২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, রবিবার



সূর্যমুখী চাষে কৃষকেরা হাসে

মো. আজহার উদ্দিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া || ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ১২:০২ পিএম
সূর্যমুখী চাষে কৃষকেরা হাসে


সূর্যমুখী ফুলের হাসিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষকের মুখে মুখে এখন হাসি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত ১০ বছর ধরে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করছেন কৃষকরা। এ বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ১০০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও প্রতিকূল আবাহাওয়ার কারণে ৫৫ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছে। যা থেকে ৯৭ মেট্রিক টন তেল উৎপাদন করা হবে। 

প্রতিদিন সকাল-বিকেল শহরসহ আশপাশ এলাকা থেকে সৌন্দর্য পিয়াসুরা দল বেঁধে আসেন এই সূর্যমুখী ফুলের বাগান দেখতে। অনেকেই বাগানে ঢুকে শখ করে ছবি তুলেন। কেউ সেলফি তুলতে ব্যস্ত কেউবা পরিবারের ছবি তুলতে ব্যস্ত কেউ ঘুরে ঘুরে বাগান দেখছেন। এ যেন এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। এদিকে কৃষকেরা বলছেন অল্প পুঁজিতে সূর্যমুখী চাষে অধিক লাভের স্বপ্ন দেখছেন তারা। কৃষি বিভাগ বলছে আগামী দিনে ভাল ফলনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

সরজমিনে সদর উপজেলার মাছিহাতা ইউনিয়নের খেওয়াই গ্রাম, রামরাইল ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রাম, ও পৌর এলাকার ভাদুঘর, নবীনগর উপজেলার নাটঘর ইউনিয়নের রসুলপুর ঘুরে দেখা গেছে সূর্যমুখী ফুলের বাগান। চাষীরা জানিয়েছেন জেলার বিভিন্ন গ্রামের জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই গাছে ফুল ধরেতে শুরু করেছে। চারিদিকে হলুদ রঙের ফুলের মন মাতানো ঘ্রান, হলুদের সমাহার। প্রতিটি বাগানেই মৌমাছির দল গুনগুন শব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৌমাছিরা সূর্যমুখী ফুল থেকে মধু নেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। গ্রামে সূর্যের মত হাঁসি দেয়া হলুদ গালিচা ছড়ানো ফুলের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে প্রতিদিন বাগানে আসছেন ভ্রমন পিপাসু নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ।

রসুলপুর সূর্যমুখী বাগানে ঘুরতে আসা জেলা শহরের কাজীপাড়ার রফিক বলেন, এখানে আসার পর দেখলাম জায়গাটি খুব সুন্দর। সূর্যমুখী বাগানে প্রথমবারের মতো আসলাম পরিবার নিয়ে। আমরা খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারছি। সূর্যমুখী ফুল দেখেও খুব ভালো লাগলো।

তমা নামে আরেকজন বলেন, ফুল দেখে খুব ভালো লেগেছে। এখানে ঘুরতে এলে মানুষ নিরাশ হবে না। এই ফুল থেকে আবার তেলও হয়। এই তেল খুব দামি। একইসঙ্গে তেল ও ফুল দুইটাই খুব ভালো। মানুষের উচিত বেশি বেশি করে সূর্যমুখী চাষ করা।

ভাদুঘর সূর্যমুখী বাগানে ঘুরতে আসা মহিনী বেগম বলেন, বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছি। ফেসবুকে অনেকেই দেখি সূর্যমুখী বাগানে ঘুরার ছবি দিচ্ছে। সেই লোভেই বাগানে ঘুরতে আসা। ঘুরতে এসে খুব ভালো লেগেছে। এই প্রথম সূর্যমুখী বাগান দেখলাম।

রসুলপুর বাগান মালিক জয়নাল আবেদিন বলেন, এখানে ৩ বিঘা জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছি। তিন বিঘা জমি চাষে আমাদের প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সে ফুল এখন গাছে আছে তা দিয়ে আশা করছি লাভবান হতে পারবো। তিনি আরও বলেন, এক বিঘা (৩০ শতাংশ) জমিতে সরিষা চাষ করতে যেমন তেল হয়, সূর্যমুখীতেও তাই হবে। তেল বিক্রি করে লাভবান হলে আগামীতে আরও বাড়িয়ে জমিতে সূর্যমুখী চাষাবাদ করা হবে।

