২৬ জুন ২০২৪, বুধবার



বডি শেমিং ও মানুষের রুচি

নুরজাহান নুর || ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২, ১০:৪২ পিএম
বডি শেমিং ও মানুষের রুচি


বডি শেমিংয়ের মতো নিকৃষ্ট কাজ অহরহ ঘটে চলেছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে জনপ্রিয় ব্যক্তিও শিকার হচ্ছেন এই ধরনের অশোভন আক্রমণের শিকার। এবার এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন  ব্রাজিলের মডেল জুলিয়ানা নেহেম। শারীরিক স্থূলতার কারণে বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি তাকে। সম্প্রতি কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে লেবাননের বৈরুত থেকে দোহা যাওয়ার জন্য এয়ারপোর্টে যান জুলিয়ানা। আর সেখানেই সৃষ্টি হয় এই বিব্রতকর পরিস্থিতির। 

নিউ ইয়র্ক টাইমসে এই ধরনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল, পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে লেবাননে গিয়েছিলেন জুলিয়ানা। যাওয়ার সময়ে এয়ার ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। ওই সময়ে কোনারকম সমস্যা হয়নি তার। কিন্তু দোহা হয়ে ব্রাজিলে ফেরার পথে বিমানে উঠতে গেলে তাকে উঠতে দেওয়া হয়নি।

৩৮ বছর বয়েসী মডেল জুলিয়ানা এ বিষয়ে ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে লিখেছেন—‘আমার অতিরিক্ত ওজনের কারণে বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি। বৈরুত থেকে দোহা যাওয়ার কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইট ছিল এটি। সেখানকার একজন কর্মী আমাকে বলেছেন, ‘‘এই ফ্লাইটে উঠতে হলে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কাটতে হবে; না হলে উঠতে পারবেন না।’’ আর ফার্স্ট ক্লাসের টিকিটের মূল্য ৩ হাজার মার্কিন ডলার। ফার্স্ট ক্লাসের আসন আকারে বড়, যা আমার সঙ্গে ফিট হবে। তাছাড়া আমি যে ১ হাজার ডলার দিয়ে টিকিট কেটেছি, সে অর্থ ফেরত দেওয়া হবে না। এত বড় কোম্পানির বৈষম্যমূলক এমন আচরণ খুবই লজ্জাজনক। আমি মোটা কিন্তু অন্য সবার মতো স্বাভাবিকা।’ 

এ পরিস্থিতিতে ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন জুলিয়ানা। কোনো বাড়তি অর্থ না দিয়ে অন্য একটি ফ্লাইটে পরিবারসহ ব্রাজিলে ফেরেন এই মডেল। ব্রাজিলে ফিরে আদালতে মামলা করেন জুলিয়ানা। গত ২০ ডিসেম্বর এ মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। বিচারক রেনাটা মার্টিনস বলেন—‘মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জুলিয়ানা। এজন্য প্রতি সপ্তাহে ৭৮ ডলার ব্যয়ের থেরাপি প্রয়োজন। এই চিকিৎসা বাবদ কাতার এয়ারওয়েজকে মোট ৩ হাজার ৭১৮ মার্কিন ডলার জুলিয়ানার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

কতটুকু নিরাশাজনক ব্যাপার এটি। কাতার এয়ারওয়েজে কাজ করা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। কিন্তু তাদের মানবিকতা কোথায়? শিক্ষিত হলেই যে কোনো ব্যক্তি মানুষ হয় না, এই কথাই প্রমাণিত হলো এই ঘটনায়। বডি শেমিং খুবই নিন্দনীয়। আধুনিক সমাজে বর্বরতার নতুন এক নাম এই বডি শেমিং। বডি শেমিং, মানুষ হিসেবে কে কতটা অহেতুক সমালোচক তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। সবারই যে সৌন্দর্যের তথাকথিত ছাঁচে একই রকম করে সুন্দর হতে হবে, তার তো কোনো মানে নেই। প্রতিটি মানুষই নিজের মতো করে সুন্দর। কিন্তু সেই বিষয়টিকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা আমাদের  মাঝে নেই। আমাদের এই ছোট্ট একটি সমালোচনা কারও মনস্তাত্ত্বিক জগতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তার কিছু নমুনা দেখানো যাক। 

গালে টোল পড়া মেয়েরা অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়। এমন ধারণা থেকে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে গিয়ে গালে স্থায়ী গর্তের সৃষ্টি করে ফেলেছে, এমন মেয়ের সংখ্যা কম নয়। এছাড়া নাক খাড়া, ঠোঁটের গড়ন পাল্টানো বা চিবুক পাল্টানোর উদ্দেশ্যে নিজেকে ছুরি-কাঁচির নিচে সঁপে দিয়ে পস্তাচ্ছে অনেকে। 

কারো ঘাড়ে দোষ না দিয়ে আমরা বরং জঘন্য এই প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করি। নিজের কোন বিষয়গুলো আপনার ভালো লাগে বা আপনার জীবনে যারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব রাখে, সেগুলোর যত্ন নিন, সেটা শরীরই হোক বা অন্য কোনো গুণই হোক। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুন, আমার কেন মডেলদের মতো ‘পারফেক্ট’ হতে হবে? বিউটি পার্লারে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানোর চেয়ে ওই সময়টুকু সমাজ বা ব্যক্তিগত কোনো গঠনমূলক কাজে কেন ব্যবহার করছেন না? সৌন্দর্যের কোনো স্ট্যান্ডার্ড থাকতে পারে না, সৌন্দর্যের কোনো সংজ্ঞা থাকতে পারে না। পার্লারের দেয়ালে দেয়ালে যে ছবি টাঙানো থাকে, কেউ সেরকম সুন্দর না হলে তার ‘খুঁত’ ধরতে হবে এমন চিন্তাও ছোট মনের পরিচায়ক।  

সমাজ যেমন চাইবে সেই শর্ত মেনে সুন্দর হতে হবে, এরকম বাঁধাধরা কোনো নিয়ম নেই। খুব সহজেই বলে ফেলা যায়, তুমি তো সুন্দর না। কিন্তু খুব সহজে কি একজন সুন্দর মনের মানুষ হওয়া যায়? একজন তথাকথিত কালো, মোটা বা ‘অসুন্দর’ মানুষ সমাজের কোনো ক্ষতি করে না, তার কারণে কেউ হয়রানির শিকার হয়। কিন্তু কারও মনে যদি বাস করে অসুন্দর চিন্তা,তাহলে ঘটে যেতে পারে ঘোরতর অনিষ্ট। তাই কাউকে বডি শেমিং না করে যারা সমাজের জন্য আক্ষরিক অর্থেই ক্ষতিকর, তাদের কাউন্সেলিং করে সুপথে আনাই শ্রেয়।



আরো পড়ুন