উত্তরাঞ্চলের রাস্তার ধারে এখনো অযত্নেই রয়ে গেছে তুঁতগাছ। একটা সময় বরেন্দ্রখ্যাত এই অঞ্চলে রেশমের রাজত্ব ছিল। ওই সময় পলু (পোকা) পালনে তুঁত চাষ ছড়িয়ে পড়ে পুরো উত্তরাঞ্চলে। পতিত জমি, বাড়ির আশপাশের খণ্ডিত জমি, বাঁধের ধার, জমির আইল-সর্বত্রই দেখা মিলতো তুঁত গাছের। লাভজনক হওয়ায় তুঁত চাষও করতেন কেউ কেউ। কিন্তু ধীরে ধীরে রেশম শিল্পে দুর্দিন নেমে আসে। যত্নের তুঁতগাছও একসময় হয়ে যায় অবহেলার।
গবেষকরা বলছেন, তুঁত গাছের পাতা, ফল, বাকল এমনকি মূল সবই ঔষধি গুণসম্পন্ন। বহুমুখী এই উদ্ভিদ খাদ্য এবং ওষুধ শিল্পে বিপুল সম্ভাবনার। পলু পালন ছাড়াও এখন তুঁতের বিভিন্ন অংশকে কাজে লাগানোর সুযোগ বাড়ছে। এই সুযোগ কাজে লাগানো গেলে পাল্টে যেতে পারে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. এএইচএম খুরশীদ আলম। একদল গবেষককে সঙ্গে নিয়ে ২০১০ সাল থেকে তুঁতের ক্যান্সার প্রতিরোধী ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করে আসছেন তিনি।
ড. খুরশীদ বলেন, রেশম পোকার পুরো জীবনচক্র আবর্তিত হয় তুঁত পাতায়। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে তারা তুঁত পাতার অবাক করা পুষ্টিগুণ পান। একটা পর্যায়ে তারা তুঁত ফল, বাকল ও মূল নিয়েও আলাদা করে গবেষণা করেন। সব অংশেই কমবেশি প্রায় একই পুষ্টিগুণ পাওয়া যায়। তুত গাছের বিভিন্ন অংশের তুলনামূলক গবেষণায় এই প্রমাণ মেলে। ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি এই গবেষণাপত্র প্রকাশ করে যুক্তরায্য ভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী বায়োমেড সেন্ট্রাল রিসার্চ নোট।
গবেষণায় তারা নিশ্চিত হন- তুঁত ক্যান্সার প্রতিরোধী। মূলত, এই বিষয়টি নিয়েই শেষ পর্যন্ত গবেষণা এগিয়ে নেন। পরবর্তী গবেষণা নিয়ে ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান সাময়িকী পোলস ওয়ান-এ আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়। এই গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন স্বর্ণপদক পান ড. এএইচএম খুরশীদ আলম।
তিনি বলেন, তুঁত ফলের ৮৫ শতাংশই পানি। এছাড়া ১০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ২ শতাংশ ফাইবার, ১ দশমিক ৫ শতাংশ প্রোটিন এবং দশমিক ৫ শতাংশ চর্বি বিদ্যমান। প্রতি কাপ অর্থাৎ ১৫0 গ্রাম ফলে তুঁত ফলে শক্তি থাকে মাত্র ৬০ কিলোক্যালরি। ভিটামিন সি থাকে ৩০ দশমিক ২ মিলিগ্রাম। এছাড়া ভিটামিন -এ, ভিটামিন-বি, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও পটাশিয়াম বিদ্যমান।
তুঁত প্রায়ই কিশমিশের মতো শুকনো করে সংরক্ষণ করা যায়। এক্ষেত্রে ফলে প্রোটিনের মাত্রা বেড়ে যায়। শুকনো তুঁত ফলে ৭০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ১৪ শতাংশ ফাইবার, ১২ শতাংশ প্রোটিন এবং ৩ শতাংশ চর্বি বিদ্যমান।
গবেষণায় দেখা গেছে, তাজা তুঁত পাতায় ৪ দশমিক ৭২ থেকে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ অপরিশোধিত প্রোটিন, ৮ দশমিক ১৫ থেকে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ ফাইবার, ৪ দশমিক ২৬ থেকে ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ অ্যাশ, দশমিক ৬৪ থেকে ১ দশমিক ৫১ শতাংশ অপরিশোধিত চর্বি, ৮ দশমিক ০১ থেকে ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট থাকে।
এ ছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম তাজা তুঁত পাতায় ১৬০ থেকে ২৮০ মিলিগ্রাম অ্যাসকরবিক অ্যাসিড এবং বিটা-ক্যারোটিন, ৪ দশমিক ৭০ থেকে ১০ দশমিক ৩৬ মিলিগ্রাম খনিজ লৌহ, দশমিক ২২ থেকে ১ দশমিক ১২ মিলিগ্রাম দস্তা এবং ৩৮০ থেকে ৭৮৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ৬৯ থেকে ৮৬ কিলোক্যালরি শক্তি থাকে।
