১৮ মে ২০২৪, শনিবার



ভূমিকম্প মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

আফরিদা ইফরাত || ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩, ০৫:৩২ পিএম
ভূমিকম্প  মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন


প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট হ্যাজার্ড বা আপদের সঙ্গে মানুষের পরিচয় থাকে। সেজন্য মানুষ নিজের যাপিত জীবনকে মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু দুর্যোগ কবে, কখন, কোথায় আসবে কেউ বলতে পারে না। যেমনটা ঘটলো সিরিয়া-তুরস্ক ভূমিকম্পে। প্রথমে ৯ দশমিক ৮ মাত্রার এক ভূমিকম্প মানুষের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। তার ৯ ঘণ্টা পর ৬০ কিলোমিটার দূরে আরেক ভয়াবহ ভূমিকম্প, ৯ দশমিক ৬ মাত্রার। এরপর পুরো পৃথিবী শোকে, বিস্ময়ে আর অসহায়ত্বে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। স্মরণকালের ভয়ঙ্কর এই দুর্যোগ ফের পুরো পৃথিবীকে সচেতন হওয়ার বার্তা দিয়ে গেলো। একইসঙ্গে সিরিয়া-তুরস্কের প্রেক্ষাপটে যেন আর্তি ও অসহায়ত্বের গ্লানি আরও প্রকট করলো।

দুর্যোগের ওই রাতটি নিয়ে অবশ্য তেমন আশঙ্কা কারোই ছিল না। ওই রাতটিতে মৃদু তুষারপাত আর শীতল হাওয়া বইছিল ঘরে-বাইরে। ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছিল লাখো মানুষ। নদীর এপাড়ের মতোই কিছুক্ষণ পর প্রলয়নাচনে মানুষকে সচকিত হতেই হয়। নিদ্রারত ঘোরের মধ্যেই তাদের দৌড়ে বের হতে হয়। কিন্তু এই প্রলয় তো ক্ষণিকের কিন্তু মানসিক দৃশ্যপটে যেন অনন্তকাল। ছুটে বের হয়ে যাওয়া যাবে এই বিশ্বাস থেকেই মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করেছিল। যারা পেরেছিল তারা বেঁচেছেন কিন্তু আজীবন এক দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বাঁচার জন্য নয়। দুর্যোগ তাদের আরও অপেক্ষার প্রহর গুণতে দিয়েছে। চোখের সামনে শহরের বড় ভবনগুলো ধ্বসে পড়তে দেখেছেন তারা। তারপর আবার প্রতীক্ষা। এই প্রতীক্ষা খাদ্যের, ক্লান্তি দূরীকরণের। কিন্তু সেজন্যও তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দুটো তিন। যতক্ষণে ত্রাণ নিয়ে সরকারি বাহিনী এবং উদ্ধারকর্মীরা ছুটে এসেছেন ততক্ষণে বোধহয় দেরিই হয়ে গেছে। কারণ মানুষ এবার তাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে ফেটে পড়তে চেয়েছে। এত দেরি হলো কেন উদ্ধারকার্য শুরু করতে। এতক্ষণ তাদের ধ্বংসস্তূপে প্রবল শীতে অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাদের দিক থেকে এই ক্রোধ থাকাটাই স্বাভাবিক। 

কিন্তু ভূমিকম্পের ফলে তুরস্কের যোগাযোগব্যবস্থার এতটাই অবনতি হয়েছে যে এই দুর্যোগের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পৌঁছুতেও দেরি হয়েছে। অসহায়দের সাহায্যের জন্য সব প্রস্তুত হলেও রাস্তায় আটকে থাকতে হয়েছে দীর্ঘক্ষণ। একটি দুর্যোগ রাষ্ট্রকেও নানাভাবে বিধ্বস্ত করতে পারে। বিমানবন্দরও বিধ্বস্ত তাই সে উপায়েও যাওয়া কঠিন। ভূমিকম্পে তুরস্কের সড়ক ও এয়ারপোর্টগুলো চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বে ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্কের একাধিক বড় শহর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সংবাদচিত্র তুলে ধরতে বড় বড় সংবাদমাধ্যমকেও হিমশিম খেতে হয়েছে। ফলে উদ্ধারসাহায্য এবং ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতেও দুই দিন দেরি হয়েছে। মৃদু তুষারপাত এবং গর্জনরত বাতাস ধ্বংসস্তূপের নীরবতা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারছিল। এই নারকীয় পরিস্থিতিতে অপেক্ষা করতে করতে মানুষ একসময় বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। পরে তা ক্রোধে রূপ নেয়।

তবে জাপানে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা তুরস্ক-সিরিয়ার মতো নয়। কারণ তারা দুর্যোগ মোকাবিলা করার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রেখেছে। জাপানের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে যদিও আমরা ধরে নেই তবুও কিছু বিষয় থাকে।

এখন পর্যন্ত নানা জরিপ মোতাবেক মৃতের সংখ্যা ২৭ হাজার ছাড়িয়েছে। নানা জরিপ মোতাবেক, ৭ হাজারের মতো ভবন ধ্বংস এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলো সরকারি জরিপ কিন্তু বাস্তবে সংখ্যা আরও বেশি এটা অনুমান করাই যাচ্ছে। 

