার দাম ভালো থাকায় লটকনের পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম ভালো পাচ্ছেন। এতে করে চাষিদেরও লটকন বিক্রি করতে তেমন একটা বেগ পেতে হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, লটকনের পুষ্টিমাণ অনেক বেশি। এতে অনেক পরিমাণ ভিটামিন ‘বি-টু’ ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। এ ছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। যার ফলে মানবদেহে দৈনিক যে পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’র প্রয়োজন হয়, মাত্র তিন-চারটি লটকন সে চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট।

ফুল হয় না পাপড়িও ঝড়ে না। সরাসরি গাছের কাণ্ড থেকে বের হয় এ লটকল, যার স্থানীয় নাম বুগি। টক আর মিষ্টিতে ভরপুর এখানে উৎপাদিত ফলটি হাজারো চাষিদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। তাই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এখানকার চাষিরা শুরু করেছেন এ লটকনের আবাদ।


লটকন চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লটকন গাছ সাধারণত বৈশাখ-জ্যেষ্ঠ মাসে রোপণের উপযুক্ত সময়। বর্ষার শেষের দিকে মানে ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও গাছ লাগানো যায়। লটকনের গাছ ঝোপের মতো হয়ে থাকে। প্রতিবছর মাঘ-ফালগুণে লটকন গাছে মুকুল আসা শুরু হয়। জ্যেষ্ঠ মাসের শেষে পাকতে থাকে। বেলে ও দো-আঁশ মাটিতে ফলন ভালো হয়। লটকন ফলনে তেমন কোনো খরচ নেই। স্ত্রী গাছ লাগিয়ে দিলেই হয়। সময়ে সময়ে একটু পরিচর্যা করতে হয়। গোড়ার চারদিকে জৈব সার দিলে ফলন ভালো হয়। পিঁপড়া বা পোকামাকড়ের হাত থেকে ফল বাঁচাতে ছত্রাকনাশক দিতে হয়।

নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসার অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার লাল মাটিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান, তাই এখানে লটকনের ফলন ভালো হয়। আবার চাষিরাও লটকন আবাদে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এ কারণে লটকের আবাদ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে লটনকনের বাগান করা হয়েছে। এর মধ্যে শিবপুর উপজেলায় এক হাজার ৬০০ হেক্টর, বেলাব উপজেলায় ২০০ হেক্টর, রায়পুরা উপজেলায় ৫০ হেক্টর ও মনোহরদী উপজেলায় ৪০ হেক্টর জমিতে লটকন চাষ হয়েছে।

হেক্টর প্রতি প্রায় ১৭ মেট্রিক টন হারে ৩২ হাজার মেট্রিক টন (একটন সমান ১০১৬ কেজি) লটকনের ফলন পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী কৃষি বিভাগ। আর উৎপাদিত এ লটকন বাজার মূল্য লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা।

স্থানীয় লকটন চাষিরা জানান, এক সময় ঝোপ-জঙ্গল ও বাড়ির আঙ্গিনায় লটকন গাছ রোপণ করতেন। প্রায় ৩০ বছর আগে প্রথম বেলাবো উপজেলার লাখপুর গ্রামে অপ্রচলিত ফল লটকনের আবাদ শুরু হয়। এরপর থেকে বেলাব ও শিবপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের লালমাটির এলাকায় লটকন চাষের প্রসার ঘটতে থাকে। দিন দিন মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে খাদ্য ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ লটকনের চাহিদা বাড়তে থাকে বাজারে। বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই লটকনের চাষ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে বেলাব ও শিবপুর উপজেলায় গত ৩০ বছরে বাণিজ্যিকভাবে লটকনের প্রসার ঘটেছে। দুই উপজেলার প্রায় পরিবারের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এখন লটকন। লটকন চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর পাশাপাশি বেকার সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছেন অনেকে।

লটকন চাষি ও স্থানীয় কৃষি অফিস জানায়, শিবপুর ও বেলাবো উপজেলার লাল রঙের উঁচু মাটিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান থাকায় এখানকার মাটি ও আবহাওয়া লটকন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এছাড়া রায়পুরা ও মনোহরদী উপজেলার কিছু কিছু এলাকার মাটিও লটকন চাষের উপযোগী। গাছের গোড়া থেকে শুরু করে প্রধান কাণ্ডগুলোতে ছড়ায় ছড়ায় ফলন হয় এই লটকনের।

লটকন চাষে জটিলতা নেই, খরচ কম। রোপণের তিন বছরের মধ্যে ফলন আসে। ফল দেয় টানা ২০ থেকে ৩০ বছর। লটকন গাছের রোগবালাই তেমন দেখা যায় না। ফল সংগ্রহের ৬০ দিন আগে গাছ প্রতি ৫০ গ্রাম পটাশ পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিলে ফলের মিষ্টতা ও আকার বৃদ্ধি পায়।


পাশাপাশি লটকনের বাজারজাত নিয়েও দুশ্চিন্তা নেই। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লটকন কাঁচা থাকা অবস্থায় বাগান কিনে নেন। বাগান কেনার পদ্ধতিও চমৎকার। প্রথমে বাগানের মালিকের কাছ থেকে একদল পাইকাররা দামদর করে বাগান ক্রয় করেন, পরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাকা লটকন বাগান থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। প্রকারভেদে পাইকারি মণ প্রতি দাম উঠে ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা। যা খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

নরসিংদীর লটকন খেতে সুস্বাদু হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলায় এর কদর রয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে এখানকার সু-স্বাদু এ লটকন ফল। কিন্তু ২০২০ সালে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দেশের থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সাময়িক বন্ধ থাকায় লটকন দেশের বাইরে রপ্তানির কিছুটা বিঘ্ন হয়। তবে বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই। এ বছর প্রায় ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন লটকন বিদেশে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধরাণ করা হয়েছে।

