০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার



বিশেষ প্রতিবেদন
প্রিন্ট

দর্জির কদর কমলো, পসার বাড়ালো গার্মেন্টস পণ্যের

মো. আজহার উদ্দিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া || ০১ এপ্রিল, ২০২৩, ০১:৩৪ পিএম
দর্জির কদর কমলো, পসার বাড়ালো গার্মেন্টস পণ্যের


ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দিনেদিনে তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। এই চাহিদাকে কেন্দ্র করে জেলা শহরে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি বিপণী বিতান। এসব বিপণী বিতানে প্রতি মাসে কেনাবেচা হচ্ছে অন্তত ২০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক। বিভিন্ন উৎসবের সময়ে কেনাবেচা দ্বিগুণ হয়। বিশেষ করে ফ্যাশনসচেতন তরুণ প্রজন্মের প্রথম পছন্দ তৈরি পোশাক।  আর এই তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ায় দর্জিপাড়ায় আগের চেয়ে কাজ কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। দোকানগুলোতে সবচেয়ে বেশি কমেছে ছেলেদের শার্ট-প্যান্ট সেলাইয়ের কাজ। অধিকাংশ দোকান টিকে আছে শুধু বয়স্কদের পাঞ্জাবি ও নারীদের পোশাক সেলাই করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ছোট, মাঝারি ও বড় দর্জি দোকান আছে অন্তত দুই হাজার। এসব দোকানে কাজ করছেন প্রায় ১০ হাজার কারিগর। আগে সারাবছরই কারিগরদের হাতে কাজ থাকতো। এখন অনেক দোকানেই আশানুরূপ কাজের অর্ডার আসছে না। বছর তিনেক ধরে কাজ কমেছে দর্জি দোকানগুলোতে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে বড় দোকানগুলোতে প্রতিমাসে গড়ে কাজের অর্ডার আসতো দেড় লাখ টাকার। আর মাঝারি দোকানগুলোতে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার। ছোট দোকানে কাজের অর্ডার আসতো ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার। একেকজন দর্জি কারিগর প্রতিমাসে কাপড় সেলাই করে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করতেন। কেউ কেউ আয় করতেন ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। খরচ মিটিয়ে মালিকদের মুনাফা হতো ৩০ শতাংশের বেশি।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, করোনার পর থেকেই দর্জিদের কাজ কমতে থাকে। এছাড়া দিন দিন তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ায় মানুষ এখন দর্জি দোকন থেকে কাপড় বানাচ্ছে কম। পাশপাশি কাপড় সেলাইয়ের মূল্যের চেয়েও তুলনামূলক কম মূল্যে মার্কেটে তৈরি  পোশাক পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারণে দর্জিদের কাজ কমেছে। ফলে অনেক কারিগর দর্জি পেশা ছেড়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন ভিন্ন পেশায়। যদিও চলমান রমজান মাসে ব্যবসার খরা কিছুটা কাটতে পারে বলে আশা করছেন তারা। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ফোর স্টার মার্কেটের ন্যাশনাল টেইলার্সের মাস্টার মো. শহীদ মিয়া বলেন, ‘প্রায় চার দশক ধরে দর্জি পেশায় আছি। বছর তিনেক ধরে  দোকানে কাজ কমেছে। গ্রাহকরা তৈরি পোশাকে ঝুঁকছেন। এর কারণ হলো আমরা গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক ডিজাইনের পোশাক বানাতে পারছি না।  আবার বানাতে গেলে খরচও পড়ছে বেশি। যা গ্রাহকরা দিতে চাইন না। এসব কারণে দোকানে কাজ কমে গেছে।’

শহীদ  মিয়া আরও বলেন, ‘আগে মাসে একথেকে দেড় লাখ টাকার কাজের অর্ডার আসতো। বেশিরভাগই ছিল ছেলেদের শার্ট-প্যান্ট সেলাইয়ের কাজ। তবে এখন দোকানে অর্ডার আসছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার। খরচ মিটিয়ে ভালো মুনাফা হচ্ছে না। আগে ১২ জন কারিগর ছিল দোকানে। এখন কাজ কমে যাওয়ায় কারিগর আছেন মাত্র পাঁচ জন।’ 