তুরস্কের পাশাপাশি সিরিয়াও হয়েছে ধ্বংসের শিকার। দীর্ঘদিন গৃহযুদ্ধের ফলে এমনিতেই সিরিয়ার অবস্থা খারাপ। সে খারাপ অবস্থার মুহূর্তে সিরিয়াও কঠিন সমস্যার মুখোমুখি। এমন সময়ে তারা বাংলাদেশের কাছেও মানবিক সাহায্য চেয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে সহায়তাকারী দলও পাঠানো হয়েছে। তারা এখনও জীবিতদের উদ্ধার করে নানা চমক দেখিয়েছেন। কিন্তু এমনটা প্রতি দুর্যোগের চিত্র। 

যেকোনো দুর্যোগের ক্ষেত্রে রেসপন্ডিং ক্যাপাসিটির বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়। দুর্যোগের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। যদি তা না থাকে তাহলেই এমন ভয়াবহ দুর্যোগের বিষয়টি সামনে আসে। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলে এই দুর্যোগকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এক হিসেবে ভুল নয়। কিন্তু আমরা যদি জাপানের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো এ ক্ষেত্রে প্রস্তুতির অভাবই বেশি লক্ষণীয়। দুর্যোগ মোকাবিলার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে গবেষণা শুরু করেছে। গবেষণার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও দুর্যোগ মোকাবিলার অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে অনেক দেশই তাদের রেসপন্ডিং ক্যাপাসিটি বাড়িয়ে থাকে। যেহেতু দুর্যোগ প্রতিরোধের আপাতত কোনো উপায় নেই, তাই রেসপন্ডিং ক্যাপাসিটি বাড়ানোর বিষয়েই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হয়। যেমন জাপানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প হয়। প্রতিদিনই দ্বীপরাষ্ট্রটির নানা অঞ্চলে বিভিন্ন মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়। বিভিন্ন জরিপ প্রতিবেদন দেখলে জানা যাবে, জাপানে তুরস্ক-সিরিয়ার মতো ভয়াবহ ভূমিকম্প প্রতিবছরই হয়। তবে জাপানে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা তুরস্ক-সিরিয়ার মতো নয়। কারণ তারা দুর্যোগ মোকাবিলা করার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রেখেছে। জাপানের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে যদিও আমরা ধরে নেই তবুও কিছু বিষয় থাকে। 

 মিডিয়ার লোকের সামনে তারা বারবার জানাচ্ছেন, আমরা খাবার চাই। সরকার কি আমাদের কথা শোনে না? তাই সময় এসেছে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়ার।


জাপানের ক্ষেত্রে দুর্যোগটা অনেকটা আপদের রূপ নিয়েছে। তারা জানেই তারা ভূমিকম্পনপ্রবন এলাকা এবং তাদের জন্য এটি জরুরি। এসব কিছু চিন্তায় রেখেই তারা নিজেদের অবকাঠামোগত সক্ষমতা এবং রিস্ক এসেসমেন্টে মনোযোগ দিয়েছে। কিন্তু সব দেশের ক্ষেত্রে তো বিষয়টি এমন না। জাপান ভূমিকম্পের ধরন এবং তাদের ভৌগোলিক অবস্থানের মধ্যে ঝুঁকির বিষয়গুলো চিহ্নিত করে তারা সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়েছে। এ জন্যই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতির বিকল্প নেই। 

সিরিয়া-তুরস্কের এই ভূমিকম্প আমাদের মূলত এই বিষয়টিকেই আবার অর্থবহ করে তুলে ধরেছে। আমরা প্রতিনিয়তই দেখি, দুর্যোগ নিয়ে প্রায়শই নানা কথা হচ্ছে। এরমধ্যে সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশি। প্রতিটি রাষ্ট্রই এখন ধীরে ধীরে দুর্যোগ মোকাবেলা ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে তোরজোর শুরু করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ক্রমেই নানা দেশের জন্য ভয়াবহ দুর্যোগের বিষয়টি স্পষ্ট করছে। আর তুরস্ক-সিরিয়া ভূমিকম্প বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বার্তাবহ হয়ে উঠেছে। 

এটিকে সারা বিশ্ব এখনকার মতো এই ধ্বংসস্তূপের পুনরুদ্ধার কার্যক্রম হিসেবেই দেখবে না-কি নিজেদের জন্য একটি অশনি সংকেত নিবে তা-ই দেখার পালা। বিশেষত বাংলাদেশের মতো একটি অঞ্চলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। দেশে ভূমিকম্পের ফল্ট সংবলিত ১৪ টি অঞ্চল রয়েছে। কিন্তু রিস্ক এসেসমেন্টের পর্যাপ্ত রসদ আমাদের নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যেকোনো দুর্যোগই হতে পারে। খরা, বন্যা, ঝড় ইত্যাদি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুটো মোটাদাগের ক্ষতি। ঠিক তুরস্ক-সিরিয়াতেও এমনই। প্রচুর মানুষের মৃত্যু এবং যারা বেঁচে থাকবে তাদের আর্তি। তুরস্ক ও সিরিয়ার ওই ধ্বংসস্তূপে অনেকেই আর্তি সাজিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করছেন। মিডিয়ার লোকের সামনে তারা বারবার জানাচ্ছেন, আমরা খাবার চাই। সরকার কি আমাদের কথা শোনে না? তাই সময় এসেছে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়ার।

লেখক: সংবাদকর্মী



আরো পড়ুন