পৌর এলাকার ভাদুঘর গ্রামের সূর্যমুখী ফুলের চাষী শাহানুর ভূঁইয়া বলেন, আগে  জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করতাম। গত কয়েক বছর ধরে সদর উপজেলা কৃষি অফিসারের পরামর্শে জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছিলাম। বেশ ভালোই ব্যবসা হয়েছে। তাই এই বছর ও সূর্যমুখী ফুলের চাষাবাদ করেছি। ধান ও সবজির বাজার মূল্য কম থাকাতে সৃর্যমুখী চাষে বেশ লাভজনক হবে বলে আশা করি।স্থানীয়ভাবে সরিষার তেল যে মেশিনে ভাঙানো যায়, সেখানে সূর্যমুখী ফুলের বীজও ভাঙানো যাবে। 

শাহানুর বলেন, কৃষি অফিস থেকে তাদেরকে বিনামূল্যে সূর্যমুখীর বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রতিটি গাছেই ফুল ধরেছে। আশা করি, এবারও সূর্যমুখী চাষে সফলতা আসবে। লাভবান হতে পারবো।

বুধল ইউনিয়নের চান্দিয়ারা গ্রামের কৃষক নূরু মিয়া বলেন, আগে জমিতে আলু, ধনিয়া, টমেটো, ঢেঁড়শ চাষ করতাম। কৃষি অফিসারের পরামর্শে ও অন্যদের দেখে উৎসাহিত হয়ে এ বছরই প্রথম বারের মতো জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছি। 

শাহানুর আরও বলেন, কৃষি অফিস থেকে তাকে বিনামূল্যে সূর্যমুখীর বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। কৃষি অফিস থেকে সব সময় খোঁজ-খবর রাখা ও তদারকি করা হচ্ছে।  তিনি বলেন, প্রতিদিনই শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকজন আসে সূর্যমুখী ফুলের বাগান দেখতে। আশা করি, সূর্যমুখী চাষে লাভবান হবো।

এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি অফিসার সমরেশ দাশ গুপ্ত জানান, এবার পৌরসভায় ১০ জন কৃষককে প্রণোদনা এক বিঘা জমি পরিমাণ বীজ এবং সার বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সূর্যমুখী ফুল যখন ফোটে, তখন দর্শনাদির ভিড় হয়, এতে অনেকেই ফুল নষ্ট করে ফেলে। সেজন্য অনেক কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। সূর্যমুখীর তেল কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ রাখে, মস্তিষ্কের জন্য উপকারী, ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে, শরীরের ব্যথা ও ক্ষয় রোগ দূর করে ও হাঁপানি রোগ নিয়ন্ত্রণ করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা কৃষি অফিসার শাহানা বেগম বলেন, বিগত ১০ বছর ধরে সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় সূর্যমুখীর চাষ করা হয়। সদর উপজেলায় ৫ হেক্টর জমিতে ৩০ জন কৃষক প্রণোদনার আওতায় এই সূর্যমুখী চাষাবাদ করছেন। তিনি বলেন, সূর্যমুখী একটি তেল জাতীয় ফসল। সূর্যমুখী তেল প্রকৃষ্ট মানের তেল। এই তেলে রয়েছে লিনোলিক এসিড। সূর্যমুখী বীজ ও মানুষের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে।

কৃষি অফিসার আরও জানান, সূর্যমুখী ফুল চাষের ৯০ থেকে ১০৫ দিনের মধ্যেই কৃষকরা সূর্যমুখী ফুল থেকে বীজ ঘরে তুলতে পারবেন। প্রতি বিঘা জমিতে ছয় থেকে সাড়ে ছয় মণ সূর্যমুখী ফুলের বীজ পাওয়া যাবে। বিঘা প্রতি কৃষকরা ৮/৯ হাজার টাকার বীজ বিক্রি করতে পারবেন। কৃষকদের স্বাবলম্বী করতেই সূর্যমুখী ফুল চাষে উৎসাহিত করা  হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা বাজার থেকে যে সাধারণ সয়াবিন তেল কিনি তাতে ক্ষতিকর কলোস্টরেল আছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার মুনসী তোফায়েল হোসেন জানান, সূর্যমুখী চাষ জমির উর্বরতার জন্য ভালো। এতে পোকামাকড় আক্রমণ করে কম। বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক চাষাবাদ হলে পর্যটকদের তৎপরতা কমে আসবে।

সূর্যমুখী চাষে কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষকদের বিনামূল্যে সূর্যমুখীর বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে আগামী দিনে উন্নত জাতের সূর্যমুখী চাষাবাদের পরিকল্পনার কথা জানান কৃষি বিভাগের এই কর্মকর্তা। তিনি আরও জানান, চলতি বছর ১০০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ৫৫ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছে। যা থেকে ৯৭ মেট্রিক টন তৈল উৎপাদন করা হবে।



আরো পড়ুন