নাইন টেইলার্সের কারিগর জুম্মান মিয়া বলেন, ‘শার্ট সেলাইয়ের জন্য ৪০০ টাকা রাখা হয়। অথচ এ দামে দোকানেই শার্ট পাওয়া যায়। ফলে শার্ট সেলাই দিন-দিন কমে যাচ্ছে। এছাড়া স্যুট সেলাইয়ের যা মূল্য, তার চেয়ে কম দামে এখন তৈরি স্যুট বা ব্লেজার কিনতে পাওয়া যায়। এসব কারণে দর্জির কাজ কমেছে। ফলে অনেকেই পেশা বদল করছেন; কেউ আবার পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে।’

তবে চাহিদা বিবেচনায় এখন সারাবছরই জমজমাট থাকে তৈরি পোশাকের ব্যবসা। জেলা শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপজেলা শহরগুলোতেও গড়ে উঠছে বিপণী বিতান। শুধু জেলা শহরেই বড় বিপণীবিতান আছে পাঁচটিরও বেশি। ঢাকার বিভিন্ন নামি ব্র্যান্ড শো-রুম খুলেছে শহরের বিপণীবিতানগুলোতে। জেলা শহরে ১০টিরও বেশি ব্র্যান্ডের শো-রুম আছে। এসব শো-রুম থেকে তরুণ-তরুণীরাই সবচেয়ে বেশি পোশাক কিনছেন।  তবে, মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের পোশাকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন দোকানিরা।

আশারাফুল আলম নামে এক তরুণ জানান, দর্জিরা এখনো পুরনো ডিজাইনের পোশাক সেলাই করেন। কোনো নতুনত্ব নেই। অথচ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনে আধুনিক পোশাকের কোনো বিকল্প নেই। দাম কিছুটা বেশি হলেও তৈরি পোশাকের ব্র্যান্ডশপগুলোতে নিজের পছন্দ অনুযায়ী আধুনিক ডিজাইনের পোশাক পাওয়া যাচ্ছে। এজন্যই দর্জি দোকান থেকে মুখ ফিরিয়ে তরুণরা তৈরি পোশাকের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের এফ. এ. টাওয়ারের ডিমান্ড ফ্যাশন হাউজের শাখা কোষাধ্যক্ষ আব্দুল মামুন বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দিন দিন ব্র্যান্ডের পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ব্র্যান্ডের পোশাক খোঁজে। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ব্র্যান্ডগুলোও বিভিন্ন অফার দিচ্ছে।  ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে তৈরি পোশাকের বাজার আরও চাঙা হবে।’

এ ব্যপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সিটি সেন্টারের ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা ও স্বপ্নলোকে ফ্যাশন হাউজের স্বত্বাধিকারী আসিফ ইকবাল খান বলেন, ‘ঢাকার নামি  ব্র্যান্ডশপগুলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার কারণে গেলো কয়েক বছরে তৈরি পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। সবকটি ব্র্যান্ডশপই ভালো ব্যবসা করছে। বিশেষ করে ছেলেদের পোশাক কেনাবেচা বেশি হয়। চাহিদা বিবেচনায় নতুন আরও অনেক ব্র্যান্ডশপ আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিমাসে গড়ে ২০ কোটি টাকার বেশি তৈরি পোশাক বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন উৎসবের সময় বিক্রি বেড়ে দ্বিগুণ হয়। তবে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার আঁচ লেগেছে তৈরি পোশাকের ব্যবসাতেও। তবুও আমরা আশা করছি হয়তো আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ব্যবসা আবার চাঙা হয়ে উঠবে।’

ঢাকা বিজনেস/এনই/ 



আরো পড়ুন