এদিকে মৌসুমী এ ফলের বেচা-কেনাকে ঘিরে এ জেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার মরজাল ও শিবপুর উপজেলা সদরে বসছে লটকনের বাজার। প্রতিদিন এ বাজারে প্রায় ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার লটকন কেনা-বেচা হয়। আর এ লটকনের হাটকে কেন্দ্র করে শতাধিক ব্যক্তির কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারি ক্রেতারা এসে এসব বাজার থেকে কিনে ট্রাক ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছেন লটকন। 

পর্যায়ক্রমে হাত বদল হয়ে লটকন যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার বাজারে। অনেকে সরাসরি বাগান থেকে লটকন কিনে সরবরাহ করছেন। বাজারে কথা হয় ট্রাকে লটকন লোট করা মফিজ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এ লটকন হাটকে কেন্দ্র করে আমার মতো প্রায় শতাধিক ব্যক্তি দৈনিক কাজ করে ১২০০/১৪০০ টাকা রোজগার করেছেন। তারা লটকটন পাইকারদের মালামাল প্লাষ্টিকের ঝুড়িতে করে মাথা নিয়ে ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে তুলে দেন। এতে করে তারা দৈনিক যে মজুরি পান, এ দিয়ে তাদের সংসার চলে।’

লটকনের পাইকারি ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, ‘আমি প্রায় ১৮ বছর ধরে এখানকার হাট থেকে লটকন কিনে নিয়ে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লটকন বিক্রি করে থাকি। এবছর গত ২ মাস ধরে প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ২০০০ কেজি লটকন কিনে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা পাইকারি দরে বাজার থেকে ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকায় কিনে নিয়ে ৯০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি করে থাকি।’

বাগান থেকে লটকন কিনতে আসা ফরহাদ হোসেন নামে অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘এ বছর আমরা লটকনের বেশ ভালো দাম পাচ্ছি। মৌসুমের শুরু থেকে আমার কেনা বাগান থেকে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা মণ দরে লটকন বিক্রি করেছি।’  

শিবপুর উপজেলার জয়নাগর ইউনিয়নের কামরাব গ্রামের আলমগীর হোসেন বলেন, ‘কম খরচে লাভজনক ফসলের মধ্যে একমাত্র হলো লটকন। লটকন বাগান শুরু করতে প্রথমে খরচ বেশি পড়লেও পরবর্তীতে বিঘা প্রতি ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয় না। সে তুলনায় লাভ বেশি হয়। এছাড়া লটকন ফলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গাছের কাণ্ডে ফলে। কখনও কখনও এত বেশি ফল আসে যে গাছের ডাল পর্যন্ত দেখা যায় না। একটি পূর্ণবয়ষ্ক লটকন গাছে ৫ থেকে ১০ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।’


একই উপজেলার লটকন চাষি কৌশিক আহম্মেদ জানান, তাদের এলাকায় প্রায় পরিবারের অর্থনীতিক মূল সহায়ক হলো এখন লটকন। তার দুইটি লটক বাগান রয়েছে, একটি হলো ৭ কানিং, যা স্থানীয় মাপে ৩৭৮ শতাংশ ও আর একটি হলো ৩ কানিং বা ১৬২ শতাংশ। এর মধ্যে একটি বাগান থেকে ২৬টি গাছ তিনি ৫ লাখ টাকায় বন্ধক দিয়ে দিয়েছেন। আর বাকি গাছ থেকে যে লটকন ফলন আসছে, এ থেকে প্রতিবছর তার বেশ ভালো আয় হচ্ছে।

বেলাব উপজেলার আমলাব গ্রামের লটন চাষি মো. নুরুল হাসান জানান, তার ২৯ কানি জমিতে একটি লকটন বাগান রয়েছে, এ বাগানে প্রায় ৭০০ লটকন গাছ রয়েছে। তিনি পাইকারের কাছে ১৩ লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। এ বছর লটকনের বাজার দর-দাম ভালো, প্রতি মণ লটকন বাজারে আকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকায়।

একই উপজেলার লাখপুর গ্রামের মানিক মোল্লা জানান, লটকন ফল বিক্রির চিন্তা করতে হচ্ছে না তাদের। স্থানীয় বাজার ছাড়াও লটকনের ফলন ধরার পর জমিতেই পাইকারি বিক্রি করে দেওয়া যায়। এ বছর একটি লটকন বাগান ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং আরেকটি বাগান ৩ লাখ ১০ হাজার টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। তাছাড়া শিবপুর ও মরজাল বাজারেও প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারি ক্রেতারা আসছেন লটকন নিতে।

নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘নরসিংদীর ব্যান্ডখ্যাত লটকনের সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ-বিদেশের বাজারে লটকনে চাহিদা থাকায় এবং অল্প খরচে বেশি লাভজনক হওয়ায় বেশির ভাগ চাষিই বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষ করছেন। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর লটকনের ফলন বেশি হয়েছে। তবে বাজারে চাহিদা থাকায় চাষিরা দাম ভালোই পাচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘লটকন চাষ বাড়াতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চারা উৎপাদন করাসহ চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তা-ছাড়া লটকনে রোগ বালাইয়ের তেমন সংক্রমণ না হওয়ায় উৎপাদন খরচ কম, ফলনও ভালো হয়। বাজারে লটকনের ন্যায্য দাম পাওয়ায় লটকন চাষিরাও লাভবান হচ্ছেন।’

ঢাকা বিজনেস/এইচ



আরো পড়ুন