কেবল তাজা নয়, শুকনো তুঁত পাতাও পুষ্টির আধার। শুকনো তুঁত পাতার গুঁড়ায় ১৫ দশমিক ৩১ থেকে ৩০ দশমিক ৯১ শতাংশ অপরিশোধিত প্রোটিন, ১৪ দশমিক ৫৯ থেকে ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশ অ্যাশ, দশমিক ২৯ থেকে দশমিক ৪৯ শতাংশ অপরিশোধিত চর্বি পাওয়া যায়।
এছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনো তুঁত পাতার গুড়ায় দশমিক ৭২ থেকে ৩ দশমিক ৬৫ মিলিগ্রাম খনিজ লৌহ, দশমিক ২২ থেকে ১ দশমিক ১২ মিলিগ্রাম দস্তা, ৩৮০ থেকে ৭৮৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ১১৩ থেকে ২২৪ কিলোক্যালরী শক্তি বিদ্যমান। পাতা এবং ফলের মত তুঁত গাছের বাকল এমনকি মূলেও যথেষ্ট পুষ্টি উপদান পাওয়া যায়।
ড. এএইচএম খুরশীদ আলম বলেন, ‘মূলত তুঁত পাতা অ্যান্টি -থাইরোসিনেস, অ্যান্টি-ডায়াবেটিক, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি। তুঁত ফল এন্টি-ক্যানসার, অ্যান্টি -ডায়াবেটিক, অ্যান্টি -অক্সিডেন্ট এবং, অ্যান্টি- নিউরোডিজেনারেটিভ। তুঁত গাছের বাকল, অ্যান্টি -মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি -ইনফ্ল্যামেটরি। এছাড়া এর মূল অ্যান্টি–হাইপারলেপিডেমিয়া এবং, কার্ডিওভাসকুলার ট্রাবল রিলিভার।
তিনি যোগ করেন, বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে প্রাণঘাতি ব্যাধি ক্যান্সার।কিন্তু ক্যান্সার চিকিৎসায় সফল ও নিরাপদ ওষুধ খুবই কম। তুঁত পাতা, ফল এবং মূল ক্যান্সার প্রতিরোধী। এর এন্টিঅক্সিডেন্ট দেহের ফ্রি র্যাডিক্যালগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার কাজ করে। এর ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধ হয়।
এখনকার সময়ে অন্যতম সমস্যা স্থুলতা। এটি ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। খাবারের আগে তুঁত পাতার নির্যাস খেলে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে আসে। এতে শরীরের অস্বাভাবিক চর্বি কমে যায়।
তুঁত ফলের রস কিংবা পাতার নির্যাসে জৈব্য যৌগ ১-ডি অক্সিনোজিরিমাইসিন বিদ্যমান। এটি রক্তের শর্করার মাত্রা কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনে। একই সাথে অগ্ন্যাশয় এবং কিডনির জটিলতা ঠেকায়।
তুঁতে জেক্সানথিন বিদ্যমান। এটি চোখের রেটিনাকে ক্ষতি থেকে বাঁচায়। আবার চোখে ছানিপড়াও আটকে দেয়। তুঁত ফলে থাকা ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। তুঁতে ডায়েটরি ফাইবার বিদ্যমান। এটি হজম তরান্বিত করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। তুঁতে উপস্থিত অ্যালকালয়েডগুলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। তুঁত গাছে গুরুত্বপূর্ণ ফ্ল্যাভনয়েড রেসভেরট্রোল পাওয়া যায়। যা স্ট্রোক ও হার্টঅ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়।
তুত ফল এবং পাতার নির্যাস স্ট্রেস প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এর ছালে অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল রোগের চিকিৎসায় ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। ব্রণের বৃদ্ধি রোধ করে। কগনিটিভ ডিসঅর্ডার এবং বিভিন্ন ধরনের নিউরোনাল ডিসফাংশনের চিকিৎসায় যেসব ঔষধি গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তুঁত তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান।
তুঁত স্নায়ু-অবক্ষয় বিলম্ব করতে পারে। এটি লিভার সুস্থ রাখে। তুঁত ত্বক ও চুলকে স্বাস্থ্যকর এবং চকচকে চেহারা প্রদান করে। তুঁতকে অন্যান্য ঠান্ডা, ফ্লু-এর মতো সমস্যাগুলোর চিকিৎসার জন্যও ব্যবহার হয়।
জানা যায়, তুঁত (Mulberry) এর আদিনিবাস চীনে। ভারত, বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে তুঁত চাষ হয়। বিশ্বজুড়ে তুঁতের ১২টি প্রজাতি রয়েছে। তবে আমাদের দেশে Morus nigra, Morus rubra Morus alba এই তিন প্রজাতির তুঁত গাছ পাওয়া যায়।
মূলত, উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ তুঁত চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। দেশের পূর্বাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চলেও তুঁত চাষ হয়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে তুঁত গাছে ফুল আসে। ফল পাকে মার্চ-এপ্রিলে। দেশে উৎপাদিত তুঁত ফল বেশি সুস্বাদু।
স্বাদ ও পুষ্টিগুনে তুঁত ফলের সুখ্যাতি বিশ্বজুড়েই। কম ক্যালরির জন্য এটির জনপ্রিয়তা বাড়ছে দিন দিন। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পেও তুঁতের চাহিদা বেড়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে ড. এএইচএম খুরশিদ আলম বলেন, তুঁত ফল সরাসরি জ্যাম এবং কোমল পানীয় তৈরির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে । তুঁত ফল ব্রেড, কেক, ফ্রুট ড্রিংক পাল্প, ফ্রুট ওয়াইন, ফ্রুট সস, ফ্রুট পাউডার এবং চকোলেট তৈরির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
পাকা এবং অপরিপক্ক তুঁত ফল চাটনি তৈরির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ছয় মাস থেকে এক বছরের জন্য হিমাগারে সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা যায়। তুঁতের কচি পাতা সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার শুকনো পাতার গুড়া উষ্ণ গরম পানিতে ভিজিয়ে চায়েরমত করে পান করা যেতে পারে। তুঁত ফলের নির্যাস দইয়ের রঙের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই নির্যাস ব্যবহার করা যেতে পারে পেস্ট্রি উৎপাদনেও।
তবে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড আটকে আছে কেবল পলু পালনের উদ্দেশ্যে তুঁত চাষে। বিষটি নিশ্চিত হওয়া গেছে সংস্থাটির প্রাপ্ত তথ্যে। বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের উপ পরিচালক (বীজ) মো. আতিকুর রহমান জানান, দেশের ৩২টি জেলাজুড়ে ৫০০ ব্লক, ৩৫টি আইডিয়াল এবং সম্প্রসারিত চাষির প্রায় ৬৫০ একর তুঁত বাগান রয়েছে। এতে হাই বুস ও গাছ রয়েছে ১৮ থেকে ২০ লাখ। বছরে প্রতি একরে দেড় হাজার কেজি পাতা সংগ্রহ করেন রেশন চাষি। যা কেবল পলু পালনেই ব্যবহার হয়। এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞে যুক্ত প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ।
ফলের জন্য দেশে তুঁত চাষ হয় না জানিয়ে আতিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিএম-৮, বিএম-৮, বিএম-১০ এবং বিএম-১১ জাতের তুঁত ফলের আকার বড়। ফলের উদ্দেশ্যে এই জাতগুলো চাষ করা যেতে পারে। মোটামুটি একই ব্যবস্থাপনায় পাতার পাশাপাশি তুঁত ফলও পেতে পারেন চাষি। এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব আছে।
তবে বিস্তর গবেষণা ছাড়া নিজেদের উদ্ভাবিত জাতের তুঁত চাষে এখনই চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ঊর্ধবতন গবেষণা কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ।
ঢাকা বিজনেস/এইচ